সোমবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

শেষ হয়ে আসছে মোদির দিন

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

শেষ হয়ে আসছে মোদির দিন

গত লোকসভা ভোটের পর রাহুল গান্ধী সরে যাওয়ার পর থেকে দীর্ঘদিন কংগ্রেসের কোনো সভাপতি ছিল না।  হালে অস্থায়ী সভাপতির দায়িত্ব নিতে একরকম বাধ্য হয়েছেন সোনিয়া গান্ধী। স্বভাবতই তাই সবারই অনুমান ছিল হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্র দুই রাজ্যের বিধানসভা ভোটে একেবারে গোহারা হারবে শতাব্দীপ্রাচীন জাতীয় দলটি। এ মনোভাবের নিশ্চিত প্রতিফলন হিসেবে ভোট-পরবর্তী সবকটি বুথফেরত সমীক্ষাকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বিরাট ঝড় তুলে ওই দুই রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি অথবা এদের জোট ক্ষমতায় ফিরে আসবে। কিন্তু ফল প্রকাশের পর থেকেই যে ইঙ্গিত বোঝা গেল তা সমীক্ষার অনেকটাই উল্টো।

এ দুটি রাজ্যের (মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা) বিধানসভা এবং আরও কয়েকটি রাজ্যের উপনির্বাচনের যে ফল সামনে এসেছে, তা থেকে যা পরিষ্কার হতে শুরু করেছে তা হলো, আগামীতে কংগ্রেসসহ বিরোধীদের ‘আচ্ছে দিন’ এবং বিজেপির দুর্দিন আসতে চলেছে। ফলাফলের গতি-প্রকৃতি দেখে ওয়াকিবহাল মহলের তেমনই ধারণা। দুটি রাজ্যেই যে প্রবণতা সামনে উঠে এসেছে, তা হলো শহরাঞ্চলের ভোটাররা এখনো বিজেপির ওপর কিছুটা আস্থা রাখলেও গ্রামাঞ্চল ও মফস্বলের ভোটাররা বিজেপির ওপর থেকে আস্থা হারাতে শুরু করেছেন। তারই প্রতিফলন হলো লোকসভা ভোটের মাত্রই কয়েক মাস পরে দুটি রাজ্যের বিধানসভা ভোটে একের পর এক আসনে বিজেপি ও সহযোগী দলগুলোর কুপোকাত হওয়ার ঘটনা। রাজনৈতিক মহল মনে করছে, বিজেপির প্রতি বিশ্বাস হারানোর এ প্রবণতা রোখা এখন সম্ভবই নয়, সে ক্ষেত্রে আগামী দিন যে বিজেপির পক্ষে অশনিসংকেত নিয়ে আসছে তা বলাই বাহুল্য। অন্যদিকে বিজেপির বিশ্বাসযোগ্যতা যত হারাবে, যত তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরতে শুরু করবে, ততই উজ্জ্বল দেখাবে কংগ্রেসসহ বিরোধী দলগুলোর ভবিষ্যৎ। মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার নির্বাচনে কংগ্রেসকে বিশেষজ্ঞরা যে ধর্তব্যের মধ্যেই রাখেননি, তার একটা বড় কারণ ছিল কার্যত মাথাহীন হয়ে থাকা দলটির পক্ষে মোদি-অমিত শাহের ধুরন্ধর ছকের মোকাবিলা করা কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে সংশয়। লোকসভা ভোটের পর রাহুল গান্ধী সভাপতির পদ ছেড়েছুড়ে দিয়ে একরকম বিরাগী হয়ে গিয়েছিলেন। বিস্তর টালবাহানার পর দায়িত্ব হাতে নেন সোনিয়া গান্ধী। এ পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের ভোটের প্রস্তুতি যে সেই পর্যায়ের ছিল না তা বলাই বাহুল্য। তা সত্ত্বেও ভোটাররা বিজেপির বিকল্প দল হিসেবে দুটি রাজ্যেই কংগ্রেসসহ বিরোধীদেরই বেছে নিয়েছেন। মহারাষ্ট্রে যেমন কংগ্রেস ও এনসিপির ওপর ভরসা করেছেন ভোটাররা, তেমনই হরিয়ানায় কংগ্রেস ও