শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

নতুন প্রজন্ম নির্মোহ হোক

নূরে আলম সিদ্দিকী

নতুন প্রজন্ম নির্মোহ হোক

গোটা দেশটাতেই একটা গুমোট থমথমে ভাব। তবে ঝড় ওঠার পূর্বাবস্থা এটি নয়। রাজনৈতিক কর্মকা- নেই বললেই চলে। এই পরিবেশটা কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক বিনির্মাণে ও সার্বিক উন্নয়নে দেশ কতখানি এগোচ্ছে তা নির্ধারণ করবেন অর্থনীতির বিশ্লেষক ও সমাজবিজ্ঞানীরা। সাদা চোখে অনেক কিছু দেখে তুষ্ট হওয়া যায়। এমনকি বিমুগ্ধ ও বিমোহিত হওয়া যায়। আবার তাকে বিশ্লেষণ করলে দুশ্চিন্তার একটা কালো মেঘ ভাবনাকে গ্রাস করে।

যেহেতু বিরোধী দলের কোনো রাজনৈতিক কর্মকা- নেই, আন্দোলনের কর্মসূচি দূরে থাক, কালেভদ্রে দুয়েকটি বিবৃতি ছাড়া বিরোধী দলের কোনো রাজনৈতিক অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই ভার। গতানুগতিকভাবে দেশ চলছে। চারদিকের পরিস্থিতি ছোটবেলায় রেল ভ্রমণকালে ট্রেনের শব্দের মতো। চলতি ট্রেনে যেমন ইচ্ছামতো আওয়াজ শোনা যায়, তেমনি ইদানীং অস্তিত্ববিহীন বিরোধী দলের কোনো তোয়াক্কা না করে সরকারি দল ও তার নেতা দুর্দমনীয় ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছেন। কারও কাছে কোনো জবাবদিহির দায়বদ্ধতা আছে বলে সরকার বা সরকারপ্রধান ভাবেন না। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বাংলাদেশের জন্য ক্রমেই সংকটের মেঘ ঘনীভূত করছে। ভরণপোষণের বিশাল দায়ভার ছাড়াও আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা সমগ্র দেশবাসীকে আজ উৎকণ্ঠিত করে চলেছে। এখন অবস্থাটা অনেকটা ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’র মতো। বিশ্বজনমত এবং জাতিসংঘ যদিও বাংলাদেশের সপক্ষে, তবু জাতিসংঘের সমর্থন মূলত অর্থহীন ও বাকসর্বস্ব। এ প্রশ্নে ভারতের জোর ও সক্রিয় সমর্থন আদায় করতে পারলে মিয়ানমার সরকারকে কাবু করা যেত। কিন্তু তা হওয়ার নয়। পৃথিবীর রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিটি হলেন নরেন্দ্র মোদি। দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি অসাম্প্রদায়িক ভারতের প্রধানমন্ত্রীই শুধু নন, সেই ১৮৮৫ সাল থেকে কংগ্রেস যে অসাম্প্রদায়িক ও জাতীয় চেতনায় বিশ্বসভায় ভারতের ভাবমূর্তি প্রতিস্থাপিত করেছিল, সেই অম্লান ও প্রোজ্জ্বল ভাবমূর্তিকে সাম্প্রদায়িকতার কালো মেঘ দিয়ে মোদি প্রায় আচ্ছাদিত করে ফেলেছেন। সম্প্রতি ভারতের নির্বাচনে অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রত্যাশিত মোদির বিজয় অসাম্প্রদায়িক ভারতকে একটি শক্ত ঝাঁকুনি দিয়েছে। কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিগত নির্বাচনের প্রাক্কালে রাহুল গান্ধীর মতো দুর্বল ব্যক্তিত্বের দলীয় প্রধান হওয়া মোদির বিজয়রথকে বেগবান করেছে। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসের মতো খলনায়ককে নায়ক বানিয়েছে। মোদি শুধু বিজেপির সব ক্ষমতা তাঁর করায়ত্ত করতে সক্ষম হননি, বরং ভারতের রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে সাম্প্রদায়িকতার ভিন্নধারায় ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। একসময় আমিও ভাবতাম, ভারত বিশাল গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের তিনটি দিকের সীমানা ছুঁয়ে থাকলেও আমাদের কী আসে যায়। আমরা যখন তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোনোরকমের প্রভাব বিস্তারের চিন্তাও করি না, তারাও তেমনি আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাতে আসবেন না- এটাই স্বাভাবিক, এটাই স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু ক্রমেই আমার ধারণার রং বদলাচ্ছে এবং হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে অনুভূত হচ্ছে- নরেন্দ্র মোদি, ডোনাল্ড ট্রাম্প, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু- এরা মানসিকতার প্রশ্নে এতটাই হীনমন্যতায় আচ্ছন্ন যে, বিশ্বমানবতার প্রদীপ্ত সূযরশ্মি তাঁদের বিবেকের ওপর আলো ছড়াতে পারে না।

ইতিমধ্যেই বাবরি মসজিদ প্রশ্নে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনেকটা নরেন্দ্র মোদি-ঘেঁষা হিসেবে পর্যবসিত হয়েছে। শুধু মুসলমানরাই নয়, কংগ্রেসসহ সব প্রগতিশীল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান শঙ্কিত হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে ভারতীয় মুসলমানরা যে ধৈর্য ও সংযম প্রদর্শন করেছেন তা একদিকে যেমন প্রশংসনীয়, অন্যদিকে এ ধৈর্য ধরে রাখার নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্বও তাদের রয়েছে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিস্তীর্ণ পথপরিক্রমণে মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, সুভাষ বোস এমনকি রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিৎ রায়ের মতো উদার ব্যক্তিত্বের বিরামহীন ও প্রাণান্ত প্রচেষ্টাকে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহরা ধুয়েমুছে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারবেন, তা অনেকের মতো আমিও বিশ্বাস করি না। বরং বিশ্বাস করি ভারতীয় রাজনীতির মধ্য থেকেই অকুতোভয়, অসাম্প্রদায়িক নেতৃত্ব বেরিয়ে এসে ভারতকে তার মূল শক্তির পাদপীঠে প্রতিস্থাপিত করবে। যদিও ভারতবর্ষ বাংলাদেশের মতো একটি ভাষা ও একই সংস্কৃতির দেশ নয়, তবু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে অসাম্প্রদায়িক ও জাতীয় চেতনার যে উন্মেষ, বিকাশ ও বিজয় সাধিত হয়েছে, তাকে উগ্র চটকদার হিংস্র ধর্মান্ধ স্রোতের আঘাতে নির্মূল ও নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয়। মোটামুটিভাবে সারা ভারতে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক ভাবনা; রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলামের মানবিক চেতনা; সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, তরুণ মজুমদারদের সাংস্কৃতিক প্রগতিশীল মননের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গকে সাম্প্রদায়িকতার ঘনকালো অন্ধকারে আচ্ছাদিত করা সম্ভব নয়। তবে আশঙ্কার একটা দিক হলো, এবার বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে লোকসভার ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টি হস্তগত করতে সক্ষম হয়েছে। সব প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও মত উদ্বিগ্ন- তা আমরা জানি। তাই বিশ্বাস করি, এখান থেকে পশ্চিমবঙ্গের প্রগতিশীল অংশ শিক্ষা নেবেন এবং কার্যকর রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলে সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে সফল ও সক্ষম হবেন।

বাংলাদেশে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অধিকার আদায় থেকে শুরু করে পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনতে অনেকটাই বন্ধুর পথ হাঁটতে হয়েছে। অনেক বুকনিঃসৃত রক্ত, অনেক চোখের অশ্রু বাংলার মাটিকে সিক্ত করেছে। তবে আল্লাহর শোকর, বাংলাদেশ আজ শুধু রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌমই নয়, জাতীয় সত্তায় সম্পূর্ণভাবে অসাম্প্রদায়িক। বাঙালি জাতীয় চেতনার দীর্ঘ পথপরিক্রমণ এই বাংলার মাটিকে এতটাই সজীব ও সজাগ করেছে যে, বোধ করি সাম্প্রদায়িকতার হীনমন্যতা, হিংসা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা এই বাংলার শ্যামল মাটিতে আর কোনো দিনই শিকড় গাড়তে পারবে না। রাজনৈতিক স্বার্থ আদায়ের হীনমন্যতায় কেউ কখনো কখনো হয়তো সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভূত দেখার মতো চিৎকার করতে পারেন, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা এ দেশের রাজনীতিতে আর প্রভাব ফেলতে পারবে না, বিজয়ী হওয়া তো অনেক দূরের কথা। সম্প্রতি একটি সামাজিক আন্দোলনের বিজয় দেশে অর্ধশতকেরও বেশি ক্যাসিনোর অবলুপ্তি। খুবই নীরবে ও সুকৌশলে ক্যাসিনোগুলো তাদের রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল। সমস্ত সমাজজীবনকে প্রায় গ্রাস করে ফেলার উপক্রম হয়েছিল। গোয়েন্দাসূত্রে খবর পেয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে শেখ হাসিনা ক্যাসিনোগুলোর বিরুদ্ধে যখন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তখনই এর বীভৎসতার বিস্তার ও বিস্তৃতি জনগণ জানতে পারে। তাই সরকারপ্রধানের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে বন্ধ হয়ে গেলেও আশঙ্কা থেকে যায়, আবার নতুন করে ভিন্ন কোনো কায়দা ও কৌশলে এই ক্যাসিনো, জুয়া ও মদের ব্যবসা চালু হবে না তো? ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের পরও বিশাল জনগোষ্ঠীর মনের ক্যানভাস থেকে আশঙ্কার মেঘ সম্পূর্ণ দূরীভূত হয় না।

নৈতিকতার স্বার্থেই এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ক্যাসিনোর চাইতেও অধিক মানবিকতার সংকট তৈরি করছে মাদক। আর এটি শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়, গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। মাদক ব্যবসাটি দেশব্যাপী এমনভাবে বিস্তার লাভ করছে যে, দু-একজন ইয়াবা ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে ইয়াবা ব্যবসা নিশ্চিহ্ন করা দূরে থাক, নিয়ন্ত্রণও করা যাবে না। দ্রুত বিচার আইনে মাদক ব্যবসায়ীদের বিচার করে সর্বোচ্চ মৃত্যুদন্ডের সাজার ব্যবস্থা করলে এবং অতিদ্রুত দু-একটি সাজা প্রদান করে কার্যকর করলে এর প্রতিকারের একটা পথ বিনির্মাণ হতো। মাদকসেবীরা তো বটেই, মাদক ব্যবসায়ীরাও সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। এদের গাঁটছড়া খুবই শক্ত, শিকড় অনেক গভীরে। তবে বাংলাদেশে একটি সুবিধার দিক হলো, এ দেশের প্রশাসন এককভাবে শেখ হাসিনা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। মাদক নির্মূলে তাঁর মনন ও মানসিকতা সুদৃঢ় থাকলে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন এখনো এটি নির্মূল করার ক্ষমতা রাখে। তাই শেখ হাসিনাকে সব অন্তরায়, বাধাবিঘ্ন ও প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে প্রত্যয়ী থেকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করেন, মাদক নির্মূল করতে না পারলে শুধু তরুণ সমাজই নয়, সমগ্র দেশটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। ডায়াবেটিসকে যেমন ব্যাধির জন্মদাত্রী বলা হয়, তেমন মাদকও সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ছিনতাই, খুন-খারাবি, ধর্ষণসহ সব সমাজ ও মানবতাবিরোধী কার্যকলাপের কেন্দ্র। তাই সামাজিক অপরাধের উৎস মাদক সেবন ও ব্যবসাকে নির্মূল করতেই হবে। এর কোনো ব্যতিক্রম ও ব্যত্যয় সমাজকে অনিবার্যভাবেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধীদের বিচারের ক্ষেত্রে সরকার যে দৃঢ়তার ছাপ রেখেছে, মাদকবিরোধী অভিযানে তেমনি দৃঢ় মানসিকতা ও স্বচ্ছ-নিরপেক্ষ ও নির্ভীক কার্যকলাপ পরিচালনা করলেই সুনিশ্চিতভাবে মাদকের বিস্তার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসবে। এটি কোনো রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা নয়, বরং জাতীয় প্রত্যাশা। মাদকবিরোধী এ অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে সরকার যেটুকু বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হবে, তার চেয়ে অনেক বেশি সমর্থন ও সহযোগিতা পাবে। শুধু সদিচ্ছা ও নিরপেক্ষতা ধরে রাখলেই চলবে।

দেশে প্রচ- বিতর্কের একটি প্রশ্ন- ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত কি অনুচিত। ভুলে গেলে চলবে না, সেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যকে আলিঙ্গনের পথপরিক্রমণে ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকাই মুখ্য ছিল এবং ছাত্রলীগ ছিল সব আন্দোলন সৃষ্টির কারিগর। ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন থেকে আন্দোলনের বিস্তীর্ণ পথ আমাকে হাঁটতে হয়েছে। সেদিনের আমাদের ছাত্রলীগের রাজনীতি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের আলোকে স্বাধীনতা অর্জন, পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করা। সেই রাজনীতিতে আমরা সম্পূর্ণ সফল ও বিজয়ী। তাই ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার কোনো দুরভিসন্ধিকে সমর্থন করার মানসিকতা আমার আদৌ নেই। সেই স্বাধীনতাকে সুসংহত করার এবং স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যরশ্মিকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় ব্যাপৃত হওয়াই আজকের ছাত্র রাজনীতির প্রতিপাদ্য বিষয় হওয়া উচিত। কলুষিত সন্ত্রাসী দুর্নীতিগ্রস্ত ছাত্র রাজনীতির পরিম-ল থেকে ছাত্রসমাজকে বিমুক্ত করতে পারলেই ভর্তিবাণিজ্য, টেন্ডারবাজিসহ সব অসামাজিক ও অশুভ কর্মকান্ডের হাত থেকে দেশ ও জাতি মুক্তি পাবে।

