যে দিকেই চোখ যাবে পানি আর পানি। কিন্তু বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট। সুপার সাইক্লোন আম্ফানের তাণ্ডবে সুন্দরবন সংলগ্ন সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার উপকূলের নদ-নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায়। ফলে লোকালয়ে নদীর পানি প্রবেশ করে মাঠ-ঘাট, খাল-বিল, মিঠা পানির পুকুর ও বাড়ির আঙিনা নোনা পানিতে প্লাবিত হয়ে আছে।
ক্ষতিগ্রস্ত হয় দু’টি উপজেলার ৬৯৫টি নলকূপ ও ২২৫০টি ল্যাট্রিন। ভেঙ্গে পড়ে স্যানিটেশন ব্যবস্থা। ভেঙ্গে যাওয়া রিংবাঁধ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ গুলো সম্পূর্ণরূপে সংস্কার না হওয়ায় চারিদিকে শুধু নোনা পানি থই থই করছে। নদীর লবন পানিতে ডুবে রয়েছে টিউওয়েলগুলো। ফলে তীব্র খাবার পানি সংকট নিয়ে মানবেতর জীবযাপন করছে দেশের সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিমের জনপদ সুন্দরবন সংলগ্ন সাতক্ষীরা উপকূলের প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষ।
বসতবাড়ীর আঙিনা ও উঠানে হাটু ও কোমর পানি থাকায় খাদ্য সংকটের পাশাপাশি শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী, কাশিমারি, পদ্মপুকুর, গাবুরা ও আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা এবং প্রতাপনগর ইউনিয়নের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে বেঁচে থাকার তাগিদে বেড়িবাঁধের উপর অতিকষ্টে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন থাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য এসব অঞ্চলে হাহাকার চলছে।
স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এনজিও গুলো জারসহ বিভিন্নভাবে গাড়িযোগে উপকূল অঞ্চলে খাবার পানি সরবরাহ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। দূর্যোগকালীন প্রথম দুই তিন দিন বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর খাবার পানি সরবরাহ করলেও সেটি এখন বন্ধ রয়েছে। দুর্গম এলাকায় পরিবহযোগে পানি সরবরাহ করতে না পারায় নৌকা যোগে পানি সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ব্যক্তি উদ্যোগসহ বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানকে। তাই আম্ফান দূর্গতদের খাবার পানি জোগার করতে কলস নিয়ে পায়ে হেটে ও নৌকায় করে এক গ্রাম থেকে অন্যগ্রাম পাড়ি দিতে হচ্ছে।
আশাশুনি উপজেলার দয়ারঘাট গ্রামের রবীন্দ্র মন্ডলের স্ত্রী রানি মন্ডল জানান, দুটি ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে নিয়ে পড়েছেন মহাবিপাকে। খোলপেটুয়া নদীর দয়ারঘাট পয়েন্টে বেঁড়িবাধ ভেঙে বাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় বেড়িবাঁধের উপর আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তাদের ঘরে খাওয়ার পানি থেকে শুরু করে রান্নার জন্য কোনও খাবার পানি নেই।
একই এলাকার রিতু মন্ডল জানান, ঝড়ে বাঁধ ভেঙ্গে এলাকার নলকূপগুলো নদীর পানিতে ডুবে আছে। চারিদিকে নদীর লবন পানির কারণে প্রতিদিন পায়ে হেটে কলস নিয়ে পাশের গ্রামে খাবার পানি আনতে যেতে হয়। খাবার পানি সংগ্রহ করতে যেয়ে দিনের অধিকাংশ সময় পার হয়ে যাচ্ছে তাদের। এ চিত্র শ্রীউলা, প্রতাপনগর ইউনিয়নসহ পুরো আশাশুনি-শ্যামনগর জুড়ে।
গবুরা ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদ হোসেন, প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন ও শ্রীউলা ইউপি চেয়ারম্যান আবু হেনা শাকিল জানান, বেড়িবাঁধ সংস্কার না হওয়ায় উপকূল জুড়ে তীব্র খাবার পানি সংকট দেখা দিয়েছে। চারিদিকে নদীর লবন পানির কারণে উপকূল জুড়ে বিভিন্ন ভেড়িবাঁধের উপর আশ্রয় নেওয়া প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষ খাবার পানি সংকটে ভুগছে। রান্না থেকে শুরু করে পশুপাখি হাঁস-মুরগী ও গৃহস্থলির কাজে বিশুদ্ধ খাবার পানি ব্যবহার করে থাকে।
তারা আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের কারণে আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের শত শত নলকূপগুলো নদীর লোনা পানিতে নিম্মোজিত হয়ে পড়ে। নষ্ট হয়ে যায় খাবার পানির জন্য তৈরি মিঠা পানির পুকুর, রেইন ওয়াটার হারবেষ্টরসহ বিভিন্ন খাবার পানির উৎসগুলো। তাই এখনই জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এলাকায় খাবার পানির উৎসগুলো সংস্কারের পাশাপাশি পানি উন্নয়ন বোর্ড খুব দ্রুত ভেঙ্গে যাওয়া রিংবাঁধ গুলো মেরামত না করে তাহলে উপকূলের হাজার হাজার মানুষ নীজ ভিটামাটি ছাড়তে বাধ্য হবে।
সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আরশেদ আলী জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে জেলার ১০৫০টি নলকূপ ও ৩৬১০টি ল্যাট্রিন নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে আশাশুনি, শ্যামনগর ও কালিগঞ্জ উপজেলার নলকূপ, ল্যাট্রিন ও রেইন ওয়াটার হারবেষ্টারসহ বিভিন্ন খাবার পানির উৎস সহ প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে জানানো হয়েছে। এছাড়া উপকূলে প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে যাতে কোনওভাবে খাবার পানির নলকূপগুলো যাতে প্লাবিত না হয় সেজন্য মাটি থেকে তিন ফুট উচ্চতায় নলকূপ স্থাপনের প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।
বিডি-প্রতিদিন/সিফাত আব্দুল্লাহ