শুক্রবার, ২৮ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

মহররম ও আশুরায় মুমিনদের করণীয়

মুফতি মুহাম্মদ এহছানুল হক

মহররম ও আশুরায় মুমিনদের করণীয়

মহররম মাস গুরুত্বপূর্ণ। হাদিসে চান্দ্রবর্ষের ১২ মাসের মধ্যে মহররমকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা আল্লাহর মাস বলা হয়েছে। আল কোরআনে মহররমকে অতি সম্মানিত মাস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুরা তওবার ৩৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আকাশম-লী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে মাস গণনায় মাস ১২টি, এর মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস, এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান।’ এ আয়াতে ‘আরবায়াতুন হুরুম’ মানে অতি সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ চার মাস বোঝানো হয়েছে। তা হলো- জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। এ চার মাসের মর্যাদা ও গুরুত্বের কারণে তখন সব যুদ্ধবিগ্রহ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। শত্রু-মিত্র সবাই এ চার মাসের মর্যাদা রক্ষা করে যুদ্ধ-কলহ থেকে দূরে থাকত।

আশুরার দিন বা মহররমের ১০ তারিখ যেসব তাৎপর্যময় ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল, সংক্ষেপে সেগুলো হলো :

১. এ দিন মহান আল্লাহ পৃথিবী সৃষ্টি করেন। আর এ দিনই কিয়ামত সংঘটিত হবে।

২. এ দিন আল্লাহ পৃথিবীর প্রতি রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করেন। ইবনে মাজাহ।

৩. এ দিন হজরত আদম (আ.) বেহেশত থেকে দুনিয়ায় নেমে আসেন। ১০ মহররম আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন এবং এ দিন তিনি স্ত্রী হাওয়া (আ.)-এর সঙ্গে আরাফার ময়দানে সাক্ষাৎ করেন।

৪. হজরত নুহ (আ.)-এর জাতির লোকেরা আল্লাহর গজব মহাপ্লাবনে নিপতিত হওয়ার পর ১০ মহররম তিনি নৌকা থেকে ইমানদারদের নিয়ে দুনিয়ায় অবতরণ করেন।

৫. হজরত ইবরাহিম (আ.) পাপিষ্ঠ নমরুদের অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ৪০ দিন পর ১০ মহররম সেখান থেকে মুক্তি লাভ করেন।

৬. হজরত আইয়ুব (আ.) ১৮ বছর কঠিন রোগভোগের পর মহররমের এই দিনে আল্লাহর রহমতে পরিপূর্ণ সুস্থতা লাভ করেন।

৭. হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর ছেলে ইউসুফ (আ.) তাঁর ১১ ভাইয়ের ষড়যন্ত্রে কূপে পতিত হন এবং এক বণিক দলের সহায়তায় মিসরে গিয়ে হাজির হন। তারপর আল্লাহর বিশেষ কুদরতে তিনি মিসরের প্রধানমন্ত্রী হন। ৪০ বছর পর ১০ মহররম পিতা ইয়াকুব (আ.)-এর সঙ্গে মিলিত হন।  ৮. হজরত ইউনুস (আ.) জাতির লোকদের প্রতি হতাশ হয়ে নদী অতিক্রম করে দেশান্তরিত হওয়ার সময় পানিতে পতিত হন এবং মাছ তাঁকে গিলে ফেলে। মাছের পেট থেকে তিনি আল্লাহর রহমতে ৪০ দিন পর মুক্তি পান ১০ মহররম।

৯. হজরত মুসা (আ.) ফিরাউনের অত্যাচারের কারণে তাঁর দলবলসহ অন্যত্র চলে যান। পথিমধ্যে নীল নদ পার হয়ে তিনি ফিরাউনের হাত থেকে আশুরার দিন মুক্তি পান। আর ফিরাউন তার দলবলসহ নীল নদে ডুবে মারা যায়।

১০. হজরত ঈসা (আ.)-এর জাতির লোকেরা তাঁকে হত্যার চেষ্টা করলে ১০ মহররম আল্লাহ তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নিয়ে মুক্তি দান করেন।

১০ মহররম মুসলিম ইতিহাসে এক হৃদয়বিদারক ঘটনার অবতারণা হয়। এ দিন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৬১ হিজরিতে রসুল (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.) কারবালার  প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে সপরিবারে শাহাদাতবরণ করেন।

ইসলামের ইতিহাসে আশুরার এই দিনে অনেক আম্বিয়ায়ে কিরাম মহান আল্লাহর সাহায্য ও কঠিন বিপদাপদ থেকে মুক্তি লাভ করেন। এর শুকরিয়া হিসেবে নবী-রসুল ও তাঁদের উম্মতরা রোজা পালন করতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রসুল (সা.) মদিনায় আগমন করে আশুরার দিন ইহুদিদের রোজা পালন করতে দেখলেন। তিনি জানতে পারলেন, এ দিন মুসা (আ.) তওরাত কিতাব লাভ করেন। এই দিনে তিনি ও তাঁর জাতির লোকেরা নীল নদ পার হয়ে ফিরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্তি লাভ করেন। তাই এর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য মুসা (আ.)-এর অনুসারী ইহুদিরা এ দিন রোজা রাখে। তখন মহানবী (সা.) ইহুদিদের লক্ষ্য করে বলেন, তোমাদের তুলনায় মুসা (আ.)-এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অধিকতর বেশি। সে হিসেবে এ ব্যাপারে আমরাই এর বেশি হকদার ও নিকটবর্তী। তখন থেকে মহানবী (সা.) নিজেও আশুরার রোজা পালন করতেন এবং উম্মতকেও তা পালনের নির্দেশ দিলেন।’ বুখারি, মুসলিম, মিশকাত। তবে প্রিয় নবী (সা.) ১০ মহররমের সঙ্গে ৯ বা ১১ মহররম মিলিয়ে দুটি রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। হাদিসে আছে, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আশুরার রোজা রাখতে হলে তার আগে বা পরেও একটি রোজা রাখবে। কারণ এটি যেন ইহুদিদের অনুকরণে না হয়।’ মুসলিম। আরও আছে, ‘আশুরার দিন যে ব্যক্তি নিজের পরিবারবর্গকে পরিতৃপ্ত করে খেতে ও পরতে দেবে, আল্লাহ তাকে সারা বছর পরিতৃপ্তিসহকারে খেতে ও পরতে দেবেন।’ বায়হাকি। প্রিয় নবী (সা.) আশুরার মর্যাদা সম্পর্কে বলেছেন, ‘রমজানের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা হলো মহররমের রোজা।’ মুসলিম। আশুরার রেজার গুরুত্ব সম্পর্কে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী, আল্লাহ এর অসিলায় অতীতের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ তিরমিজি, মুসলিম।

লেখক : বেতার টিভির ইসলামবিষয়ক উপস্থাপক।

সর্বশেষ খবর