শুক্রবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

আখিরাতের সওদা সেরে নিন দুনিয়ায়

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

আখিরাতের সওদা সেরে নিন দুনিয়ায়

প্রায় মানুষই একটি বিষয় নিয়ে খুব সন্দেহে থাকে। কখনো কখনো মুখ ফুটে বলেও ফেলে। আমি এত ভালো মানুষ। কখনো কাউকে ঠকাই না। কারও কিছু মেরে খাই না। জানা মতে কাউকে কোনো কষ্টও দিই না। তাহলে আমার জীবনে কেন এমন দুঃখ নদী বয়ে যাচ্ছে? হে আল্লাহ! তোমার এ কেমন বিচার! তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না? আমার এত এত ইবাদত-বন্দেগির প্রতিদানে তুমি আমায় শুধু কষ্টই দিচ্ছো। অথচ অমুকে কত জঘন্য মানুষ। সুদ-ঘুষ, জেনা-ধর্ষণ, জুলুম হেন অপরাধ নেই যা সে করছে না। অথচ তার কোনো অভাব নেই। অশান্তি নেই। দুঃখ-কষ্টের বৃষ্টি ঝরে না তার জীবনে। তাহলে কি সে-ই তোমার বড় আপন?

এ ভাবনা ভাবে না এমন মানুষ বিস্তর। বরং, কোরআন বলছে, মানুষমাত্রই এমন ভাবনা ভেবে থাকে। এ ধরনের চিন্তা ভুল না সঠিক, তা প্রমাণের আগে একজন আল্লাহওয়ার দরবার থেকে ঘুরে আসি। এক ভক্ত ঠিক এ কথাগুলোই বললেন পীর সাহেবকে। ‘বাবা! আল্লাহ আমার সঙ্গে এ কী আচরণ করছেন! আমি সত্যিই তাঁর অনুগত বান্দা। তাহলে আমাকে কেন কষ্ট দিচ্ছেন তিনি? আর ওই বদ এবং সুদি ব্যবসায়ীর অবস্থা দেখুন। সুখ তার শরীর বেয়ে পড়ে...।’

ভক্তের অভিযোগ মনোযোগ দিয়ে শুনলেন পীর সাহেব। এবার মুচকি হেসে ভক্তের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাবা! তুমি যা বলেছ ঠিকই বলেছ। আল্লাহ তোমার সঙ্গে খুব অন্যায় করে ফেলেছেন। তুমি চাইলে আমি আল্লাহকে বলে ওই বদ ও লম্পটের জায়গায় তোমাকে দিয়ে আর ওই লম্পটকে তোমার জায়গায় রেখে আল্লাহর ভক্ত বানিয়ে দিতে পারি। বল তোমার কী ইচ্ছা?’

ভক্তের যেন চমক ভেঙে গেল। সঙ্গে সঙ্গে পীর সাহেবের হাতে চুমু খেয়ে কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘বাবা! ওই রকম ঐশ্বর্যের কোনো প্রয়োজন নেই যা মানুষকে আল্লাহর কথা ভুলিয়ে দেয়। তার চেয়ে বরং আমার দুঃখের জীবনই ভালো। প্রতি মুহূর্তেই আল্লাহর কথা স্মরণ হয়। কষ্টে পড়লেই আল্লাহকে ডাকতে পারি। আমার আর কিছু লাগবে না। এ কষ্টই আমার সাত রাজার ধন।’

এবার একই প্রশ্নের জবাবে আল্লাহর আরেক অলি তার ভক্তকে কী বলেছেন শুনুন। ‘বাবা! বল তো দেখি, তুমি যখন ইমান এনেছে, তখন কি আল্লাহর সঙ্গে এমন কোনো চুক্তি হয়েছে যে, তুমি তার ইবাদত করবে আর তিনি তোমাকে সুখের সাগরে ভাসিয়ে রাখবেন।’ ভক্ত বলল, ‘না হুজুর। এ রকম কোনো চুক্তি আল্লাহর সঙ্গে হয়নি।’

পীর সাহেব আবার বললেন, ‘বরং এমন চুক্তি হয়েছে, ইমানের কারণে তোমার জীবনে বিপদের ওপর বিপদ আসবে। বিনিময়ে তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে। তো সে রকমটাই যেহেতু হচ্ছে, তার মানে ইমানের পথে তুমি পরীক্ষা দিচ্ছো। তুমি এখনো হিদায়াতের পথেই আছো। এতে যদি তুমি সন্তুষ্ট না হও, তবে ঠিক আছে, গোমরাহির পথেই হেঁটে যাও। কিছু সময়ের জন্য না হয় আনন্দে-উৎসবে কাটাও। আর অনন্তকালের জন্য জাহান্নামের প্রস্তুতি নিতে থাকো।’

কোরআন কী বলছে আমাদের এমন চিন্তা সম্পর্কে? কোরআন বলছে, সুখ-দুঃখ, সচ্ছল-অভাব, সুস্থ-অসুস্থ মানুষ যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন তা কেবল মানুষের পরীক্ষার জন্যই। কেউ যদি ভেবে নেয় সম্পদের প্রাচুর্য মানেই আল্লাহর সন্তুষ্টি এটা যেমন ভুল, আবার দুঃখ-কষ্ট মানেই আল্লাহর অসন্তুষ্টি এটাও চরম ভুল। ‘ফা আম্মাল ইনসানু ইজা মাবতালাহু রব্বুহু ফা আকরামাহু ওয়া না’আমাহ। ফায়াকুলু রব্বি আকরমান’। ‘মানুষকে যখন আমি পরীক্ষা করতে অর্থবিত্ত ও সম্মান-মর্যাদা দিয়ে থাকি তখন সে খুবই প্রফুল্ল হয়। আনন্দচিত্তে বলে ওঠে, আমার প্রভু আমার ওপর খুবই সন্তুষ্ট হয়েছেন। আমাকে মর্যাদার আসন দান করেছেন।’

‘ওয়া আম্মা ইজা মাবতালাহু রব্বুহু ফাকাদার আলাইহি রিজকাহ। ফায়াকুলু রব্বি আহানান’। ‘আর আমি যখন তাকে ওই পরীক্ষার জন্যই রিজিক সংকুচিত করে দিই, তখন সে আর খুশি হতে পারে না। মনঃকষ্টে সে অভিযোগের সুরে বলে, আমার প্রভু আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তিনি আমাকে অপমান করেছেন।’

‘তোমাদের এ দুই দলের কারও ধারণাই সঠিক নয়। সম্পদের প্রাচুর্য যেমন আমার সন্তুষ্টি নয় পরীক্ষার জন্য তেমনি সম্পদের কমতিও আমার অসন্তুষ্টি নয়, পরীক্ষা মাত্র।’

তাই আসুন! আমরা যে অবস্থাতেই থাকি, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি। সবর অবলম্বন করি। দুই দিনের এ দুনিয়া থেকে আখিরাতের সদাই কিনে পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করি। আল্লাহর হাবিব (সা.) বলেছেন, ‘আদ-দুনইয়াউ মাজরাতুল আখিরাহ’। ‘এ দুনিয়া হলো আখিরাতের বাজার।’ তো আল্লাহ আমাদের বাজারে পাঠিয়েছেন। তিনি অপেক্ষায় আছেন আমরা বাজার থেকে কী নিয়ে যাই তা দেখার জন্য। আমাদের বাজার যেমন হবে, আমাদের পরবর্তী খাবার-আবাসনও ঠিক সে অনুযায়ীই সাজানো হবে। কোনো গোলাম যখন বাজারে যায় তখন কিন্তু মালিক তার ওপর খবরদারি করে না। কিন্তু বাজার শেষে সে যদি ভালো সদাই না কিনে তখনই শুরু হয় অসন্তুষ্টি বর্ষণ। আবার যদি ভালো ভালো বাজার করে আনে একইভাবে তার ওপর বর্ষিত হয় প্রশংসার ঝরনাধারা।

হে আমার মুমিন ভাই! আমরা এখন আখিরাতের বাজারে আছি। আমাদের সময় কম, সদাই কিনতে হবে বেশি। তাই আসুন! আমরা আল্লাহর শেখানো নিয়মেই বাজার করি। তার বলে দেওয়া ফর্দ— কোরআন দেখেই সদাই কিনি। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে দুনিয়ার পরীক্ষায় পাস করার তাওফিক দিন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসিসরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব   www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর