বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

অভিশপ্ত স্বাস্থ্য খাত তিন মন্ত্রী দায় এড়াতে পারেন না

পীর হাবিবুর রহমান

অভিশপ্ত স্বাস্থ্য খাত তিন মন্ত্রী দায় এড়াতে পারেন না

দেশের নানা খাতের দুর্নীতির যে ভয়াবহ চিত্রপট দেশবাসীর সামনে উঠে এসেছে তার মধ্যে স্বাস্থ্য খাত বহুল আলোচিত। এই দুর্নীতির সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালীরাই নন, স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল হয়ে জেলা-উপজেলার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে ঠিকাদারদের একটি অংশ জড়িয়ে আছে। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি সব সময়ই হচ্ছে। কিন্তু এর ভয়াবহতা দেখা দিয়েছে বিএনপি-জামায়াত শাসনামল থেকে। আওয়ামী লীগের টানা ১১ বছরের শাসনামলে সেটি বীভৎস, উগ্র রূপ ধারণ করেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে, দেশের মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে গিয়ে দুই হাত ভরে বরাদ্দ দিয়েছেন। কিন্তু তিনি যাদের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা রেখেছিলেন, তারা তার মর্যাদা দেওয়া দূরের কথা, নিজের বিবেক ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা দূরে থাক, স্বাস্থ্য খাত ঘিরে জনগণের সম্পদ লুটপাটের মধ্য দিয়ে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। তৃণমূল পর্যন্ত অসংখ্য অবকাঠামোর উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়েছে। প্রয়োজনীয় মেশিনপত্র সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু তার জবাবদিহিমূলক স্বচ্ছতার চিত্র উঠে আসার বদলে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতিবাজদের ভয়াবহ অসুস্থতার দৃশ্যই বারবার উঠে এসেছে। এ দুর্নীতি-অনিয়ম জাতিকে ব্যথিত, হতাশ ও বিক্ষুব্ধ করেছে। এমন নির্লজ্জ দুর্নীতির মহোৎসব বিশ্বের আর কোথাও স্বাস্থ্য খাত ঘিরে হয়েছে কিনা জানা নেই। কিন্তু যে দেশ ৩০ লাখ শহীদের রক্তে স্বাধীন হয়েছে, আড়াই লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন, সেই দেশে মানুষের স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্য অধিকারের অর্থ লুণ্ঠনের এই ভয়াবহ চিত্র আল্লাহর আরশ কাঁপিয়ে দেয়।

প্রকৃতিও স্বাস্থ্য খাতের মতো মানুষের জীবন-মরণের মতো সেবা খাতের এই ভয়াবহ দুর্নীতি সইবার কথা নয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জীবনের ১৩টি বছর কারাগারেই কাটাননি, নির্ভীক চিত্তে দেশের স্বাধীনতার জন্য, মানুষের অধিকারের জন্য ফাঁসির মঞ্চেই যাননি, গোটা জীবন দুর্ধর্ষ সাহসের সঙ্গে দীর্ঘ সংগ্রামের পথে গোটা জাতিকে এক মোহনায় মিলিত করে সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতার বিজয় এনে দিয়েছিলেন। দেশের মানুষ ও মাটিকে হৃদয় দিয়ে চিন্তা-চেতনায় ভালোবাসার যে অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন, তার সেই দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক চরিত্রের বীরত্বের গৌরবকে দুর্নীতিগ্রস্ত শক্তি অবমাননা করছে। তিনি আজীবন দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়েছেন। এই দেশের মাটি ও মানুষকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসতে গিয়ে পরিবার-পরিজনসহ ঘাতকের হাতে জীবন দিয়েছেন। সেদিন তাঁর সঙ্গে যেভাবে বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছিল, তেমনি একালের দুর্নীতিবাজরা সেই বিশ্বাসঘাতকতার ধারা এখনো অব্যাহত রেখেছে।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সেই আগস্টের কালরাতে ছোটবোন শেখ রেহানাসহ দেশের বাইরে থাকায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। তারপর তাঁর নির্বাসিত জীবন ছিল দুর্বিষহ। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের জন্য, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারীদের জন্য দিনগুলো ছিল শ্বাসরুদ্ধ, নির্যাতন, নিপীড়ন সইবার কঠিন অন্ধকার সময়। আওয়ামী লীগের রাজনীতির আরেক কঠিন সময়ে দলের সভাপতি হয়ে ফিরে এসে শেখ হাসিনা দলের হালই ধরেননি, বারবার মৃত্যুর সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে দলকে জনপ্রিয় করে নিজেকে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের উচ্চতায় নিয়ে গিয়ে ক্ষমতায় এনেছিলেন। এবার নিয়ে টানা তৃতীয়বার তিনি দলকে এনেছেন ক্ষমতায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাসের মহাদুঃসময়ের পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসীদের কি এক অদৃশ্য শক্তি পেছনে ফেলে দিয়ে ক্ষমতানির্ভর আওয়ামী লীগের সরকার ও দলের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গণবিচ্ছিন্ন, সুবিধাবাদী, নব্য হাইব্রিড লোকদের শক্তিশালী অবস্থানই দেয়নি, অভয়াশ্রমে পরিণত করেছে। এরা নিজেদের ভাগ্যবদলের উত্তম সময় হিসেবে এ শাসনকালকে বেছে নিয়ে কার্যত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার মানুষ ও দেশের প্রতি গভীর আবেগ-অনুভূতি ও ভালোবাসার দায়বদ্ধতার সঙ্গে প্রতারণা করছে। আওয়ামী লীগ বারবার ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেখেছে, ক্ষমতায় থাকাকালীন চারদিকজুড়ে যত আওয়ামী লীগ দেখা যেত, ক্ষমতা হারানোর পর তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিরোধী দলের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের জন্য প্রকৃত আদর্শিক নেতা-কর্মীরাই লড়াই করেছেন। রক্ত ঝরিয়েছেন। পুলিশি নির্যাতন ও কারাদহন ভোগ করেছেন। কিন্তু যতবার ক্ষমতায় এসেছে সুবিধাবাদীদের কখনোই প্রতিরোধ করতে পারেনি। ক্ষমতাবানরাই যে যেখানে সুযোগ পেয়েছেন, ব্যক্তিগত লোভ ও লাভের আশায় তাদের আশ্রয় দিয়েছেন। অনেক আদর্শিক নেতা ও মন্ত্রী-এমপি সৎ কর্মীবান্ধব চরিত্র হারিয়েছেন। একসময় আওয়ামী লীগ অসংখ্য গণমুখী, কর্মীবান্ধব নেতা-কর্মীর দল ছিল। একসময় আওয়ামী লীগ গণমুখী, গরিব মানুষের অধিকার আদায় ও প্রতিষ্ঠার শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল। সেই আওয়ামী লীগের ক্ষমতার করুণার ছায়ায় সুবিধাবাদী, গণবিচ্ছিন্ন কর্মী ও মানুষ বিমুখ নানা পেশার মানুষ ভর করে দুর্বল করে দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী তৃণমূল বিস্তৃত গণমুখী সংগঠন যদি কখনো ক্ষমতা থেকে হোঁচট খায় বা কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, তাহলে তার খেসারত দলের নেতা-কর্মীকেই নয়, দেশের জনগণকেও দিতে হয়। এই সত্য অতীতে বারবার আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি। এ কালের আওয়ামী লীগকে শুধু নানা পেশার হাইব্রিডরাই ভর করে ঘুণপোকার মতো খাচ্ছে না, কর্তৃত্ববাদী একদল আমলাও যারা তাদের ছাত্রজীবনে বা পারিবারিক জীবনে কখনো বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী ছিল না, তারাও নিজেদের ভাগ্য বদলের জন্য উচ্চাভিলাষী কর্তৃত্বপরায়ণ আচরণে গণবিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে চড়া মাশুল গুনতে হবে। অতীতে বারবার নেতৃত্বের জায়গা থেকে সৎ ত্যাগী নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীদের তুলে এনে হাইব্রিড অনুপ্রবেশকারীদের খেদানোর কথা বললেও বাস্তবে তার কিছুই ঘটেনি।

যাক, স্বাস্থ্য খাত নিয়ে শুরু করেছিলাম। ওয়ান-ইলেভেনের কঠিন চ্যালেঞ্জ ও কারাদহন ভোগ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিজের ক্যারিশমা ও ইমেজের ওপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিশাল বিজয়ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে ক্ষমতায় এনেছিলেন। সেদিন আওয়ামী লীগ ১৪ দল ও মহাজোট যে আবেগ-অনুভূতিতে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত ছিল, আজ তা কতটা আছে, সেটি নিয়ে যেমন প্রশ্ন আসে, তেমনি যে আওয়ামী লীগে একসময় অসংখ্য আলোকিত নেতৃত্ব ও মাঠপর্যায়ের গ্রহণযোগ্য কর্মীবান্ধব, গণমুখী, শক্তিশালী সংগঠক ছিলেন তা এখন কতটা রয়েছে, সেটি নিয়েও প্রশ্ন আছে।

যাক, সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বিশাল বিজয় অর্জন করার পর দেশের প্রখ্যাত চিকিৎসক আ ফ ম রুহুল হককে স্বাস্থ্যমন্ত্রী করেছিলেন। দেশের একজন স্বনামধন্য চিকিৎসককে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ায় মানুষও খুশি হয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসা জগতের এমন একজন কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তি কতটা সততা ও দক্ষতার সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেটি নিয়ে প্রশ্ন ও বিতর্ক উঠতে বিলম্ব হয়নি। সে সময় স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন সিন্ডিকেট অবাধ লুণ্ঠনের মহোৎসবে স্বাস্থ্য খাতকে বিতর্কের শীর্ষে নিয়ে আসে। এই দুর্নীতির মহোৎসব মন্ত্রীকে খ্যাতিমান চিকিৎসকের আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে আসে। কারণ তিনি ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারেন না।

২০১৪ সালের কঠিন পরিস্থিতির মুখে প্রধান বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জন ও প্রতিরোধের সহিংস কর্মকা- মোকাবিলা করে সাহসিকতার সঙ্গে শেখ হাসিনা আবার দলকে ক্ষমতায় আনার পর বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর খুনিদের বুলেটে কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর পুত্র আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিমকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী করেছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম সেনাশাসক এরশাদের জমানায় দলের প্রচার সম্পাদক হয়ে একজন মিডিয়াবান্ধব ও কর্মীবান্ধব নেতা হিসেবে লাইম লাইটে আসেন। নব্বই-উত্তর গণতন্ত্রের জমানায় পঞ্চম সংসদে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন বিরোধী দলের নেত্রী, মরহুম আবদুস সামাদ আজাদ বিরোধী দলের উপনেতা ও মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন বিরোধী দলের চিফ হুইপ। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সেই সংসদ ও সেই সময়ের উত্তাল রাজনীতি একজন রাজনৈতিক রিপোর্টার হিসেবে কাভার করতে গিয়ে উপভোগ করেছি। পঞ্চম সংসদের মতো সংসদীয় রাজনীতিতে রাজনৈতিক কর্মকা-মুখর এমন সংসদ আর কখনো আসেনি। সেই সময়ের বিরোধী দলগুলোর কর্মকা- সংসদ বর্জন করার পরও সংসদ ও রাজপথ-কেন্দ্রিক ছিল। বিরোধী দলের উপনেতা, চিফ হুইপ নিয়মিত অফিস করতেন। বিরোধী দলের সদস্যরাও যেতেন। আমরা যেতাম।  নাসিম ব্রিফ করতেন। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সে সময় সারা দেশেই সফর করিনি, আওয়ামী লীগ ও সংসদ বিট কাভার করতে গিয়ে নেতাদের সঙ্গে এক কথায় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে দিন-রাত যোগাযোগ ছিল। খবর সংগ্রহের নেশা ছিল তীব্র। পরিশ্রম ছিল শক্তি। পেশাদারিত্বের জায়গা ছিল ইবাদতের মতো। স্কুলজীবন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিন পর্যন্ত ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার সুবাদে আমার নেতা ছিলেন মরহুম আবদুস সামাদ আজাদ, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদরা। শেখ হাসিনা ছিলেন আমাদের আবেগের মূল জায়গায়। ছাত্ররাজনীতিতে যখন অভিষেক তখন ছাত্রলীগ সভাপতি ওবায়দুল কাদের ও সাধারণ সম্পাদক বাহালুল মজনুন চুন্নু। চুন্নুর জন্য রাজনীতির ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। ওবায়দুল কাদেরের জন্য সুপ্রসন্ন হয়েছে। নিরন্তর ধারাবাহিকতায় তিনি এখন আওয়ামী লীগের দ্বিতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর সঙ্গে এখনো সেই সম্পর্ক অব্যাহত রয়েছে। তাঁর শারীরিক অসুস্থতার পর খুব একটা টেলিফোন করা হয় না। পারতপক্ষে কাউকে বিরক্ত করা, অকারণে ফোন করা আমার স্বভাবে নেই। পেশাগত জীবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর মহান আদর্শকে আমি আমার আত্মা, চেতনা ও বিশ্বাস দিয়ে লালন করলেও সুমহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্নে অবিচল থাকলেও দলীয় মোহের ঊর্ধ্বে নিজেকে নিয়ে আসি। বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই আমার নেতা। তিনি ও মুক্তিযুদ্ধ আমার আজন্মের অহংকার। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা আমার শক্তি, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আমার বিশ্বাস এবং দেশ ও মানুষের কাছেই আমি দায়বদ্ধ। খবর হচ্ছে জনগণের সম্পদ। ব্যক্তিগতভাবে কোনো সরকারের কাছে কোনো সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের নজির আমার নেই। নেওয়ার ইচ্ছাও নেই। ২০০১ সালের পর সচিবালয়েও আমার যাওয়া হয়নি। মন্ত্রীদের বা ক্ষমতাবানদের দুয়ারে দুয়ারে ঘোরার অভ্যাসও কখনো ছিল না। রিপোর্টিং জীবনে অনেকে সিন্ডিকেট করে রিপোর্ট করতেন। কিন্তু আমি কখনো কোনো দিন কোনো সিন্ডিকেটে নিজেকে যুক্ত করিনি। তেমনি কারও পোষ্য সংবাদকর্মী হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না যদিও আমার সামাজিক যোগাযোগ শক্তিশালী। আমার সোর্স ছিল শক্তিশালী আর পরিশ্রমই ছিল সাফল্যের চাবি। আমার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে, আমার আত্মমর্যাদার সঙ্গে পোষ্য সাংবাদিকতা ছিল সাংঘর্ষিক। অনেক রাজনীতিবিদের সঙ্গে গভীর হৃদ্যতার সম্পর্ক হয়েছে। ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের হিসাবে সেটি কখনো জড়ায়নি। পেশাদারিত্ব, খবর, সংবাদ বিশ্লেষণ রাজনীতির গতি-প্রকৃতিই ছিল সম্পর্কের উৎস। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুসহ গুটিকয় নেতা ও ব্যক্তির সঙ্গে প্রাণখোলা আড্ডা দেওয়া ছাড়া বর্তমানে কোথাও আমার যাতায়াতও নেই। সংসদীয় রিপোর্ট করতে গিয়ে তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহযোগিতাও পেয়েছি। সেই সময় সংবিধানের অনেক অনুচ্ছেদ ও সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি হাতের নাগালে থাকত। অনেকটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। শেখ রাজ্জাক আলী, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও মো. আবদুল হামিদের মতো স্পিকারের সান্নিধ্য পেয়েছি। বর্তমান স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে আমি একজন উচ্চশিক্ষিত, দক্ষ স্পিকার হিসেবে সম্মান করি। যদিও এ কালের সংসদ নিয়ে আমার অনেক প্রশ্ন রয়েছে।

যাক, মোহাম্মদ নাসিমের সঙ্গে সেই পঞ্চম সংসদ থেকেই পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে যোগাযোগ ছিল। একটি খবরের জন্য গভীর রাতে টেলিফোন করলেও তিনি সহযোগিতা করতেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক পদে যখন আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের নাম নেতা-কর্মী, কাউন্সিলরদের মুখে মুখে উচ্চারিত হতো, সেই সময় গণমুখী কর্মীবান্ধব প্রাণবন্ত আমুদে নেতা হিসেবে মোহাম্মদ নাসিম উদীয়মান হিসেবে উঠে আসেন। দলের অনেকেই তাঁকে ভবিষ্যৎ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে চিন্তা করেছিলেন। উত্তরবঙ্গের আরেক রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মরহুম আবদুল জলিলের সঙ্গেও আমার সম্পর্ক ছিল। রাজনীতিতে তিনি একজন হৃদয়বান কর্মীদরদি নেতা হিসেবে আমার কাছে আমৃত্যু থাকবেন। যেসব রাজনীতিবিদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ও গভীরতা রয়েছে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থাকলেও মুখোমুখি একান্ত আড্ডায় আমি কখনো দ্বিমত পোষণ করলে তুমুল তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হতে কার্পণ্য করিনি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে মাঝেমধ্যে এমন ঝগড়া হতো তৃতীয় পক্ষ কেউ দেখলে হয়তো ভাবতেন, সম্পর্ক বুঝি এই শেষ। ব্যক্তিগত স্বার্থের সম্পর্ক না থাকলে হৃদয়ভিত্তিক সম্পর্ক এভাবে আত্মমর্যাদার সঙ্গে টিকিয়ে রাখা যায়। যদিও সুরঞ্জিত সেনের কয়েকদিনের মন্ত্রিত্ব তার বর্ণাঢ্য সংসদীয় রাজনৈতিক জীবনকে প্রশ্নবিদ্ধ করায় আমিও ব্যথিত হয়েছি।

যাক, যে কথা বলছিলাম, ’৯৬ শাসনামলে মোহাম্মদ নাসিম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ একাধিক মন্ত্রণালয়ের দাপুটে মন্ত্রী ছিলেন। ওয়ান-ইলেভেনে তিনি কারানির্যাতন ভোগ করে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন। দীর্ঘদিন তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, যোগাযোগ নেই। তিনি ও অকালপ্রয়াত ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ দুজনই আমাকে সম্মান করতেন। ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাসিমকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী করেছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া দুর্নীতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দুর্নীতিমুক্ত করতে তিনি পারেননি। একটি ৫ হাজার টাকার বইয়ের দাম ৮৫ হাজার টাকায় কেনা হয়েছে। অপারেশন থিয়েটারের পর্দার দাম ৩৭ লাখ টাকায় উঠেছে। সারা দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। অত্যাধুনিক মেশিন গেছে। চড়ামূল্যের মেশিন পশ্চিমা দেশের স্টিকার দিয়ে চীনা পণ্য সরবরাহ করার অভিযোগও রয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের একজন কর্মচারী আবজাল ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা দুর্নীতি করে বিদেশে চলে গেছেন। সারা দেশের হাসপাতালগুলোয় মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে বিশাল ভবন পায়। ডাক্তার পায় না।  নার্স পায় না। ওষুধ পায় না। এমনকি টেকনিশিয়ানের অভাবে প্যাথলজি টেস্টের সুযোগ পায় না। মেশিনপত্র নষ্ট হয় অযতেœ, ব্যবহার না করে। কেনাকাটায় জড়িতরা লাভবান হন। গোটা দেশের স্বাস্থ্য খাত আরও দুর্নীতির মহোৎসবে পরিণত হয়। মোহাম্মদ নাসিম মাঝেমধ্যে আক্ষেপ করে বলেন, টকশোয় বা কলামে আমি তাঁর কথা বলি না। তোফায়েল আহমেদের কথা বলি। আক্ষেপ তিনি করতেই পারেন। আমার আলোচনা ও লেখার প্রসঙ্গে তোফায়েল আহমেদরা আসেন ইতিহাসের সন্তান হিসেবে। ইতিহাসের জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে। এর সঙ্গে আমার কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থের সম্পর্ক জড়ানো নয়। আওয়ামী লীগের বাইরেও বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে আমার চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে। মৃত্যুর আগে বামপন্থি রাজনীতির শেষ বটবৃক্ষ অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ সাদা কাগজে সই করে দিয়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘তোমার কথাই আমার কথা। তোমার মন যা চায় আমার নামে তা লিখে দিতে পার।’ একটি প্লট, কয়েকটি বিদেশ সফর কিছু তদবিরের চেয়ে আমার কাছে সম্মান ও ভালোবাসা অনেক মূল্যবান।

মোহাম্মদ নাসিম রাজনীতিতে যেভাবে উঠে এসেছিলেন, আমার পর্যবেক্ষণ বলেছে, মন্ত্রিত্ব তাঁর সেই শক্তি খেয়ে ফেলেছে। তিনি যদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি কঠোর হাতে দমন করতে পারতেন, তাঁর সঙ্গে দেখা হোক বা না হোক, তিনি চান বা না চান আমি নিজেই উচ্চৈঃস্বরে তাঁর কথা বলতাম। দুই হাত খুলে তাঁর কথা লিখতাম। তাঁর পোষ্য মোড়ল সাংবাদিকরা কেন তাঁর জন্য লিখেন না? সবার কথা বলতে ও লিখতেও আমি আসিনি। মির্জা গালিব বলেছেন, ‘আমি তোমাদের মন্ত্রীদের স্তুতি লিখতে আসিনি। আর তোমাদের মন্ত্রীদের বলে দিও আমাকে দেখলে যেন দাঁড়িয়ে সম্মান করেন।’ আমি জানি, দলকানা সমাজে সাংবাদিকতা এ জায়গায় নেই যে, আমি এ কথা বলব। তবে নিজের ইজ্জত নিয়ে অন্তহীন দহনে একা নিঃসঙ্গ হয়ে মরলেও শান্তি পাব কিন্তু মর্যাদা হারাতে পারব না। পঞ্চম সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মোহাম্মদ নাসিম এখনো আমার কাছে নায়ক। কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন প্রশ্নবিদ্ধ রয়েছে। আশা করি, তিনি তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে আত্মসমালোচনার দুয়ার খুলে আয়নার মুখোমুখি হতে পারবেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দুর্ভাগ্য আর এ দেশের গরিব জনগণের গভীর বিষাদের বিষয় যে, চিকিৎসাসেবা লাভ যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার, সরকার-প্রধান যেখানে অনুদানে কোনো কার্পণ্য করেন না, সেখানে একজন বিখ্যাত চিকিৎসক আ ফ ম রুহুল হকের জমানায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতিপরায়ণদের যে উল্লাস দেখেছে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের একজন অন্যতম স্থপতি শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর পুত্র রাজপথের লড়াইয়ে উঠে আসা মোহাম্মদ নাসিমের জমানায় স্বাস্থ্য খাতের হরিলুটের তিক্ততা অর্জন করেছে মানুষ। লড়াকু রাজনীতিবিদ হয়েও তিনি দুর্নীতিবাজদের কেন রুখতে পারেননি? কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেননি? সেটা তিনিই বলতে পারবেন। আমি শুধু এ কথা বলতে চাই, দেশে-বিদেশে কে কী বলছে সেটি শুনিনি, তবে গণতন্ত্রের সংগ্রামের আলোকিত নেতা নাসিম মন্ত্রিত্বেই ধূসর। বর্ণহীন।

জাতীয় পার্টির মন্ত্রী কর্নেল মালেকপুত্র জাহিদ মালেককে সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্যমন্ত্রী করেছেন। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতিবাজদের দুদক তাড়া করছে। অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা হয়েছে। এমন দাবি তিনিও করতে পারবেন না। তিন মন্ত্রী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী হিসেবে স্বাস্থ্য খাতের মতো মানবিক খাতের দুর্নীতির দায় এড়াতে পারেন না। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যারা সচিব থেকে দাপুটে আমলা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, স্বাস্থ্য বিভাগে যেসব চিকিৎসক স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন, জনগণের টাকায় লেখাপড়া করে তাঁদের একটি বড় অংশও জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে মানুষের সঙ্গে নিমকহারামি করে দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের সঙ্গে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। ছোটবেলায় রচনা লিখতে গিয়ে যারা হৃদয় দিয়ে লিখেছিলেন লেখাপড়া করে ডাক্তার হবেন। ডাক্তার হয়ে গ্রামের মানুষের চিকিৎসাসেবা দেবেন, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। তারা মানুষের টাকায় লেখাপড়া করে মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাই করেননি, নিজের অঙ্গীকারের সঙ্গেও প্রতারণা করেছেন। জনগণের টাকায় লেখাপড়া করে জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনই করেননি, জনগণকে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করেছেন। তাদের চিকিৎসকদের সংগঠন ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বারবার তারা বদলি হয়ে আসছেন। চিকিৎসকদের অসুস্থ মানুষ আল্লাহর পরে পরম ভরসার জায়গা মনে করে। অর্থই যদি কামাবেন, নিজেকে যদি বিখ্যাত চিকিৎসকই মনে করেন, তাহলে সরকারি চিকিৎসক হয়ে লুটপাট কেন? বেসরকারি হাসপাতালে মোটা অঙ্কের বেতনে যোগ দিন। না হয় ঠিকাদারি করেন। আর যদি সরকারি চাকরি করেন, তাহলে মানুষের সেবক হিসেবে জনগণের টাকায় বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করবেন না। দুর্নীতির টাকায় যে বিত্তবৈভব, বিলাসী জীবন, সেখানে কেবলই দুর্গন্ধ, গ্লানি আর লজ্জা! মুখ দেখান কী করে?

গেল বছর স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা, যন্ত্রপাতি ব্যবহার, ওষুধ সরবরাহসহ ১১টি খাতে দুর্নীতি বেশি হয় বলে দুদক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ২৫ দফা সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিয়েছিল। দুদকের কমিশনার মোজাম্মেল হক খান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের হাতে সেই প্রতিবেদন তুলে দিয়েছিলেন গেল বছরের শুরুতে। সেই আলোকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা জানা না গেলেও দুর্নীতি যে বন্ধ হয়নি এবং তৃণমূলে মেশিন ব্যবহারে দক্ষ জনবল ও চিকিৎসক দিতে না পারলেও মেশিনসহ অন্য সবকিছু সরবরাহ করে দুর্নীতিগ্রস্ত সিন্ডিকেট লাভবান হচ্ছে সেটি সত্য। দুদকের প্রতিবেদনে অনিয়ম, দুর্নীতির তৃণমূল বিস্তৃত সিন্ডিকেট বা নেটওয়ার্কের ভয়াবহতার একাংশ উঠে এসেছিল। যার সমাধান এখনো হয়নি। মোট কথা অভিশপ্ত স্বাস্থ্য খাতের দায় তিন মন্ত্রী এড়াতে পারেন না। আমলা ও শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কর্তারাও নয়।

 

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর