স্কুল মাঠ সংস্কারে বরাদ্দকৃত ৪০ হাজার টাকা একে একে গেছে চেয়ারম্যান থেকে ইউপি সচিবের পকেটে। কাজ না করেই প্রকল্পের টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যরা। মুখ বন্ধ রাখতে স্কুল কর্তৃপক্ষকে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে কিছু নগদ টাকা। ফলে কাগজে কলমেই রয়ে গেছে নাটোর সদর উপজেলার ছাতনী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ ভরাট প্রকল্পটি।
মাটি দিয়ে মাঠ না ভরলেও, মাটির টাকায় পকেট ভরেছে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পর্যায়ের কয়েকজন জনপ্রতিনিধির। ফলে মাঠটি আগে যেমন ছিলো, এখনও তেমনি রয়েছে। অপরদিকে একই কাহিনী সদর উপজেলার হয়বতপুর বালিকা বিদ্যালয়ে। সেখানে সীমানা প্রাচীর ও মাঠ ভরাট কাজও শেষ না করেই টাকা উত্তোলন করা হয়। এই কাজের জন্য ২ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। এছাড়া নলডাঙ্গা উপজেলার মাধনগর এলাকায় পানি নিষ্কাশন করার জন্য বরাদ্দকৃত ২ লাখ টাকার কাজও সম্পন্ন করা হয়নি। তবে এসব প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও বানোয়াট এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে দাবি করেছেন।
নাটোর সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ছাতনী উচ্চ বিদ্যালয়ে মাটি ভরাটসহ মাঠ সংস্কারের জন্য টিআর প্রকল্প হিসেবে ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দয়ো হয়। কিন্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যসহ সংশ্লিষ্টরা কাজ না করে পুরো টাকা ভাগাভাগি করে নেন।
আভিযোগ উঠেছে, স্কুল কর্তৃপক্ষকে না জানিয়েই প্রকল্পের অনুমোদনসহ সমুদয় টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শেখ তোফাজ্জল হোসেন , ৪ ইউপি সদস্য সালেহা বেগম, হেলালউদ্দিন হেলু, এমরান আলী, আবু তাহের ও ইউপি সচিব মৃদুল কুমার তলাপাত্র। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্কুলের প্রধান শিক্ষক নারায়ন চন্দ্র সরকারকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দেন তারা। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে তারা তার হাতে ১০ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে বিষয়টি গোপন রাখার কথা বলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বরাদ্দকৃত ৪০ হাজার টাকার মধ্যে ২২ হাজার টাকা স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শেখ তোফাজ্জল হোসেনের যোগসাজশে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ইউপি সদস্য সালেহা বেগম, কমিটির সদস্য ওয়ার্ড ইউপি সদস্য হেলালউদ্দিন হেলু, ইউপি সদস্য এমরান আলী, ও ইউপি সদস্য আবু তাহের ভাগাভাগি করে নেন। এই কাজের মাস্টাররোল তৈরীসহ মুখ বন্ধের জন্য সচিব মৃদুল কুমার তলাপাত্রকে দেয়া হয় ২ হাজার টাকা। এছাড়া ভ্যাটসহ অন্যান্য খরচের জন্য রাখা হয় ৬ হাজার টাকা। অবশিষ্ট ১০ হাজার টাকা স্কুলের প্রধান শিক্ষক নারায়ন চন্দ্র সরকারকে দেয়া হয়।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক নারায়ন চন্দ্র সরকার জানান, প্রকল্পটি সম্পর্কে তারা কিছুই জানতেন না। জানাজানি হওয়ার পর প্রকল্প কমিটির সদস্যদের কাছে জানতে চাইলে তারা ১০ হাজার টাকা ধরিয়ে দেন। ওই টাকাই যেটুকু কাজ হয় তা করা হবে। ছাতনী উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি আব্দুল মালেক শেখ ১০ হাজার টাকা প্রাপ্তির কথা স্বীকার করেছেন।
ইউপি সচিব মৃদুল কুমার তলাপাত্র জানান, কাগজপত্রসহ প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করতে খরচ বাবদ তাকে ২ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। তবে ইউপি সদস্য এমরান আলী ও আবু তাহের বিস্ময় প্রকাশ করে জানান, প্রকল্পের বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না। টাকা ভাগাভাগির কোন প্রশ্নই ওঠেনা। মিথ্যা রটিয়ে তাদের সুনাম ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে।
কমিটির অন্যতম সদস্য হেলালউদ্দিন হেলু বলেন ,অভিযোগ প্রমাণ হলে তিনি নিজেই স্কুল মাঠের জন্য বরাদ্দ টাকার সমপরিমান দিয়ে কাজ শেষ করে দিবেন বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। তিনি বলেন বৃষ্টির কারণে তারা মাটি ফেলতে পারেন নি। অচিরেই তা ফেলা হবে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান ইউপি সদস্য সালেহা বেগম জানান, প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষকে টাকা প্রদান করা হয়েছে। টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ভিত্তিহীন বলেও দাবী করেন তিনি।
ছাতনী ইউপি চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও বানোয়াট বলে দাবি করে জানান, ওই প্রকল্পের সাথে তার সংশ্লিষ্টতা নেই। তাই অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার প্রশ্নই উঠেনা। তার জানা মতে প্রকল্পের কাজ ইতিপূর্বে সম্পন্ন হয়েছে।
এদিকে অভিযোগ ওঠেছে নাটোর সদর ও নলডাঙ্গা উপজেলায় ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষনাবেক্ষন (টিআর) কর্মসূচীর আওতায় বরাদ্দ বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি। এসব প্রকল্পের বরাদ্দের সিংহভাগ টাকা কাজ না করেই ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না করা বেশ কিছু প্রকল্পের টাকা প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে চাপ প্রয়োগও করা হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে এসব প্রকল্পের (হয়বতপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীরসহ মাঠ ভরাট কাজ, নলডাঙ্গা উপজেলার মাধনগর এলাকায় জলাবদ্ধ নিরসনে খাল সংস্কার কাজ, লেঙ্গুরিয়া সরকারী বিদ্যালয়ে মাঠ ভরাট কাজ, খোলাবাড়িয়ার টলটলি পাড়ায় বক্তৃতা মঞ্চ, হালসার ফুলসহর সরকারী বিদ্যালয়ে মাঠ ভরাট, হরিশপুরের দরবার শরীফ উন্নয়ন, দিঘীরপাড় পিরোজপুর রাস্তা ভরাট, লিযোয়ানী উত্তরপাড়া জামে মসজিদ সংস্কারসহ প্রায় অর্ধশত প্রকল্প) কাজ অসমাপ্ত রেখেই প্রকল্প কমিটির সদস্যরা সব অর্থ ভাগাভাগি করে নিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সদর উপজেলার হয়বতপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীরসহ মাঠ ভরাট কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে পারেনি প্রকল্প কমিটি। অথচ প্রকল্পের সিংহভাগ টাকা উত্তোলন করা করা হয়েছে। অবশিষ্ট টাকা প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। প্রকল্প কমিটির সভাপতি আব্দুল মান্নান ও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মফিজুর রহমান প্রকল্পের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, তারা যে পরিমান কাজ সম্পন্ন করেছেন, সেই কাজের টাকা দাবি করেছেন।
অপরদিকে নলডাঙ্গা উপজেলার মাধনগর এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল সংস্কারের জন্য বরাদ্দকৃত ২ লাখ টাকার কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ না করেই টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। তবে এই অভিযোগকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন দাবি করেছেন মাধনগর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ দেওয়ান। তিনি জানান , মাধনগর এলাকার প্রায় এক হাজার হেক্টর জমির জলাবদ্ধ পানি নিস্কাশনের জন্য ভেপু মেশিনের মাধ্যমে জিয়া খাল দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভেপু মেশিন দিয়ে কাজ করতে গিয়ে খরচ বেশী হয়েছে।
নাটোর সদর উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা আয়েশা সিদ্দিকা অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে জানান, প্রকল্পের অনেকগুলির কাজ জুনেও শেষ হয়নি। কিছু কাজ না করেই টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। আবার কাজ না করেই বরাদ্দের অর্থ তুলে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। সত্যতা পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিডি প্রতিদিন/২৯ আগস্ট ২০১৭/হিমেল