তেঁতুলতলা গ্রামে দুপুরের আবহাওয়াটা বেশ অদ্ভুত ছিল। আকাশে মেঘ, চারদিক নীরব। দুপুর একটা-ত্রিশ মিনিটে মিন্টুর আম্মু, আয়শা
বেগম, মেয়ের বাড়ি যাওয়ার জন্য শাড়ি পরছিলেন, কপালে একটি ছোট্ট কালো টিপ এঁকেছিলেন। অলঙ্কার পরতে গিয়ে হঠাৎ বুক ধড়ফড় করে উঠল-ড্রেসিং টেবিলে রাখা দুই জোড়া দুল আর এক জোড়া রুলি নেই।
প্রথমে ভেবেছিলেন হয়তো নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে রেখেছেন। ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজলেন, আলমারি, বিছানার তলা, রান্নাঘর-সব জায়গা ঘুরলেন। কিছু পাওয়া গেল না। মিনিট যত গড়াচ্ছে, ততই সন্দেহ দৃঢ় হচ্ছিল-অলঙ্কার হারায়নি, চুরি হয়েছে।
খবরটি মুহূর্তে পাড়া কাঁপিয়ে দিল। গ্রামীণ জীবন এমনই-একটা খবর বেরোলেই এক কান থেকে আরেক কান হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ‘আয়শা বেগমের গয়না গেছে’-
বিকাল নাগাদ এ খবর পুরো গ্রামে আগুনের মতো ছড়িয়ে গেল।
পরিবারে সভা বসল। স্বামী আনসার শিকদার বললেন, ‘কেউ না কেউ তো নিয়েছে। সন্দেহ তো করতেই হবে।’ কিন্তু কাকে? প্রতিবেশীদের সঙ্গে আগে থেকেই জমিজমি নিয়ে বিরোধ। এ অবস্থায় সরাসরি অভিযোগ মানে বড় লড়াই।
এমন সময় মনে পড়ল গ্রামের অদ্ভুত খ্যাতি পাওয়া ছেলে ওমরের কথা। বয়স নয় বছর, কিন্তু তাকে নিয়ে গ্রামের লোকজন ফিসফিস করে। বলে, ওমরের কাছে জিন আছে। প্রায়ই গভীর রাতে সে একা মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে, তারপর কবরস্থানে বসে মৃতদের জন্য দোয়া করে। সেই অদ্ভুত অভ্যাসে তার ওপর একটা অলৌকিক ছায়া পড়েছে।
কেউ হারালে, কেউ অসুস্থ হলে, কেউ জিনে ধরেছে মনে করলে ওমরের কাছে যায়। তবে শর্ত আছে। সেবা নিতে হলে গভীর রাতে কবরস্থানের পাশে দাঁড়িয়ে সাদা কাপড় পরে তাকে সালাম দিতে হয়। তারপরই সে সমস্যার সমাধান জানায়।
আয়শা বেগম ভয়ে কাঁপলেও সিদ্ধান্ত নিলেন পরিবারের পরামর্শে-যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
চাঁদ ঢাকা রাত। বাতাসে হালকা শিরশিরানি। সাহস সঞ্চয় করে আয়শা বেগম গেলেন কবরস্থানের প্রাচীরের পাশে। সাদা কাপড় জড়িয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন। অন্ধকার ভেদ করে শিশুকণ্ঠ ভেসে এলো-
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। আপনার সমস্যা বলুন।’
‘বাবা, আমার অলঙ্কার চুরি হয়ে গেছে। কে নিয়েছে জানতে চাই।’
ওমর চোখ বন্ধ করে দীর্ঘক্ষণ নীরব রইল। তারপর গভীর গলায় বলল,
‘তোমার দুই জোড়া দুল আর এক জোড়া রুলি?-ঠিক?’
