সোমবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

প্রশাসন কি যুগ থেকে পিছিয়ে পড়ছে?

তুষার কণা খোন্দকার

প্রশাসন কি যুগ থেকে পিছিয়ে পড়ছে?

১৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় টেলিভিশনের খবরে দেখলাম পুলিশের এক কনস্টেবল ছিনতাই করতে গিয়ে জনগণের হাতে ধরা পড়ে গণপিটুনির শিকার হয়েছে। ঘটনাস্থল খোদ ঢাকা শহরের কারওয়ান বাজার। ওখানে দিন-রাত মানুষের ঠাসাঠাসি ভিড়। সে কারণে কনস্টেবল সাহেব বোধ হয় তার ছিনতাই পেশায় দক্ষতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত মানুষজন কনস্টেবল সাহেবকে ছিনতাই করার সময় হাতেনাতে ধরে ফেলেছে। তারপর তারা পুলিশের ভাষায়, ‘আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে’। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে তারা ছিনতাইকারীকে মারধর করেছে তবে তাকে জানে মারেনি। কারওয়ান বাজারে ঘটনাস্থলে উপস্থিত মানুষগুলো যারা কনস্টেবল সাহেবকে ছিনতাই করার সময় হাতেনাতে ধরে ফেলেছে তারা বাংলাদেশের পুলিশের মতো আইনের প্রতি অত অশ্রদ্ধাশীল নয়। উপস্থিত জনতা আইনের লোককে ছিনতাই করতে দেখে তাকে ধরে মেরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছে। কারওয়ান বাজারে দা-বঁটির অভাব নেই। লোকজন চাইলেই কনস্টেবল সাহেবকে পুলিশ বাহিনীর ‘ক্রসফায়ারের’ গল্পের মতো ‘ক্রস কোপাকুপি’ গল্পের জন্ম দিতে পারত। কারওয়ান বাজারের জনতা পুলিশের পদাঙ্ক অনুসরণ করেনি বলে জনতাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না। তারা লোকটাকে মারধর করে মেরে ফেলেনি, তাকে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করেছে। জনতা জানত, পুলিশের সদস্য ছিনতাই করেছে সেই ঘটনার বিচার সঠিকভাবে করার জন্য পুলিশ কখনো উদ্যোগী হবে না। মানুষ বিশ্বাস করে, পুলিশ তাদের বাহিনীর সদস্য ছিনতাইকারীকে বিনা ওজরে থানা থেকে ছেড়ে দেবে। হয়তো এ ছিনতাইকারী বহাল তবিয়তে বাকি জীবন আইন রক্ষকের চাকরিতে বহাল থাকবে। বাকি জীবন লোকটি জনগণের কষ্টের টাকা থেকে মাসের শেষে বেতন ভাতা পাবে এবং জনগণের টাকায় কেনা ইউনিফর্ম গায়ে চড়িয়ে ছিনতাইয়ের চেয়েও বড় অপকর্ম অবাধে চালিয়ে যাবে। তবুও কারওয়ান বাজারে উপস্থিত মানুষগুলো আইনের লোক কনস্টেবল সাহেবকে শাহবাগ থানা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। কারণ বাঙালির ধৈর্য ধরিত্রির মতো অসীম।

অনেকের মনে প্রশ্ন, নিত্য দিনে অপকর্ম করার জন্য পুলিশ বাহিনীর হাতে কত পদের সুযোগ। তাদের সামনে এত সুযোগ থাকতে কারওয়ান বাজারের মতো অমন ব্যস্ত জায়গায় পুলিশের একজন কনস্টেবল ছিনতাই করার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে দুঃসাহস দেখাতে গেল কেন? আমার মনে হয়, পুলিশ সদস্যদের কোনো অপকর্মের জবাবদিহিতা না থাকায় লোকটি অতি সাহসী হয়ে কারওয়ান বাজারের ভিড়ের মধ্যে ছিনতাই করেছে। পুলিশ সদস্যের এমন ঔদ্ধত্যের উৎস খোঁজার জন্য দূরে যাওয়ার দরকার নেই। আপনারা যারা নিয়মিত কাজের জন্য কারওয়ান বাজার যান তারা তাদের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দেখুন। কারওয়ান বাজারের রাস্তার কোনা থেকে সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করতে গেলে দেখবেন অল্প বয়সী কোনো ছেলে এসে অটোরিকশা ড্রাইভারের কাছে ১০ টাকা দাবি করবে। অটোরিকশা ড্রাইভার চরম বিরাগের সঙ্গে ছেলেটির হাতে ১০ টাকা তুলে দিয়ে চাঁদা আদায়কারী ছেলেটিকে নয় বরং পুলিশকে গালাগাল করবে। অটোরিকশা ড্রাইভার জানে চাঁদা আদায়কারী ছেলেটি উছিলা মাত্র। ওর পিছনে পুলিশের কড়া নজরদারি আছে। প্রতিটি অটোরিকশা থেকে ১০ টাকা করে আদায় করে সারা দিনে ওখানে কত টাকা আয় হয় আমি জানি না; তবে আদায়ের অঙ্ক ছোট হবে না বলেই আমার বিশ্বাস। ছেলেটির পাশে দাঁড়িয়ে পুলিশ নিয়মিত দায়িত্ব পালন করে। হয়তো পুলিশ চাঁদা আদায়কারী ছেলেটিকে পাহারা দেয়। মাদকাসক্ত ছেলেটি একাই সব টাকা নিয়ে ভেগে গিয়ে হেরোইনের আড্ডায় শামিল হতে পারে এ আশঙ্কায় পুলিশের মন চঞ্চল থাকে। আবার কোনো ড্রাইভার চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে তাকে কীভাবে ‘যথাযথ আইনের আওতায়’ এনে উচিত শিক্ষা দিতে হবে সেদিকেও কর্তব্যরত পুলিশকে মনোযোগ দিতে হয়। ড্রাইভার জানে, সে চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা উদাস চেহারার পুলিশ সদস্যরা আইন প্রয়োগে অতি তত্পর হয়ে উঠবে। ড্রাইভার আসলে চাঁদা আদায়কারী ছেলেটিকে ভয় পায় না। সে চাইলে চাঁদার জন্য হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাড় জিরজিরে মাদকাসক্ত ছেলেটিকে চড় থাপ্পড় মেরে সিধে করে ফেলতে পারে। কিন্তু সে জানে পুলিশ প্রোটেকশন ছাড়া মাদকাসক্ত ছেলেটি সুস্থ সবল একজন ড্রাইভারের কাছে চাঁদা চাওয়ার দুঃসাহস দেখাতে পারত না। পুলিশের আশ্রয় প্রশ্রয়ে থাকা এ ছেলেটিকে চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে ড্রাইভারের জীবনে নরক নেমে আসবে। সারাদিন খাটা খাটনি করে আয় করা কয়টি টাকা পকেটে নিয়ে তার আর সংসারে ফিরে যাওয়া হবে না। চাঁদা দিতে অস্বীকার করার পরিণাম কী হবে বাংলাদেশের মানুষ সেটি হাড়ে হাড্ডিতে জানে।

ঢাকা শহরে রাস্তার ফুটপাথ দখল করে অনেক জায়গায় পুলিশ বক্স তৈরি করা হয়েছে। বক্সগুলো আক্ষরিক অর্থে লখিন্দরের বাসর ঘরের মতো নিশ্ছিদ্র। এ বক্সগুলো কি আইনসঙ্গত অনুমোদন নিয়ে তৈরি করা হয়েছে? ওখানে কী হয় তার বর্ণনা সেদিন এক পথশিশুর মুখে জানতে পারলাম। পুলিশের বক্সগুলো বারবার চোখে পড়ায় ওগুলোর ব্যবহার সম্পর্কে আমার খুব কৌতূহল। কৌতূহল মেটানোর জন্য আমি বক্সের পাশে বসবাসকারী এক পথশিশুকে নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি জান, এই বাসাটা কার? এই ঘরটাতে কে থাকে?’ আমার অজ্ঞতা দেখে ছেলেটি খুব এক চোট হেসে নিয়ে বলল, ‘এইটা কারও বাসাও না কারও ঘরও না। এইটার নাম পুলিশ বক্স। এই পথ দিয়া যেই সব গাড়ি যায় সেই সব গাড়ির ড্রাইভার পুলিশরে টাকা দিতে না চাইলে পুলিশ স্যারেরা তারে এই ঘরে আটক করে আচ্ছামতো ছিল দেয়।’ পথশিশুটি যা জানে আমার দেশের সরকার কিংবা আমলারা সেটি জানে না। পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা পথের পাশে পুলিশ বক্স নামের খুপরি ঘরগুলো কি দেখেন না? পুলিশ বক্সগুলোর ব্যবহার সম্পর্কে কি তাদের কোনো কৌতূহল হয় না? তারা নিজেরা কিছু না দেখতে পেলে বক্সগুলোর নিকটতম প্রতিবেশী কোনো পথশিশুকে প্রশ্ন করে সত্যটা জেনে নিতে পারেন।

আমাদের চোখের সামনে অসংখ্য অনাচার হামেশা ঘটতে দেখে মনে হয় অনাচার দূর করা যাদের দায়িত্ব তারা কাজটি সঠিকভাবে করছে না। অর্থবিত্তের দিক থেকে বাংলাদেশ আর গরিব দেশ নয়। প্রত্যন্ত গ্রামেও মানুষের আয়-রুজি অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু সুশাসনের অভাবে জনজীবনে স্বস্তির খুব অভাব। নিকট ভবিষ্যতে অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে এমন লক্ষণ দৃশ্যমান হচ্ছে না। সঠিক নীতি নির্ধারণের গাফিলতি থেকেই কি দেশ থেকে বিশৃঙ্খলা দূর হচ্ছে না? প্রতিদিন মানুষকে যেসব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় তার প্রথমটি জীবন এবং সম্পদের নিরাপত্তা। এটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর হাতে। তারা তাদের দায়িত্ব পালনে কতখানি সক্ষম সেটার সন্ধান না মিললেও তারা তাদের দায়িত্ব পালনে কতখানি অপারগ সেটা বোঝার জন্য মানুষকে মোটেও বেগ পেতে হয় না। অসুখ-বিসুখে দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকলে মানুষ নিরাপদবোধ করে। অথচ স্বাস্থ্য বিভাগের জীর্ণ দশার দিকে চেয়ে দেখুন। স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্গতির খবর ছাড়া প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা যেন পূর্ণতা পায় না। শিক্ষা বিভাগের দিকে চেয়ে দেখুন। এক দেশে কত পদের শিক্ষাব্যবস্থা। কত অসংখ্য শিশু সারাদিন চাঁদার বই হাতে রাস্তায় রাস্তায় দৌড়াচ্ছে। চাঁদা তুলে বেড়ানো এ শিশুদের ভবিষ্যৎ কী? মাদ্রাসা এতিমখানার জন্য চাঁদা তুলে যাদের দিন কাটে তারা ঝরে পড়া সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের তালিকায় জায়গা পায় না। আসলে কি শিশুগুলো শিক্ষিত হচ্ছে? আমরা জানি, শিশুগুলো শিক্ষিত হচ্ছে না। পথে পথে ভিক্ষা করেই ওদের জীবন কেটে যাবে। শিক্ষিত হয়ে তারা কোনোদিন অন্যদের সঙ্গে যোগ্যতার প্রতিযোগিতায় শামিল হতে পারবে না। কিন্তু ওদের দুরবস্থা দূর করার কোনো পরিকল্পনা চোখে পড়ছে না।

চোখের সামনে ঘটতে থাকা দুই একটি ঘটনার কথা বললাম। সব কথা বলতে গেলে এ তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। আমরা জানি, সমাজের সর্ব অঙ্গে ব্যথা ওষুধ দিব কোথা? দুর্গতির তালিকা দীর্ঘ না করে বরং সমস্যা সমাধানের কথা ভাবা এখন অনেক সহজ। আমাদের আর্থিক দুর্গতি দূর হওয়ার পরে এখন আমরা সুশাসন পাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছি। কিন্তু কে দেবে সুশাসন? ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে যারা ভর করে আছেন তারা কি সুশাসনের জন্য সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়নের যোগ্যতা রাখেন? আমি বিশ্বাস করি দেশ চালানোর জন্য কৌশলগত নীতিনির্ধারণ করার সক্ষমতার গুরুতর অভাব দেখা দিয়েছে। দেশ চালানোর নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের। আমাদের রাজনীতিবিদেরা নীতি নির্ধারণের কাজে দক্ষ নয় এটি প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগে জনগণের সামনে তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মন্ত্রীদের সামনে আমলারা যে কাগজ ফেলে দেয় মন্ত্রীরা না পড়ে, না বুঝে সেটি সই করেন। তাহলে সব কিছু জানা বোঝার দায়িত্ব গিয়ে বর্তায় আমলাদের উপরে, কারণ মন্ত্রীর স্বাক্ষরের জন্য দলিলটি তারাই তৈরি করছেন। নীতি নির্ধারণের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ যারা করছেন সেই আমলারা কি কৌশলগত নীতি নির্ধারণের জন্য নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তুলেছেন? অবস্থাদৃষ্টে তেমনটি মনে হচ্ছে না। সুশাসনের অভাবে জনজীবনে দুর্গতি ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জনগণের চাহিদা পূরণের প্রাতিষ্ঠানিক ধারাবাহিক চেষ্টা জনগণ দেখতে পাচ্ছে না। প্রশাসন কি নতুন জেনারেশনের উন্নয়নের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। সে জন্যই কি তারা যুগের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না? লোকে বলে, ডিজিটাল বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা কম্পিউটারকে উন্নতমানের টাইপ মেশিন মনে করে। এটি সত্য হলে বুঝতে হবে বাংলাদেশ আজও কেরানি শাসনে বাঁধা। দেশের নতুন জেনারেশন কৃষি এবং শিল্পে যতই বিপ্লব করুক তার সুফল আমরা ভোগ করতে পারব না। কেরানি প্রশাসন আমাদের শ্রম ঘামের সুফল নস্যাৎ করে দেবে। আমরা সরকারের খাতে খাতে অঢেল টাকা ঢালব কিন্তু বিনিময়ে শুধু দুর্ভোগ ভোগ করতে থাকব। সুশাসন আমাদের স্বপ্নে রয়ে যাবে, বাস্তব জীবনে দুঃস্বপ্ন আমাদের নিত্য সাথী। সুশাসন কোনো স্বর্গীয় মেওয়া নয় যে সেটি আসমান থেকে পাওয়া যাবে। প্রচলিত ব্যবস্থায় প্রশাসনকে গতিশীল করা না গেলে সরকারকে বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধান করতে হবে। তা না হলে সুশাসনের অভাবে আমরা যে তিমিরে আছি সেই তিমিরেই রয়ে যাব।

     লেখক : কথাসাহিত্যিক

সর্বশেষ খবর