আজকে স্বচ্ছ রাজনীতির উন্মুক্ত পরিবেশে এই নির্মল বিমোহিত পরিবেশকে একটি স্থায়ী রূপ প্রদান করতে হবে। অতন্দ্র প্রহরীর মতো সজাগ সচেতন দৃষ্টি রাখতে হবে যেন দেশের তরুণ ও যুবসমাজ মাদকের করাল গ্রাসের শিকার না হয়। বৈষয়িক ও আর্থিক স্বার্থকেন্দ্রিক কোনো কার্যকলাপের সঙ্গে ছাত্রনেতৃত্বের সম্পর্ক যেন গড়ে না ওঠে। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের অঙ্গসংগঠনে পরিণত হওয়া বা লেজুড়বৃত্তি করাকে সম্পূর্ণ হারাম বলে পরিত্যাগ করতে হবে। অনেকে আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন, অভিমতও ব্যক্ত করতে পারেন- বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছাত্র সংগঠনগুলো নিজস্ব সত্তায় উদ্ভাসিত হয়ে স্বাধীনভাবে চলতে পারবে না। এ চলার ব্যবস্থাটি রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই করতে হবে। আমি সবিনয়ে এই মতটির বিরোধিতা করি। আমাদের সময়ে বঙ্গবন্ধু আমাদের সৃষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন, আমাদের চেতনার প্রতীক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে ছাত্রলীগই তিল তিল করে গড়ে তুলেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁর ব্যক্তিত্ব যে উচ্চতায় অবস্থিত ছিল, সে অবস্থানটিও ছাত্রলীগের তৈরি। আমি হলফ করে বলতে পারি, বঙ্গবন্ধু ও ছাত্রলীগের মধ্যে একটি অদৃশ্য রাখিবন্ধন ছিল, একে অন্যের পরিপূরক শক্তি ছিল কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ছিল না। আন্দোলন পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর সবচাইতে বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন শক্তিই ছিল ছাত্রলীগ। গোটা ছাত্রসমাজ তথা ছাত্রলীগ উদ্যত উদ্গত উদ্ধত পূর্ণায়ত পদ্মটির মতো বিকশিত ও উদ্ভাসিত না হলে স্বাধীনতা অর্জিত হতো না, বাঙালি জাতির চেতনার অভ্যুদয় ঘটত না। সেই বিশাল ও বিস্তীর্ণ এই ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সত্তা হিসেবে আমি ছাত্র রাজনীতির সপক্ষে। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক সংগঠন বা ব্যক্তি তাকে আজ্ঞাবহ করে রাখুক- এর সম্পূর্ণ বিপক্ষে। সেদিনের ছাত্র রাজনীতির লক্ষ্য ছিল শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সমগ্র জাতিকে সজাগ, সতর্ক ও ঐক্যবদ্ধ করা এবং সামরিক জান্তা ও পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করা। কিন্তু আজকের ছাত্রদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে অর্জিত স্বাধীনতাকে সুসংহত করা এবং স্বাধীনতার নির্যাসকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এর জন্য প্রয়োজন বিদগ্ধ চিত্তের ঋষিবালকের মতো নিজেদের ঐক্য ও জ্ঞানপ্রদীপ্ত মানুষ হিসেবে তৈরি করা। জীবনসায়াহ্নে এসে নতুন প্রজন্মকে যেমন আমি মাদকাসক্ত দেখতে চাই না, তেমনি কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের এজমালি সম্পত্তি হিসেবেও দেখতে চাই না। নির্মল, নিষ্কলুষ ও উদ্ভাসিত মানুষ হিসেবে তাদের দেখতে চাই। আগামী প্রজন্ম যত নিষ্কলুষ হবে, দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ ততটাই প্রোজ্জ্বল হবে।

             লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর