জাল মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরি নিয়েও বহাল তবিয়তে রয়েছেন পাবনা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক তায়জুল ইসলাম। জেলা শিক্ষা অফিসারের তদন্তেও তার প্রমাণ মিলেছে। পিতার মুক্তিযোদ্ধা সনদের স্বপক্ষে গ্রহণযোগ্য কোন দালিলিক প্রমাণ দিতে পারেনি তায়জুল। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ২০০৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোঠায় চাকরিতে যোগদানের দশ বছরেও তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নেয়ায় সংশ্লিষ্ট মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
চাটমোহর উপজেলা ইউনিট মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে চাটমোহর উপজেলার অষ্টমনিষা মির্জাপুর গ্রামের আব্দুল আজিজ প্রামাণিকের ছেলে তায়জুল ইসলাম মুক্তিযোদ্ধা সন্তান পরিচয় দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোঠায় সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক পদে চাকরির আবেদন করেন। ২০০৬ সালে ৩২ বছর বয়সে চাকরিতে যোগদান করে বর্তমানে পাবনা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক পদে কর্মরত রয়েছেন।
এদিকে, ভুল তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোঠায় চাকরি নেয়ায় পাবনায় শহরের গোবিন্দা এলাকার আব্দুল হাইয়ের অভিযোগের ভিত্তিতে আইনজীবী রফিকুল আলম দিপু ২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর তায়জুল ইসলামকে লিগ্যাল নোটিশ দেয়া হয়। নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে ২০১১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রিয় কমান্ড কাউন্সিলের তালিকায় তায়জুলের পিতা আব্দুল আজিজ প্রামানিকের নাম উল্লেখ নেই। তিনি ভুুল তথ্য দিয়ে সরকারী চাকরি গ্রহণ করায় ওই পদে অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চাটমোহর উপজেলা কমান্ড কাউন্সিল সূত্রে জানা যায়, সংক্ষুব্ধ মহলের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মহাসচিব (প্রশাসন) আব্দুল আজিজ প্রামানিকের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় নিশ্চিত হবার জন্য চিঠি দেন। ২০১১ সালের তালিকায় নাম না থাকায় আব্দুল আজিজ সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হতে আবেদন করেন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটে সংযুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় যে সব শর্তাবলী উল্লেখ রয়েছে তার কোনটিই আব্দুল আজিজ প্রামাণিক পূরণ করতে পারেন নি।
এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, চাটমোহর উপজেলা ইউনিটের কমান্ডার মোজাহার হোসেন জানান, আব্দুল আজিজ প্রামাণিক কোথায় যুদ্ধ করেছে আমাদের তা জানা নেই। তাকে আমাদের চাটমোহরের মুক্তিযোদ্ধারা সনাক্ত করতে পারে নি। আমরা তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি নাকি পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের মুক্তিযোদ্ধাদের বাবুর্চী ছিলেন। তবে, পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের অনেকের সঙ্গে কথা বলেও আমি এ তথ্যের সত্যতা পাইনি। আর, মুক্তিযুদ্ধ কোন আনন্দ ভ্রমণ ছিল না যে, মুক্তিযোদ্ধারা বাবুর্চী নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন।
উপজেলা কমান্ডার আরো বলেন, যেহেতু ২০১১ সালের তালিকায় আব্দুল আজিজ প্রামাণিকের মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম নেই । সুতরাং তার সন্তানদের ২০০৫ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোঠায় চাকরির আবেদনের কোন সুযোগ নেই। যাচাই বাছাই কমিটিতে জোরালো প্রতিবাদ করার পরও প্রভাবশালী মহলের সুপারিশে আব্দুল আজিজকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ভুয়া সনদে মুক্তিযোদ্ধা কোঠায় তায়জুলের চাকরির বিষয়টি তদন্তে জেলা শিক্ষা অফিসার নাসির উদ্দিনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তদন্ত শেষে গত ৪ জুলাই পাবনা জেলা প্রশাসকের নিকট তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।
তদন্ত প্রসঙ্গে জেলা শিক্ষা অফিসার নাসির উদ্দিন জানান, বেশ কয়েকবার সময় দেবার পরও পাবনা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক তায়জুল ইসলাম তার পিতা আব্দুল আজিজ প্রামাণিকের মুক্তিযোদ্ধা সনদের স্বপক্ষে গ্রহণযোগ্য কোন দালিলিক প্রমাণ দেখাতে পারেন নি। তাড়াশ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার স্বাক্ষরিত একটি প্রত্যয়নপত্র জমা দিলেও, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল প্রদত্ত সংঙ্গার শর্তাবলী পূরণ হয় নি। মুক্তিবার্তা তালিকা, ভারতীয় তালিকা কিংবা প্রধানমন্ত্রী প্রতিস্বাক্ষরিত সনদ এর কোনটিই তার নেই।
তবে, মুক্তিযোদ্ধা সংক্রান্ত যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে আর হার্ডকপির প্রয়োজন হবে না বলে গত ২০ জুলাই পরিপত্র জারী করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সম্মানী ভাতা, চাকরিতে নিয়োগ অথবা মুক্তিযোদ্ধা সংক্রান্ত যেকোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে রক্ষিত তালিকা যাচাইবাছাই পূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ পরিপত্র অনুযায়ী, ওয়েবসাইটের সর্বশেষ হালনাগাদকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায়ও তায়জুলের পিতার নাম না থাকায়, তার সরকারি চাকরিতে বহাল থাকার কোন অধিকার নেই বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
তবে জাল সনদে চাকরি নেবার বিষয়টি প্রমাণিত হবার পরেও স্বপদে বহাল থাকায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে। চাটমোহর মির্জাপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও পাবনা এডভোকেট বার সমিতির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আব্দুল আজিজ প্রামাণিক মুক্তিযোদ্ধা নন। জালিয়াতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা কোঠায় চাকরি নিয়ে তিনি ও তার সন্তানেরা সকল মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করেছেন। অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি জানান তিনি।
মুক্তিযুুদ্ধকালীন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা বেবী ইসলাম হতাশা প্রকাশ করে বলেন, বর্তমান সরকার নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু, কিছু মানুষের অপকর্মের জন্য আজ মুক্তিযোদ্ধা শব্দের আগে ভুয়া যোগ হচ্ছে, এর চেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে? তিনি মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির বিষয়ে সরকারকে আরো কঠোর হবার আহ্বান জানান।
এসব বিষয়ে পাবনা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ ওয়াজেদ আলীর সাথে যোগাযোগ করা হলে, তিনি জানান সহকারি শিক্ষক তায়জুলের ব্যপারে সিদ্ধান্ত এখনো মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে আসে নি। এ বিষয়ে বিভাগীয় পত্র পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিডি প্রতিদিন/২৪ জুলাই ২০১৭/হিমেল