আর্থিক অনটনের কারণে পড়াশোনায় খুব বেশি এগিয়ে যেতে পারেনি মিজানুর রহমান। জীবিকার তাগিদে ছোটবেলাতেই বেছে নিতে হয় মোটর মেকানিকের কাজ। যন্ত্রপাতি আর লোহালক্করের সাথে শুরু হয় সেই পথচলা। কে জানতো এই মানুষটি একদিন অতিসাধারণ যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি করে ফেলবে অটোমেটিক অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র, পরিবেশ দুষণ যন্ত্র আর স্বয়ংক্রিয় সেচ যন্ত্র।
যশোরের শার্শা উপজেলার এই মোটরসাইকেল মেকানিক মিজান এখন দেশসেরা আবিস্কারক ও উদ্ভাবকের খেতাব পেতে যাচ্ছেন। মিজানের একাডেমিক কোনো শিক্ষা না থাকলেও আজ সে নিজের আলোয় আলোকিত। নিজ দক্ষতায় আবিস্কার করেছেন ৮টি যন্ত্র।
শার্শা উপজলোর নজিামপুর ইউনয়িনরে আমতলা গাতপিাড়ার অজপাড়া গ্রামে ১৯৭১ সালরে ৫ মে জন্মগ্রহণ করেন মিজান। দারিদ্রতার কারণে ৮-৯ বছর বয়সেই বেঁচে থাকার তাগিদে নেমে পড়েন মজুরের কাজে। মাঠে শ্যালো মেশিন চালানো এবং মেরামতের কাজ করেন মিজান। পরর্বতীতে নাভারন বাজারে একটি মোটরসাইকেলের গ্যারেজে কাজ পান তিনি। সেখান থেকেই তার মোটর মেকানিক হিসেবে র্কমজীবন শুরু হয়। বর্তমানে শার্শা বাজারে ভাই ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং ওর্য়াকসপ নামে একটি মোটরসাইকেলের গ্যারেজ রয়েছে তার। ছোটবেলা থেকেই তার শখ ছিল নতুন কিছু করা, নতুন কিছু জানা। তবে মেকানিক হেসেবে তার ইঞ্জিন তৈরি করতে প্রবল আগ্রহ ছিল।
মিজান প্রথমে উদ্ভাবন করনে হাফ ক্রানসেপ্ট দিয়ে একটি আলগা ইঞ্জিন। এই ইঞ্জিনের সকল যন্ত্রপাতি দেখা যেত বাইরে থেকে। এ ইঞ্জিনটি একবার জ্বালানি তেল দিয়ে চালু করলে পরর্বতীতে আর তেল লাগতো না। ইঞ্জিনের সৃষ্ট ধোঁয়া থেকে জ্বালানি তৈরি করে নিজে নিজে চলতো ইঞ্জিনটি।
ঢাকার তাজরিন গার্মেন্টস এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিকের প্রাণহানির পর মিজান দ্বিতীয় গবষণা করে উদ্ভাবন করেন স্বয়ংক্রিয় অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র, যা বাসা-বাড়ি, কলকারখানা, অফিস-আদালতে আগুন লাগলে যান মালের ক্ষয়ক্ষতি রক্ষার্থে ৫ থেকে ১০ সেকেন্ডের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে আগুন নেভাতে শুরু করে। এটি বিদ্যুৎ না থাকলেও চলবে। এই যন্ত্রটি অল্প জায়গায় রাখা যায়। কোনো জায়গায় আগুন লাগলে যন্ত্রটি তার তাপমাত্রা নির্ণয়ক যন্ত্রের মাধ্যমে আগুন’র অবস্থান নিশ্চিত করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অ্যালার্ম ও লাইট অন করে দেয়। তারপর একইসাথে সংযুক্ত মোবাইল থেকে সংশ্লিষ্ট সকলকে ফোন করে দেয়, পাশাপাশি যন্ত্রটি পানির পাম্পের সুইচ অন করে দেয়। যা আগুনের অবস্থান নিশ্চিতের ৫/৭ সেকেন্ডের মধ্যেই সম্ভব হয়।
এটি উদ্ভাবনের পর ২০১৫ সালে যশোর জেলা স্কুলের একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় মিজান এটি প্রর্দশন করে প্রথমস্থান অধিকার করেন। পরবর্তীতে এটি বিভাগীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় প্রথম ও দ্বিতীয়স্থান অধিকার করে।
দেশে পেট্রোল বোমায় যখন মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছিল ঠিক সে সময়ে মিজান উদ্বাবন করেন তার তৃতীয় উদ্ভাবন অগ্নি নিরোধক জ্যাকেট। এ জ্যাকেট পরে ড্রাইভার বা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নিরাপদে কাজ করতে পারবেন। এতে আগুনের মাঝে গিয়ে যানমাল রক্ষা করার সময় তার শরীরে আগুন স্পর্শ করবে না।
তার চর্তুর্থ উদ্ভাবন অগ্নি নিরোধক হেলমেট। এটি ব্যবহার করলে দুর্ঘটনায় আগুনে গলার শ্বাসনালি পুড়বে না। তার পঞ্চম উদ্ভাবন হলো প্রতিবন্ধীদের জীবন-মান উন্নয়নে মোটরকার। এটা বিদ্যুৎ বা পেট্রোল চালিত।
কৃষকদরে জন্য স্বয়ংক্রিয় সেচ যন্ত্র উদ্ভাবন হলো তার ষষ্ঠ উদ্ভাবন। এই যন্ত্রের মাধ্যমে কৃষকদের জমিতে পানি দিতে আর ক্ষেতে যেতে হবে না। বাড়ি বসেই সেচযন্ত্রটি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বন্ধ বা চালু করতে পারবেন। তাছাড়া এ যন্ত্রটি জমিতে পানির প্রয়োজন হলে নিজে নিজেই চালু হয় এবং পানির প্রয়োজন না থাকলে এটি একা একাই বন্ধ হয়ে যায়।
দেশীয় প্রযুক্তিতে মিজান তার সপ্তম উদ্ভাবন করেছেন ফ্যামেলি মোটরযান। ব্যবহারযোগ্য এ কার এলাকার মানুষের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। মিজানরে অষ্টম উদ্ভাবনে রয়েছে পরিবেশ সেফটি যন্ত্র। এটি পরিবেশ রক্ষার্থে বহুমুখি কাজ করে থাকে। যন্ত্রটি বাড়ি, অফিস বা কলকারখানায় ময়লা পরিষ্কারের কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। হাতের স্পর্শ ছাড়াই এ যন্ত্রটি পরিষ্কর করার কাজে ব্যবহার হয়। এ যন্ত্রটি উদ্ভাবনরে পর ২০১৬ সালের ৫ জুন জাতীয় পর্যায়ে মিজান পরিবেশ পদক লাভ করনে। জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে মিজান এ পর্যন্ত মোট ১৭টি সাফল্য সনদ ছাড়াও পেয়েছেন অসংখ্যা ক্রেস্ট ও সাফল্য পুরস্কার।
এরই মধ্যে মিজানের আবিষ্কৃত দেশীয় প্রযুক্তির মোটরকার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের আওতাভুক্ত হয়েছে। গ্রামীণ স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়নে ছোট ছোট অ্যাম্বুলেন্স তৈরি করার পদক্ষপেও নেওয়া হয়েছে।
খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আব্দুস সামাদ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়েও একজন অশিক্ষিত লোক বেশ কিছু নতুন জিনিস আবিস্কার করে রীতিমত সাড়া ফেলেছে। আমরা তাকে উৎসাহিত করেছি। সে ডিজিটাল মেলাসহ জাতীয় পর্যায়ে বেশ কয়েকটি পুুরস্কার পেয়েছে।
২০১৭ সালে পরিবেশেবান্ধব যন্ত্র আবিষ্কারে বিশ্ব পরিবেশ পদক নির্ধারিত হওয়ায় গত ৫ জুন মিজানকে আনুষ্ঠানিকভাবে পদক দেয় পরিবেশে অধিদপ্তর। মিজান জানান, তার স্বপ্ন দেশ ও জাতীর কল্যাণে কাজ করা। তিনি বর্তমান দুষিত বায়ু শোধন যন্ত্র আবিস্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিডি প্রতিদিন/৭ নভেম্বর ২০১৭/হিমেল