সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিএনপির শত্রু-মিত্র

মহিউদ্দিন খান মোহন

বিএনপির শত্রু-মিত্র

বিএনপির সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন এমন একজন সাবেক আমলা, একদিন বলছিলেন, ‘বিএনপি অনেক কাজই ভালোভাবে করতে পারে না। তবে একটি কাজ খুব ভালোভাবেই করে, যেটা বাংলাদেশ তো বটেই, পৃথিবীর অন্য কোনো রাজনৈতিক দল অত ভালোভাবে করতে পারে বলে আমার মনে হয় না।’ জিজ্ঞাসা করলাম কোন কাজটি? বললেন, ‘বন্ধুকে শত্রু বানানো’। বয়োজ্যেষ্ঠ ভদ্রলোকের কথা বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চাইলাম। তার কথার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি খুঁজে পেলাম না। বিএনপির অতীত থেকে এ পর্যন্ত ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করলে এর সত্যতা পাওয়া যাবে ইতিহাসের পরতে পরতে। এটা যেন চিরন্তন সত্যে পরিণত হয়েছে- বিএনপির যারা ক্ষতি করতে চাইবে, যারা এ দলটিকে ধ্বংস করতে তৎপর হবে, একসময় তারাই দলের কাছে মূল্যায়িত হবে, সমাদর পাবে। আর যারা দলের বা শীর্ষ নেত্রীর জন্য জীবন বাজি রেখে কাজ করবে, তারা হবে অবহেলিত, উপেক্ষিত। তাহলে কি বিএনপি বা এর মূল নেতৃত্ব শত্রু-মিত্র চিনতে ভুল করেন? কিন্তু সেটাই বা কীভাবে সম্ভব? একটি রাজনৈতিক দল বা তার নেতৃত্ব শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করতে পারবে না বা পারে না, এটা তো বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাহলে কেন এমন হয়? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে অতীতের দিকে দৃষ্টি ফেরাতেই হবে। কয়েকটি ঘটনা থেকেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।

এরশাদের শাসনামলে বিএনপি একাধিকবার ভেঙেছে এবং অনেক নেতা দল ছেড়ে চলে গেছেন। পরে তাদের অনেকেই আবার দলে ফিরে এসেছেন এবং ‘সম্মানীয়’ আসনেই ঠাঁই পেয়েছেন। বর্তমান স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের কথাই ধরুন। বেগম জিয়ার বিশ্বাসভাজন এই নেতা আন্দোলন চলাকালেই হিজরত করলেন জাতীয় পার্টিতে। মন্ত্রী হলেন, প্রধানমন্ত্রী, উপরাষ্ট্রপতি সবই হলেন। তারপর আবার বিএনপিতে ফিরে এসে একেবারে স্থায়ী কমিটির সদস্য হয়ে গেলেন। সবচেয়ে মজার ঘটনা হলো, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বিএনপির বিরুদ্ধে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হলেন। আবার ওই একই নির্বাচনে খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেওয়া একটি আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। এরপর ২০০১ সালে হলেন বিএনপি সরকারের আইনমন্ত্রী। শুধু তাই নয়, বিএনপিতে তিনি এতটাই ইমপোর্ট্যান্ট হয়ে উঠলেন যে, ২০০৮-এ নবম সংসদ নির্বাচনে নিজের আসনে হেরে যাওয়ার পর খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেওয়া বগুড়ার একটি আসনে তাকেই জিতিয়ে আনতে হয়েছিল! আর তাতে বঞ্চিত করা হয়েছিল বগুড়ার নেতাদের। কে এম ওবায়দুর রহমান বিএনপির মহাসচিব ছিলেন। তিনিও এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় মোচড় দিয়েছিলেন। টের পেয়ে বেগম জিয়া তাকে করলেন বহিষ্কার। তিনি নিজেই গড়লেন জনতা দল নামে একটি দল। সেই দলের ব্যানারে ১৯৯১-এর সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে শোচনীয় পরাজয়বরণ করে বোধকরি আত্মোপলব্ধিতে সক্ষম হলেন। আবার ফিরে এলেন বিএনপিতে। ২০০১ সালে নির্বাচিত হলেন এমপি। সেই সঙ্গে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটিতেও জায়গা করে নিলেন। এ রকম উদাহরণ ভূরি ভূরি আছে। কেউ হয়তো বলতে পারেন, এতে উনাদের দোষ কোথায়? দল তাদের নিয়েছে, তাই তারা গিয়েছেন। অকাট্য যুক্তি। অস্বীকার করার উপায় নেই। আর বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আলোচনাও করা হচ্ছে বিএনপি নামক দলটির নেতৃত্বের দূরদৃষ্টির অভাব ও অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে। যেগুলো প্রমাণ করে দলটি সত্যিকার অর্থেই শত্রু-মিত্র নির্ধারণে ভুল করে।

নিকট অতীতে কী দেখা গেল? ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর বিএনপি পড়েছিল মহাসংকটে। মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া জরুরি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় অবতীর্ণ হলেন রাজনীতি থেকে খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার এক অপরিণামদর্শী খেলায়। ঘোষণা করলেন কথিত সংস্কার প্রস্তাব। তার সঙ্গে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে শামিল হলেন বহু বিএনপি নেতা। বেগম জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর তাদের তৎপরতা আরও গতিশীল হলো। কারাগারে যাওয়ার আগে খালেদা জিয়া দলের গঠনতন্ত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও যুগ্মমহাসচিব আশরাফ হোসেনকে দলের সব পদ-পদবি ও প্রাথমিক সদস্য থেকে বহিষ্কার করেন। মহাসচিবের দায়িত্ব দেন স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে। তিনি সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিশ্বস্ত একজন সেনাপতির ন্যায় দলকে নেতৃত্ব দেন, তৃণমূল নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখেন। ২০০৮ সালের ৩০ অক্টোবর দলের প্রবীণ নেতা এম সাইফুর রহমানের বাসায় সরকারের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের একটি সভা; যেখানে জনা চারেক নেতা উপস্থিত ছিলেন। সেখান থেকে ঘোষণা করা হয়, অসুস্থতার কারণে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি এবং তদস্থলে মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদকে অস্থায়ী মহাসচিব হিসেবে নিযুক্ত করা হলো। যদিও বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের কাছে ওই ঘোষণা মোটেই সমর্থন লাভ করেনি। ফলে সরকার ও বিএনপির সংস্কারপন্থিদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। ওয়ান-ইলেভেনের  সময় বিএনপি বা বেগম জিয়ার বিবৃতি স্বাক্ষর করার লোক ছিল না। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তার প্রেস উইংয়ের এক কর্মকর্তা ভয়ঙ্কর ঝুঁকি সত্ত্বেও সে কাজটি করেছেন। কিন্তু অবাক কা- হলো, ওয়ান-ইলেভেনের কালো মেঘ সরে যাওয়ার পর যেই সুদিনের সূর্য মুখ দেখল, সেই লোকটি হারিয়ে গেল। দল থেকে সে ছিটকে পড়ল! তাকে আর কাছেই ঘেঁষতে দেওয়া হলো না বিএনপির! দলের জন্য, নেত্রীর জন্য ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার এ ‘অভিনব পুরস্কারে’ হতাশ তিনি অবশেষে দলের সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলেছেন। পক্ষান্তরে খালেদা জিয়াকে দল ও রাজনীতি থেকে মাইনাস করার কুশীলবদের অনেকেই সাদর অভ্যর্থনা পেয়েছেন দলে। যে মেজর হাফিজ অস্থায়ী মহাসচিব হয়েছিলেন, তিনি এখন দলের ভাইস চেয়ারম্যান! এমনিভাবে ওয়ান-ইলেভেনের দুঃসময়ে খালেদা জিয়াকে ফেলে চলে যাওয়া অনেকেই এখন দলের মধ্যে পাকাপোক্ত আসন নিয়ে বসে গেছেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহবুবুর রহমান, জহিরউদ্দিন স্বপন, মফিকুল হাসান তৃপ্তিদের মতো অনেকেই ফিরে এসে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন দলের ভিতর।

ওয়ান-ইলেভেনের সংকটের দিনগুলিতে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহর সাহসী ভূমিকার কথা কে না জানে? কিন্তু বিপদ কেটে যাওয়ার পর তারা দলে যে অবজ্ঞা-অবহেলার শিকার হয়েছেন তা দুঃখজনক। ২০০৯ সালে বিএনপির পঞ্চম কাউন্সিলে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে চরম অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হয়। আর তা দলের চেয়ারপারসনের জ্ঞাতসারেই। সিদ্ধান্ত ছিল কাউন্সিল অধিবেশনেই তাকে মহাসচিব নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে। কিন্তু কতিপয় ক্রীড়নকের কারসাজিতে দুপুরের বিরতির পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। তারেক রহমানকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হলেও খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিব নির্বাচিত করা হলো না। বিমর্ষবদনেই সেদিন সন্ধ্যায় খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে সম্মেলনস্থল ত্যাগ করতে দেখেছি। গাড়িতে ওঠার সময় আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘মোহন, এই দলের সামনে ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে।’ বিস্মিত হওয়ার আরও বাকি ছিল। সম্মেলনের কয়েকদিন পর দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও সিনিয়র যুগ্মমহাসচিবের নাম ঘোষণা করলেন চেয়ারপারসনের এক স্বঘোষিত ব্যক্তিগত কর্মকর্তা। মহাসচিবের নাম কোথায় -এ প্রশ্নের জবাবে তিনি সাংবাদিকদের জানালেন, ‘নতুন মহাসচিব নিযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান মহাসচিবই দায়িত্ব পালন করবেন।’ রাগে অপমানে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন দল থেকে ইস্তফা দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। তার ঘনিষ্ঠ কিছু শুভানুধ্যায়ী অনেক অনুনয়-বিনয় করে তাকে ওই সিদ্ধান্ত থেকে বিরত রাখতে পেরেছিলেন। এরপর বছরখানেক বেঁচেছিলেন খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। তবে সেদিনের সেই অপমান তিনি ভুলতে পারেননি। মারা যাওয়ার মাসখানেক আগে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম তার আরমানিটোলার বাসায়। বিছানায় শায়িত তিনি বলেছিলেন অনেক কথা। তার মধ্যে একটি কথা এখনো আমার খুব মনে পড়ে। লাঞ্ছনা-বঞ্চনার কথা বলার একপর্যায়ে তিনি বললেন, ‘ম্যাডামের চারপাশে যেসব জুটেছে তারা উনাকে নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। আমি হয়তো মরে যাব। তোমরা দেখ, এমন একদিন আসবে, যেদিন তার ঘোরতর বিপদে কেউ এগিয়ে আসবে না।’ আজ বেগম জিয়া জেলে। তার মুক্তির আন্দোলন কেবলই দলের কতিপয় নেতার মুখের বুলি। কেউ তো রাজপথে দাঁড়িয়ে তার মুক্তির দাবিতে আওয়াজ তুলছে না। জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারছে না! তাহলে কি খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন সেদিন যথার্থই বলেছিলেন?

একটি রাজনৈতিক দলকে তার অভীষ্টে পৌঁছতে হলে শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করতে হয় আগে। শত্রু সব সময় বাইরে থাকে না, ভিতরেও থাকে। বাইরের শত্রু চিনতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না। কিন্তু ভিতরের শত্রু চেনা মুশকিল। কেননা এরা অবস্থান করে বন্ধুবেশে। যারা তাদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারে, তারা রক্ষা পায়। আর যারা সেই শত্রুদের পরমাত্মীয় ভেবে ঘরে ঠাঁই দেয়, তারাই মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি হয়। ঘুণপোকা যেমন ছোট্ট ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে কাঠকে ভঙ্গুর করে দেয়, এরাও তেমনি ভিতর থেকে একটি দলের শক্তি নিঃশেষ করে দিতে থাকে। ফলে দলটি ক্রমে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। আজ বিএনপির যে অবস্থা তা কি অনুরূপ নয়? দলটি এখন বন্ধু খুঁজতে দেশের বাইরের ছোটাছুটি করছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক তারই প্রমাণ। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বিদেশিদের সঙ্গে বৈঠক করাকে কেউই সমীচীন মনে করেন না। লক্ষণীয় হলো, বিএনপি ওই বৈঠকে বাংলাদেশে কর্মরত সব হাইকমিশন বা দূতাবাসের কর্মকর্তাকে দাওয়াত দিলেও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউএনডিপিসহ ৭টি দেশ ও সংস্থার বিভিন্ন পর্যায়ের কূটনীতিক উপস্থিত হয়েছিলেন। বাকিরা এলেন না কেন? এতে বোঝা যায় বহির্বিশ্বেও বিএনপির মিত্র বা শুভানুধ্যায়ীর সংখ্যা কমে এসেছে। আর তার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণও আছে। দলটির আন্তর্জাতিক সম্পাদক ও সহসম্পাদকদের তালিকার দিকে তাকালেই বিষয়টি অনুধাবন করা সম্ভব। যারা কখনো কোনো কূটনৈতিক মহলে চলাফেরা বা কথাবার্তা বলেননি, তারাই ওইসব পদে অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন। রাজনীতির ওইসব বালক-বালিকা বিদেশি জাঁদরেল কূটনীতিকদের সামনে অকুণ্ঠ চিত্তে কথা বলতে কতটা সক্ষম, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না।

‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ বলে একটি প্রবাদ বাংলা ভাষায় চালু আছে। এর মর্মার্থ কাউকে ব্যাখ্যা করে বলার দরকার পড়ে না। গত ৪১ বছরে বিএনপি যতবার বিপর্যয়ে পড়েছে, ঘরের শত্রু বিভীষণরাই তার পেছনে কলকাঠি নেড়েছে। শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করতে শীর্ষ নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণেই দলটিতে  দুর্যোগ ফিরে ফিরে আসে। ভবিষ্যতে যে আবারও তেমনটি ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?

             লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর