জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার কয়েকটি গ্রামের কিডনি বিক্রেতারা ভালো নেই। ঋণের বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে এসে যে মানুষগুলো একটু উন্নত জীবন যাপনের স্বপ্ন দেখেছিল, তারা এখন কর্মশক্তি হারিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।৫ থেকে ১০ বছর আগে কিডনি দেওয়া এই মানুষগুলোর কোমর ব্যথা, মাঝে মধ্যেই জ্বর, প্রস্রাবে জ্বালা-যন্ত্রণা করা, একটু হাঁটাচলা করলে শাসকষ্টের মত অসংখ্য রোগ শরীরে বাসা বেধেছে। পাশাপাশি সমাজে হেয় হচ্ছেন।
কালাইয়ের মাত্রাই ইউনিয়নের ভেরেন্ডি গ্রামের পাড়ার আকতার আলম জানান, ২০০৯ সালে দালালের খপ্পরে পড়ে কিডনি বিক্রি করেছিলেন। চার লাখ টাকা কিডনির দাম ঠিকঠাক হলেও প্রতারণার শিকার হয়ে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। এ দিয়ে ৫টি এনজিও এর ঋণের আসল টাকা পরিশোধ করেছেন। এখনো গ্রামীণ ব্যাংকের কিস্তি টানছেন। বর্তমানে পাড়ার ছেলেরা ছোট একটি দোকান করে দিয়েছে। এর মাধ্যমে দুমুঠো খেয়ে দুই সন্তান নিয়ে অভাবের মধ্যে দিন কাটছে।
অনুশোচনা করে তিনি বলেন, আগে মানুষের বাড়িতে কাজ করে, কখনো ভ্যান চালিয়ে, রোজগার করতাম। দিনে ১০০ টাকা পেলেও শারীরিকভাবে সুস্থ ছিলেন। আর এখন অন্যরা দিনে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকার কাজ করলেও চোখের দেখা ছাড়া কিছু করার থাকে না। তিনি আর কাজ করতে পারছেন না। এছাড়া ওষুধ কিনতে প্রতিমাসেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।
ভেরেন্ডি গ্রামের অপর কিডনি বিক্রেতা মেহেরুল জানান, কিডনি বিক্রি করেছেন মানে কর্ম বিক্রি করেছেন, এমন কাজ আর যেন কেউ না করে। তিনি আর বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও যেতে পারেন না, মুখ চোখ ফুলে গেছে। এছাড়া পাশের রোড়াই গ্রামের আইনুল, জোসনা সবাই জানালেন তাদের অসহায়তের কথা।
২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে, কালাই উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের ২০টি গ্রামের ১২০ জন মানুষ কিডনি বিক্রি করেছিল। এরপর আর সঠিক পরিসংখ্যান নেই উপজেলা প্রশাসন এবং সিভিল সার্জনের কাছে। তবে স্থানীয সূত্রগুলো বলছে কিডনি বিক্রি এখনো থেমে নেই।
স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী এবং জনপ্রতিনিধিদের মতে, কিডনি বিক্রির সংখ্যা তিন শতাধিক। মাত্রাই ইউনিয়নের ভেরেন্ডি, উলিপুর, সাতার, কুসুমসাড়া, অনিহার, পাইকশ্বর ও ইন্দাহার, উদয়পুর ইউনিয়নের বহুতি, জয়পুর বহুতি, নওয়ানা, নওয়ানা বহুতি, দুর্গাপুুর, উত্তর তেলিহারা, তেলিহারা, ভুষা, কাশীপুর, বিনাই ও পূর্বকৃষ্টপুর এবং আহমেদাবাদ ইউনিয়নের রাঘবপুর ও বোড়াই গ্রামের লোকজন বেশি কিডনি বিক্রির সাথে জড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া নতুন করে আশপাশের অনেকে কিডনী বিক্রি করেছেন বলে জানা গেছে।
কালাই পৌরসভার মেয়র হালিমুল আলম জন বলেন, কিডনি বিক্রি এখনো থেমে নেই। কয়েক মাস আগে তিনি ভারতের এক হাসপাতালে গিয়েও এলাকার লোকজনকে দেখেছেন কিডনি বিক্রির জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে। তিনি মনে করেন অভাব আর ঋণের কারণে কিডনি বিক্রি করছে এমনটি নয়। লোভে পড়ে কিছুটা আয়েশি জীবনের আশায় তারা শরীরের মূল্যবান অঙ্গ কিডনি বিক্রি করছেন।
মাত্রাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আ ন ম শওকত হাবিব তালুকদার লজিক বলেন, কয়েক বছর আগে কিডনি বিক্রির যে প্রবণতা ছিল তা কমে গেছে। কিডনি বিক্রি রোধে তারা জনসচেতনামূলক কর্মকাণ্ডও চালিয়ে যাচ্ছেন।
জয়পুরহাটের সিভিল সার্জন ডা. হাবিবুল আহসান তালুকদার জানান, কিডনি দেওয়ার কারণে তারা শরীরের নানা উপসর্গে পড়েছে তা ঠিক নয়। একটি কিডনি দিয়েও মানুষ চলতে পারে। তিনি মনে করেন অপুষ্টিসহ একজন সাধারণ মানুষের মত এসব কিডনি দাতারাও অসুখে পড়তে পারেন। তবে স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে আসলে তারা তাদের চিকিৎসা দিবেন।
বিডি প্রতিদিন/১২ আগস্ট ২১০৭/আরাফাত