আয়শা বেগম শিউরে উঠলেন। ‘হ্যাঁ বাবা, সঠিক বলছ। নাম বলো।’
ওমর গম্ভীর স্বরে উত্তর দিল,
‘নাম বলা যাবে না। তবে চোর হলো ১২ বছরের এক ছেলে। কালো, বেঁটে, মোটাতাজা, চুল কোঁকড়া। বাড়ি তোমাদের পাশেই। আর মনে রেখো-মসজিদের দানবাক্সে ১০০ টাকা দান করবে।’
আয়শা বেগম দমবন্ধ হয়ে গেলেন। মনে মনে বুঝলেন কে হতে পারে। বাড়ি ফিরে পরিবারকে জানালেন। সন্দেহ যে প্রতিবেশী পরিবারের দিকে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠল।
পরদিন সকালেই তারা গেলেন জন্মান্ধ বদি হুজুরের দরবারে। হুজুরের খ্যাতি গ্রামে তুমুল। যা বলেন, তাই নাকি সত্য হয়।
আনসার শিকদার সালাম দিয়ে সব খুলে বললেন। হুজুর মনোযোগ দিয়ে শুনে মাথা নাড়িয়ে বললেন,
‘চোর তোমাদের পাশের বাড়ির ছেলে। কালো, বেঁটে, মোটা। আল্লাহর কসম, এ ছাড়া আর কেউ নয়। এখন শোনো-এই কাপড়টা নাও। অলঙ্কার যদি না ফেরত আসে, সাদা কাপড়ে বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে রাখবে। আল্লাহর হুকুমে, ফেরত না দিলে চোরের গায়ে ফোসকা উঠবে।’
পরিবার হতবাক। এ যেন ওমরের কথারই পুনরাবৃত্তি!
কথা সত্যি হলো। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে পাশের বাড়ির ছেলে মলিতের গায়ে ফুসকুড়ি বের হলো। ঘা হয়ে পচতে শুরু করল। সে ঘরবন্দি হয়ে পড়ল। গ্রামের লোকজনের মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল-‘চুরি প্রমাণিত।’
গ্রামে উত্তেজনা চরমে উঠল। সিদ্ধান্ত হলো, আগামী বাদজুমা মসজিদে সালিশ বসবে। মোড়ল নিজেই ঘোষণা করলেন।
কিন্তু এই সময় নাটকীয় ঘটনা ঘটল। মলিতের চাচা মনা শেখ ভাতিজাকে গোপনে ডেকে নিলেন। গলা গম্ভীর করে বললেন,
‘বল, মলিত, গয়না কি তুই নিয়েছিস?’
মলিত কেঁদে স্বীকার করল, ‘হ্যাঁ চাচা। রাগ কইর না।’ তারপর খাটের তলা থেকে সোনার অলঙ্কার বের করে দিল।
মনা শেখ হকচকিয়ে গেলেন। ভিতরে ভিতরে আতঙ্ক আর রাগে ফুঁসতে লাগলেন।
যদি সালিশে ধরা পড়ে, সোনা ফেরত দিতে হবে, সঙ্গে জরিমানাও। উত্তেজনায় বারবার সিগারেট ধরালেন, উঠানে এদিক ওদিক পায়চারি করতে লাগলেন।
হঠাৎই ভাতিজাকে উঠানে দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। কলস হাতে তুলে নিয়ে মাথায় আঘাত করলেন। কলস ভেঙে গেল, মলিতের মাথা থেকে রক্ত ঝরতে লাগল।
মলিত আর্তনাদ করে চিৎকার করল, ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ তার মা কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
মুহূর্তেই গ্রামে খবর ছড়িয়ে গেল-‘আনসার শিকদার মলিতকে মেরেছে!’
এটাই গ্রামের স্বভাব। আসল ঘটনা চাপা পড়ে যায়, গুজবই সত্য হয়ে ওঠে।
আনসার শিকদারের পরিবার দিশাহারা। অলঙ্কার ফেরত চাওয়ার সাহস হারিয়ে ফেলল। সালিশে গেলে যদি হত্যা মামলায় জড়িয়ে পড়ে? অবস্থা এমন হলো, পরদিন জুমার নামাজের পর কোনো সালিশই আর বসল না।
আনসারের পরিবার ভয়ে ভয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গেল। অলঙ্কার পাওয়া হলো না।
গ্রামে আজও লোকজন বলে-তেঁতুলতলার সেই ঘটনার কথা। চোর ধরা পড়ল, অলঙ্কারও মিলল, কিন্তু গুজব, কুসংস্কার আর শত্রুতার আগুনে প্রকৃত সত্য চাপা পড়ে গেল।
অলঙ্কার চুরি থেকে শুরু হওয়া কাহিনি শেষ হলো রক্ত, বিভ্রান্তি আর ভয়ের মধ্যে।
তেঁতুলতলার মানুষ আজও বোঝেনি-চোরটা আসলে মলিত, না তাদের নিজেদের অন্ধবিশ্বাস?