বুধবার, ১৯ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

স্থানীয় সরকারের বেতন কেন্দ্রীয় সরকার কেন দেবে!

মোশাররফ হোসেন মুসা

স্থানীয় সরকারের বেতন কেন্দ্রীয় সরকার কেন দেবে!

এ দেশে স্বায়ত্তশাসিত বহু প্রতিষ্ঠান আছে যারা অফিস ভাড়া, আপ্যায়ন ব্যয়, কর্মচারীর বেতন-ভাতা ইত্যাদি নিজেদের অর্থে পরিশোধ করে। যেমন বিভিন্ন ক্লাব, পার্টি অফিস, প্রেস ক্লাব, ব্যবসায়ী সমিতি ইত্যাদির নাম উল্লেখ করা যায়। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা স্বায়ত্তশাসনের দাবি করেন; কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নিজেদের বেতন বৃদ্ধিসহ কর্মচারীদের বেতন প্রদানেরও দাবি তোলেন। এতে প্রতীয়মান হয়, সরকার কী, স্বায়ত্তশাসন কী, আয়-ব্যয় কী, উন্নয়ন কীভাবে হয় ইত্যাদি তাদের ভাবনায় নেই। বাংলাদেশে গ্রামীণ ভিত্তিমূলে (ব্যাসিক ইউনিট) ইউনিয়ন পরিষদ ও নগরীয় ভিত্তিমূলে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন রয়েছে। পত্রিকাসূত্রে জানা গেছে, ৩২৭টি পৌরসভার মধ্যে মাত্র ৪৯টি পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন নিয়মিত দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯-এর ৫ ধারায় পৌরসভাকে সরকারের প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আইনের ৯১ (৪ এর ক) ধারায় বলা আছে, পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা নিজস্ব তহবিল থেকে দিতে হবে। তবে স্থানীয় সরকারের আরেক প্রশাসনিক ইউনিট ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষেত্রে পরিষদের আয় থেকে ২৫ শতাংশ অর্থ জোগান দেওয়ার বিধান রয়েছে। সরকারের বরাদ্দ থেকে বাকি ৭৫ শতাংশ প্রদান করা হয়। একই ধরনের প্রশাসনিক ইউনিট হলেও বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে বৈষম্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পৌর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অ্যাসোসিয়েশন (প্রথম আলো, ১৯ এপ্রিল, ২০১৯)। স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯-এ পৌরসভা প্রতিষ্ঠার অধ্যায়ে বলা আছে, একটি পল্লী এলাকাকে পৌরসভা ঘোষণার আগে চারটি শর্ত পূরণ করতে হবে, তথা (ক) তিন-চতুর্থাংশ ব্যক্তি অকৃষি পেশায় নিয়োজিত থাকতে হবে; (খ) শতকরা ৩৩ ভাগ ভূমি অকৃষি প্রকৃতির হতে হবে; (গ) জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে ১ হাজার ৫০০ হতে হবে। বাস্তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় বহু গ্রামীণ এলাকাকে পৌরসভা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। পৌরসভার মেয়ররা অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যক্তিদের মাস্টার রোলে নিয়োগ দিয়ে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেন। তারা তথাকথিত জনপ্রিয়তা রক্ষার নামে নিজস্ব আয় বৃদ্ধির চেষ্টাও করেন না। স্থানীয় সরকারের ব্যাসিক ইউনিটগুলোকে বাজেট গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া আছে। বাজেটে নিজস্ব আয়ের বিভিন্ন খাত, সরকারের অনুদান, বিভিন্ন প্রকল্প খাতে ব্যয়, কর্মচারীদের বেতন কীভাবে পরিশোধ করা হবে ইত্যাদি উল্লেখসহ আয় ও ব্যয়ের বিভিন্ন খাতের নাম উল্লেখ থাকে। স্থানীয় সরকারের ব্যাসিক ইউনিটগুলোকে হোল্ডিং কর আদায়, ব্যবসায়িক লাইসেন্স ফি আদায়, যানবাহন ফি আদায়সহ প্রয়োজনে বিভিন্ন খাত সৃষ্টির ক্ষমতা দেওয়া আছে। জনগণও ট্যাক্স দিতে আগ্রহী। তাদের বক্তব্য, তারা ট্যাক্স দেন কিন্তু কাক্সিক্ষত সেবা পান না। অথচ বহু পৌরসভায় প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ায় তারা কর্ম না করেই বেতন নেন। আবার পৌরসভায় শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিযুক্ত থাকলেও ইউনিয়ন পরিষদে মাত্র একজন কর্মচারী (ইউপি সচিব) রয়েছেন। ফলে একজন ইউপি সচিবের পক্ষে বিভিন্ন সভা পরিচালনাসহ পরিষদের যাবতীয় কাগজপত্র সংরক্ষণ করা ভীষণ কষ্টকর হয়ে পড়ে। দেশে ৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদে ৪ হাজার ৫৭১ জন সচিব, ৪৫ হাজার ৭১০ জন গ্রামপুলিশ রয়েছেন। বর্তমানে পৌরসভা কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন, ইউনিয়ন পরিষদ সচিব সমিতি এবং গ্রামপুলিশ সমিতি সবাই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তাদের শতভাগ বেতন প্রদানের জন্য দাবি জানাচ্ছেন। তারা ভুলে যান যে, তাদের বেতনের ব্যয়ভার কেন্দ্রীয় সরকার বহন করলে ‘স্থানীয় সরকার’ নামে কোনো প্রতিষ্ঠান থাকে না। স্থানীয় সরকারকে কার্যকরের জন্য সরকার বিভিন্ন সময় হরেকরকম প্রজেক্ট গ্রহণ করে। সর্বশেষ এলজিএসপি (লোকাল গভর্নমেন্ট সাপোর্ট প্রোগ্রাম) নামে একটি প্রকল্প চালু করা হয়। প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে ২০০৬ সালে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়। বর্তমানে ৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়নে এলজিএসপি-৩ চালু রয়েছে। প্রকল্পের মুখবন্ধে উল্লেখ করা হয়, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের মালিকানা বোধ (ঙহিবৎংযরঢ়) জাগ্রত করাই প্রকল্পটির প্রধান উদ্দেশ্য। সেজন্য এ প্রকল্পের অর্থ দ্বারা প্রতিনিধিদের সম্মানি ভাতা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সেইসঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান উন্নয়নে এ খাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে না বলে উল্লেখ আছে। এলজিএসপির অর্থ ব্যয় করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বিধিমালা থাকায় স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা এলাকার প্রকৃত উন্নয়নের আলোকে নয়, বিধিমালার আলোকে প্রকল্প নেন। ফলে একপর্যায়ে কাগজপত্র সমন্বয় করাই মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মানীষীরা বহু আগেই বলেছেন, অন্য দেশের সাহায্য নিয়ে একটি দেশ কখনই স্বাবলম্বী হয় না। উদাহরণটি স্থানীয় সরকারের বেলায়ও খাটে। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদানকে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা ‘সরকারি মাল’ হিসেবে ব্যয় করেন। অথচ একটি দেশে সুশাসন আনয়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সেজন্য স্থানীয় সরকারকে স্বশাসন দেওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই। কেউ কেউ দুর্নীতির দোহাই দিয়ে স্থানীয় সরকারকে পরাধীন রাখার পক্ষে। তাদের নিশ্চয়ই জানা রয়েছে, দায়িত্ব দেওয়া ছাড়া দায়িত্ববান ব্যক্তি পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে বিচারপতি হাবিবুর রহমান এক সাক্ষৎকারে বলেছিলেন, ‘সেখানে যাই হোক, তাদেরকে স্বাধীনতা দিয়ে দিতে হবে।’ সেজন্য সিডিএলজি দীর্ঘদিন যাবৎ বলে আসছে, এ দেশে আয়তন, জনঘনত্ব, ভৌগোলিক বাস্তবতা, ইতিহাস-ঐতিহ্য বিবেচনায় নিয়ে দুই ধরনের সরকারব্যবস্থা তথা কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাই বাস্তবায়নযোগ্য। স্থানীয় সরকারের স্তর বিন্যাস করে প্রতিটি ইউনিটকে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিতে হবে। ‘জেলা সরকার’ হবে সর্বোচ্চ ইউনিট। জেলা সরকার এক হাতে নগরীয় সরকারগুলোকে এবং অন্য হাতে গ্রামীণ সরকারগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করবে। স্থানীয় সরকারের আলাদা ক্যাডার সার্ভিসসহ নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা স্থানীয় সরকারকেই বহন করতে হবে। এ পদ্ধতি গ্রহণ করলে ট্যাক্স আহরণসহ সবকিছুই ‘বটম-আপ’ হয়ে পড়বে। তখন স্থানীয় সরকারের কোনো অর্থ সংকট থাকবে না।

                লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক।

                ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর