ফরিদপুরের বোয়ালমারী ও আলফাডাঙ্গা উপজেলায় চলতি বছরের গত সাত মাসে পানিতে ডুবে মোট ১৪ শিশু-কিশোরের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে বোয়ালমারী উপজেলায় নয়জন এবং পাশের আলফাডাঙ্গা উপজেলায় পাঁচজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
দুর্ঘটনার শিকার পরিবারগুলোর সূত্রে জানা গেছে, বোয়ালমারী উপজেলায় গত ৬ মে সদর ইউনিয়নের চালিনগর গ্রামের কৃষক মো. ইউসুফ শেখের দেড় বছরের শিশু মার্জিয়া বাড়ির পাশের ডোবায় পড়ে প্রাণ হারায়।
বারাশিয়া নদীতে সাঁকো পার হওয়ার সময় গত ১৫ জুলাই পানিতে পড়ে মৃত্যু হয় চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী শ্রাবনী আক্তার ওরফে সুলতানার (৯)। সুলতানা পৌরসভার চতুল মহল্লার পোশাক শ্রমিক বাবলু গাজীর কন্যা।
রূপাপাত ইউনিয়নের সূর্য্যাগ গ্রামের অটোরিকশা চালক মো. সাইফুল ইসলামের আড়াই বছরের শিশু সুমাইয়া পুকুরে ডুবে মৃত্যুবরণ করে গত ১৬ সেপ্টেম্বর।
তেলজুড়ী বাজার সংলগ্ন বেইলি সেতু থেকে কুমার নদে পড়ে গত ২৫ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করে আব্দুল মাজেদ (১৪)। মাজেদ চতুল ইউনিয়নের পোয়াইল গ্রামের বাসিন্দা ও ডোবরা আল-গফুরিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মো. ফরিদ উদ্দিনের ছেলে। মাজেদ ওই মাদ্রাসার ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন।
পৌরসভার লোকনাথ মহল্লার নছিমন চালক মো. এরশাদ মোল্লার আড়াই বছরের ছেলে আলিফ মোল্লা মারা যায় গত দুই অক্টোবর। পাশের বাড়িতে নলকূপের জন্য খোড়া গর্তে জমা বৃষ্টির পানিতে ডুবে তার মৃত্যু হয়।
ময়না ইউনিয়নের কেওয়াগ্রামের বাক প্রতিবন্ধী যুবক মো. ইস্রাফিল মোল্লা (২৪) পানিতে ডুবে মারা যান গত ৬ অক্টোবর। তিনি ওই গ্রামের আব্দুর রাশেদ মোল্লার ছেলে।
গুণবহা ইউনিয়নের বাগুয়ান গ্রামের বাসিন্দা স্থানীয় নূরে মদিনা মাদ্রাসার ছাত্র মো. তাওহিদ (৮) বাড়ির পেছনে খেলতে গিয়ে নিজেদের পুকুরে পড়ে মারা যায় গত সাত অক্টোবর। তাওহিদের বাবা মো. আইয়ুব মোল্লা ঢাকার একটি বেসরকারি কোম্পানির প্রাইভেটকার চালক।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. সাইফার মোল্লার পাঁচ বছর বয়সের মেয়ে আয়েশা মারা যায় গত নয় অক্টোবর। পৌরসভার ছোলনা মহল্লার বাড়ির পাশের পুকুরে ডুবে তার মৃত্যু হয়।
সাতৈর ইউনিয়নের রূপদিয়া গ্রামের নছিমন চালক আমিন শেখের দুই বছরের মেয়ে মমতা হেনা বাড়ির পাশের ডোবায় পড়ে মারা যায় ১৩ অক্টোবর।
এছাড়াও আলফাডাঙ্গা উপজেলার বুড়াইচ ইউনিয়নের পানিপাড়া গ্রামে মো. সবুজ ইসলামের ছেলে অন্তর (৫) মারা যায় গত ১৫ এপ্রিল। মায়ের সাথে গোপালপুর কলেজ পাড়ায় নানা বাড়ির পুকুরে গোসল করতে গিয়ে অসাবধানতাবশত সে পানিতে ডুবে যায়।
গোপালপুর ইউনিয়নের পবনবেগ গ্রামের অসীম কুমার বিশ্বাসের মেয়ে ঝিলিক বিশ্বাস (১১) ২৩ মে মধুমতি নদীতে ডুবে মারা যায়। সে স্থানীয় খোলাবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ছিল।
আলফাডাঙ্গা সদর ইউনিয়নের জাটিগ্রামের ফায়েক মোল্লার মেয়ে ফাতেমা খানম (৩) বারাশিয়া নদীতে ডুবে মারা যায় গত ৮ জুন।
বানা ইউনিয়নের উথলী গ্রামের মো. হাসান মোল্লার দুই মেয়ে লামিয়া (৮) ও লিজা (৩) গত ৯ জুলাই পুকুরে গোসল করতে নেমে ডুবে মারা যায়।
পানিতে ডুবে মৃত্যুর উপরোক্ত ঘটনাগুলোর পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পানিতে ডোবার প্রায় প্রতিটি ঘটনাই ঘটেছে সকাল ১০ থেকে বেলা তিনটার মধ্যে। আর দুর্ঘটনার শিকার পরিবারগুলোর অধিকাংশই নিম্ন আয়ের।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সামাজিক অধিকার নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হৃদয় মানবতাবাদী গোষ্ঠীর পরিচালক ও ফরিদপুর জজ আদালতের আইনজীবী গাজী শাহিদুজ্জামান লিটন জানান, নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর গৃহকর্তারা সাধারণত কাজের উদ্দেশ্যে সকালেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। আর বাড়ির গৃহবধূরা ওই সময়টাতে গৃহস্থালি ও দুপুরের রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাই দুপুরের এই সময়টাতে পরিবারের অসাবধানতায় পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনাগুলো বেশি ঘটে।
বোয়ালমারী পৌরসভার ছোলনা মহল্লার চাতাল ব্যবসায়ী মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রতিনিয়ত পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর খবর আসায় আতঙ্কিত হয়ে আমার সাত ও নয় বছরের দুই ছেলেকে নিয়মিত সাঁতার শেখাতে শুরু করেছি।
বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. খালেদুর রহমান মিয়া বলেন, দেশে প্রতিবছর শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে পানিতে ডুবে মৃত্যু অন্যতম। শিশু মৃত্যুরোধে পরিবারের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে এলাকায় মাইকিং করে অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করা যেতে পারে। সাধারণত পানিতে ডুবে যাওয়ার দুই-তিন মিনিটের মধ্যে মস্তিষ্কের অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে তাৎক্ষনিকভাবে রোগীর মৃত্যু হয়ে থাকে।
বিডি প্রতিদিন / অন্তরা কবির