সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

রোগ প্রতিরোধ ও মেধা বিকাশে ছোট মাছ

নজরুল ইসলাম

রোগ প্রতিরোধ ও মেধা বিকাশে ছোট মাছ

জীবনধারণের জন্য আমাদের খাদ্য গ্রহণ একান্ত অপরিহার্য। আমরা দৈনন্দিন যেসব খাদ্য গ্রহণ করি সেসব খাদ্যকে উপাদান অনুযায়ী যে ছয় ভাগে ভাগ করা যায় এর মধ্যে কিছু অ্যামাইনো অ্যাসিড, ফ্যাটি অ্যাসিড, সব ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ আমাদের শরীরের জন্য অত্যাবশ্যক। কারণ এগুলো আমাদের শরীর সংশ্লেষিত পদ্ধতিতে তৈরি করতে পারে না। মাছের চর্বিতে বেশি থাকে ফ্যাটি অ্যাসিড। খাদ্যে লোহার পরিমাণ কম থাকলে শরীরে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। লেহা হিমোগ্লোবিন, মায়োগ্লোবিন ও সাইটোক্রম গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবে আমাদের শরীরের চামড়া খসখসে হয়ে যায় ও রাতকানা রোগ দেখা দেয়। ভিটামিন ‘ডি’র অভাবে শিশু রিকেট রোগে আক্রান্ত হয়। বয়স্কদের হাড়ের বেদনা থেকে বাত সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের স্বাদু পানিতে পাওয়া যায় প্রায় ২৬০ প্রজাতির মাছ। এর মধ্যে প্রায় ১৭০ প্রজাতি ছোট মাছ হিসেবে পরিচিত। এর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া সব মাছই মানুষ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে আসছে আবহমানকাল থেকে। মোট কথা, ছোট মাছ আবহমানকাল থেকেই এ দেশের সাধারণ মানুষের পুষ্টির উৎস। মাছের খাদ্যগুণ বিশ্লেষণেও দেখা যায় বড় মাছের চেয়ে ছোট মাছের খাদ্যমান অনেক বেশি। ছোট মাছ অল্প খেলে বড় মাছের চেয়ে অনেক বেশি পুষ্টি পাওয়া যায়। ছোট মাছের এ পুষ্টিগুণ ছাড়াও রয়েছে অন্য গুণাবলি। পৃথিবীতে খুব কমই হৃদরোগ হয় এস্কিমোদের। কারণ তারা মাছ ও মাৎস্যজ জাতীয় খাদ্য বেশি খায়। ফলে তাদের রক্তে ওমেগা-৩ ছাড়াও ছয় জাতীয় ফ্যাটি অ্যাসিডের প্রাচুর্য রয়েছে; যা মানবদেহকে সুস্থসবল রাখতে অত্যন্ত সহায়ক বলে ধরা হয়। তা ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেখানে হৃদরোগের হার বেশি দেখা যায়, দেখা গেছে সেখানকার মানুষ প্রাণিজ চর্বি ও দুগ্ধজাতীয় দ্রব্য থেকে ফ্যাটি অ্যাসিড ও লিপিড গ্রহণ করে। ফলে তাদের শরীরে কলেস্টেরল ও অন্যান্য ক্ষতিকারক লিপিডের মান বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছে শরীরের রক্তনালিতে বিভিন্ন বাধার সৃষ্টি করে। এমনকি নিরামিষভোজীদের মধ্যে হৃদরোগের সংখ্যা বেশি দেখা যায়। যখন তারা খাবারের সঙ্গে ঘি, মাখন, পনির ও ছানা বেশি খায়। সুতরাং দেখা যায়, মাছের তেল সবচেয়ে নিরাপদ ও সবার জন্য উপকারী। মানুষের শরীরে বিভিন্ন ধরনের বাত দেখা যায়। এর মধ্যে কিছু বাত আছে এরা শরীরের রোগ প্রতিরোধে বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এদের Autoimmune বাত রোগ বলে। এ রোগের ব্যথার কারণ হলো প্রস্টোগ্লান্ডলিন নামে এক ধরনের হরমোন। এর পথ্য হিসেবে এসপিরিন দেওয়া হয়। এসপিরিন শরীরের এন- ৬,২০ কার্বন-জাতীয় অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো প্রস্টোগ্লান্ডলিন উৎপাদন বন্ধ করে বাতের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়। কিন্তু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, আমাদের দেশীয় ছোট মাছগুলোয় এন-৩,২০ কার্বনের উপস্থিতি রয়েছে; যা হয়তো এ দেশের স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় বসবাসকারী বিপুল জনগোষ্ঠীকে আবহমানকাল থেকেই তাদের অজান্তে উপকার করে আসছে।

ইনসুলিন উৎপন্নের মাধ্যমে আমাদের শরীরে মেটাবলিজম নিয়ন্ত্রিত হয়। এ নিয়ন্ত্রণের সমস্যা হলেই ডায়াবেটিস হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, তারা ১২ জন সুস্থ ভলান্টিয়ারকে মাংস, সবজি ও মাছ জাতীয় খাবারে তেল দুই সপ্তাহ খাইয়ে পরীক্ষা করেছেন। ফলাফলে দেখা গেছে, শুধু মাংসভোজী ভলান্টিয়ারদের ইনসুলিন ক্ষরণের হার অন্যদের থেকে বেশি। এ ছাড়া আরও দেখা গেছে, মাছের তেল শুধু ইনসুলিন ক্ষরণে সাহায্য করে না বরং ইনসুলিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

বাংলাদেশের মানুষ পৃথিবীর অনেক জাতি থেকে অনেক কর্মঠ ও বুদ্ধিমান। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না, আমাদের মস্তিষ্কে ৬০ ভাগ উপাদানই হলো লিপিড। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আর এ কারণে মানুষের মস্তিষ্কের গঠনও সবচেয়ে জটিল। যার বিকাশে লিপিডের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। চোখের রেটিনায় পাওয়া যায় এমনই ২০ ও ২২ কার্বন-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের উপস্থিতি মস্তিষ্কে লক্ষ্য করার মতো। তা ছাড়া মাতৃগর্ভে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ, মেধাচর্চায় ও সুস্থ মানসিকতায় ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের প্রয়োজনীয়তা এখন স্বীকৃত। উন্নত বিশ্বে প্রচলিত আছে- কেউ একদিন মাছ খেলে পরবর্তী সাত দিনে সে ৩০ ভাগ কম বিষণ্নতায় ভোগে। ক্যালসিয়াম আমাদের শরীরের পেশি সংকোচন, স্নায়ুর উদ্দীপনার জন্য এক স্নায়ুকোষ থেকে অন্য কোষে সঞ্চালন, দাঁত ও অস্থি গঠনে সাহায্য করে। একইভাবে ফসফরাস ক্যালসিয়ামের সঙ্গে সঙ্গে যৌগ গঠন করে খাদ্য থেকে শক্তি স্থানান্তর  DNA, RNA ও ATP গঠনে সাহায্য করে। আমাদের দেশে ছোট মাছের মাধ্যমে এ প্রয়োজন সহজে মেটানো যায়। মাছ আমাদের তথা এ দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টি জোগায়। আমাদের মস্তিষ্কের বিকাশ, বহুমূত্র রোগ বা রাতের ব্যথা উপশমে মাছজনিত ফ্যাটি অ্যাসিডের প্রয়োজন। বর্তমান বিশ্বে দরিদ্রতার সংজ্ঞা শুধু অর্থনৈতিক সচ্ছলতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের বিদ্যা, বুদ্ধি, স্বাস্থ্য ও সুস্থ সমাজব্যবস্থার বিকাশের মধ্যেও দরিদ্রতা খুঁজে পাওয়া যায়। তাই আমরা খাদ্যের সঙ্গে সঠিক পরিমাণে মাছ গ্রহণ করলে আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মেধা বিকাশের দরিদ্রতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

লেখক : কলামিস্ট, গবেষক।

সর্বশেষ খবর