বাংলাদেশের ডেনিম শিল্পের টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম হলো ‘বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপো’। ‘ব্লু নিউ ওয়ার্ল্ড’ ভিশনের আলোকে এই প্রদর্শনীর মূল লক্ষ্য হলো উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই ডেনিম শিল্প গড়ে তোলা।
বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের আয়োজনে দুই দিনব্যাপী এই আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে ৭টি দেশের ৪৫টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছে। অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বাধুনিক ডেনিম কাপড়, উদ্ভাবনী পণ্য, সরঞ্জাম, রাসায়নিক দ্রব্য, যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তি প্রদর্শন করছে।
ডেনিম এক্সপোতে দুইটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা ডেনিম শিল্পের বিভিন্ন দিক নিয়ে নিজেদের জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। দর্শনার্থীদের জন্য এখানে একটি ট্রেন্ড জোন রয়েছে, যেখানে ডেনিমের নতুন উদ্ভাবন এবং আধুনিক ট্রেন্ড প্রদর্শিত হচ্ছে। পাশাপাশি, প্রদর্শনীতে বাংলাদেশে উৎপাদিত উদ্ভাবনী নকশা ও প্রযুক্তিতে তৈরি ডেনিম পণ্যও প্রদর্শিত হচ্ছে।
দ্বিতীয় দিনে ‘জিএসপি+ এবং এলডিসি উত্তরণের প্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে তৈরি পোশাক শিল্পের প্রস্তুতি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
ড. মোস্তফা আবিদ খান, কম্পোনেন্ট ম্যানেজার, সাসটেইনেবল গ্র্যাজুয়েশন প্রজেক্ট, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়, বলেন, ‘আমরা পোশাক খাতের ওপর অত্যাধিক নির্ভরশীল। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি সফলতার গল্প। ইইউ বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস সুবিধা প্রদানে খুবই আগ্রহী। বাংলাদেশকে ইইউ কর্তৃক নির্ধারিত ডিউ ডিলিজেন্স মানদণ্ড মেনে চলতে হবে।’
এডউইন কোককোক, ফার্স্ট কাউন্সেলর এবং টিম লিডার, গ্রিন ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট, বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল বলেন, ‘টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে ডিউ ডিলিজেন্স একটি গুরত্বপূর্ণ মূল উপাদান। আমরা বাংলাদেশে শ্রম অধিকার এবং পরিবেশগত মানদণ্ডে অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশের জন্য ডিকার্বনাইজেশন একটি অগ্রাধিকারমূলক বিষয়।’
এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ, অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব (বহুপাক্ষিক ও আঞ্চলিক), পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, বলেন, ‘অনেকে বিশ্বাস করেন যে, বাংলাদেশ সব প্রত্যাশা পূরণ করতে সক্ষম হবে। কিন্তু এখানে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমি মনে করি, অন্তর্ভুক্তি এবং স্বচ্ছতা গুরুত্বপূর্ণ। শ্রম অধিকারও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’
মোহাম্মদ সোহেল সাদাত, চেয়ারম্যান, শিন শিন গ্রুপ, বলেন, ‘উৎপাদনের ক্ষেত্রে টেকসইতা ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে। শ্রমিকের অবস্থা উন্নত করার জন্য আমাদের আরও অনেক সুযোগ আছে এবং এটি পরবর্তী স্তরে নিয়ে যেতে হবে। আমি মনে করি, সমস্ত স্টেকহোল্ডারের নিকট শ্রমিকের অবস্থা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করতে হবে। আমাদের শ্রমশক্তিকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। আমাদের উদ্যোক্তা এবং শ্রমিকদেরকেও শেখাতে হবে, কী কী করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে আমরা সামাজিক টেকসইতো অনুশীলন করছি এবং কীভাবে কী করছি সেটি তুলে ধরতে হবে। এ বিষয়ে আমাদের ক্রেতা, ব্র্যান্ড এবং স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে।’
ওলে আর. জাস্টেসেন, সেক্টর কাউন্সেলর, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা, বাংলাদেশে ডেনমার্কের দূতাবাস, বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে আমি তিনটি বিষয়ের ওপর গুরত্ব দেব। সেগুলো হলো শ্রম অধিকার, শ্রম আইন ও পরিদর্শন এবং সরবরাহ চেইনে বিনিয়োগ। কারখানার কর্মস্থলের পরিস্থিতি উন্নত করার জন্য শ্রম পরিদর্শন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সমগ্র অবকাঠামোতে বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা করতে হবে। ডিউ ডিলিজেন্সকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে না দেখে, আমি এটি প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা হিসেবে বিবেচনা করার পরামর্শ দেব।’
প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমান, ডিস্টিঙ্গুইশড ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (CPD), বলেন, ‘বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সফলতার গল্প অব্যাহত থাকবে, আমি এ ব্যাপারে খুবই আশাবাদী। বাংলাদেশ এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) গ্র্যাজুয়েশনের জন্য প্রস্তুত। আমার মনে হয়, আমাদের আসন্ন চ্যালেঞ্জগুলোর কথা চিন্তা করে প্রণোদনাগুলোর পুনর্গঠন করতে হবে। আমার প্রস্তাব হবে যে, ব্র্যান্ড এবং ক্রেতারা আমাদের উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তি স্থানান্তর, শ্রম এবং অন্যান্য মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলার বিষয়ে সহায়তা করবে। আমি মনে করি ব্র্যান্ড এবং ক্রেতারা উদ্যোক্তাদের সাথে একসঙ্গে কাজ করা একটি ভালো ব্যবসায়িক দিক। শ্রমিকদের অধিকার দিতে হবে। এটি মানবাধিকার।’
শাহ রাইদ চৌধুরী, পরিচালক, ইভিন্স গ্রুপ, বলেন, ‘ক্রেতাদের সাথে সম্পর্ক ব্যবসার একটি মৌলিক বিষয়, যেটি আমাদের ভুলে যাওয়া যাবে না। আমরা অটোমেশন-এ বিনিয়োগ করছি। মেশিনের পেছনের মানুষটি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা টিম বিল্ডিং-এ অনেক বিনিয়োগ করছি। দীর্ঘমেয়াদে প্রতিযোগিতামূলক থাকতে আমরা অটোমেশন নিয়ে ভিন্নভাবে চিন্তা করার চেষ্টা করছি।’
জিয়াউর রহমান, আঞ্চলিক কান্ট্রি ম্যানেজার, (বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইথিওপিয়া), এইচএন্ডএম, বলেন, ‘এই শিল্প চার দশকের পুরনো একটি শিল্প। আমাদের সাপ্লাই চেইন শ্রম আইন বিবেচনায় অনেক পিছিয়ে আছে। সচেতনতা যতটুকু হওয়া উচিত, তার থেকে কম। ডিউ ডিলিজেন্সের ব্যাপারে অনেক সরবরাহকারী সম্পূর্ণরূপে সচেতন নয়। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের কমপ্লায়েন্স মেনে চলতে হবে, তা তারা জানে না। আমি মনে করি, আমাদের কাছে মৌলিক রেসিপিটি আছে এবং আমাদের সেখান থেকে শুরু করতে হবে।’
বিডি প্রতিদিন/এমআই