বিজেপিবিরোধী দলগুলোর শক্তির ওপরই আস্থা রেখেছেন মানুষ। মহারাষ্ট্রে বিজেপি-শিবসেনা জোট (১০৫ ও ৫৬) ১৬১টি আসন পেয়েছে বটে, কিন্তু সে রাজ্যে প্রায় ছন্নছাড়া হয়ে থাকা দুটি দল কংগ্রেস ও এনসিপি পেয়েছে মোট ৯৮টি আসন; যার মধ্যে কংগ্রেসের আসন ৪৪ আর এনসিপির ৫৪। অথচ মহারাষ্ট্রের এই জোটকে কার্যত কোনোরকম হিসাবের মধ্যেই রাখেননি বিশেষজ্ঞরা। মহারাষ্ট্রে সিপিআই(এম) একটি আসন এবং অন্যরা ২৮টি আসন দখল করেছেন। হরিয়ানার ভোটাররা আরও স্পষ্টভাবে বিজেপিকে নস্যাৎ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। ৯০ আসনের বিধানসভায় বিজেপি পেয়েছে ৪০, কংগ্রেস ৩১, ওমপ্রকাশ চৌতালার নাতি দুষ্মন্ত চৌতালার জেজেপি ১০ এবং অন্যদের দখলে গেছে ৯টি আসন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বিজেপির এই দুরবস্থার কারণ হলো তাদের ভ্রান্ত অর্থনীতি। মোদি সরকারের প্রথম ও দ্বিতীয় শাসনামলে অর্থনীতি নিয়ে যা যা এক্সপেরিমেন্ট করার চেষ্টা কেন্দ্রীয় সরকার করেছে, তার সবকটিই যে জনবিরোধী এবং আদতে মানুষ মারার অর্থনীতি, তা ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মানুষের সামনে। মোদির অর্থনীতির নিট ফল হলো গরিব মানুষের গরিবি আরও দ্রুতহারে বাড়তে থাকা এবং বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় হাতের বাইরে চলে যাওয়া। ফলে দুটি রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের কাছেই মোদি-ম্যাজিক, মোদি-চমক, মোদি-ম্যানিয়া বাস্তবে কোনো কাজেই আসেনি। গরিব মানুষের গ্রাসাচ্ছাদনই যেখানে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে নরেন্দ্র মোদি আর অমিত শাহের কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বা গোটা দেশে এনআরসির বাগাড়ম্বর নেহাতই ফিকে বলে মনে হয়েছে। মোদিরা স্বীকার করুন বা না করুন, ভোটের আগে দুই রাজ্যের মানুষ বিলক্ষণ টের পেয়েছেন সর্বগ্রাসী মন্দার আবহ। আর এ মন্দারই প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক প্রভাব বা ফল পেয়েছে বিজেপি।

অন্যদিকে বিজেপি শাসনের প্রতি মানুষের অনীহার সরাসরি ফল পেতে শুরু করেছে কংগ্রেস ও বিজেপিবিরোধী দলগুলো। সংশয় কাটিয়েই মানুষ মহারাষ্ট্রে যেমন কংগ্রেস-এনসিপি জোটকে ভোট দিয়েছেন, তেমনই হরিয়ানায় কংগ্রেস ও বিজেপিবিরোধী অন্য দলগুলোকে ভোট দিয়েছেন। হরিয়ানায় বিজেপির প্রতি বীতরাগ এমন পর্যায় পৌঁছে যে মাত্র এক বছর হলো তৈরি হওয়া একটি রাজনৈতিক দলও (জেজেপি) আদায় করে নিতে পেরেছে ১০টি গুরুত্বপূর্ণ আসন। এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য, বিজেপির অপশাসন ও মানুষমারা অর্থনৈতিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কংগ্রেসসহ বিরোধীরা যত আন্দোলনের পথে থাকতে পারবে, তত বেশি করে তারা রাজনৈতিক ফসল ঘরে তুলতে পারবে।  কারণ এ মুহূর্তে দেশের  রাজনৈতিক আবহাওয়া সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।

লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর