সোমবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

জিন্নাহকে ভারত ভাগের দিকে ঠেলে দেয় কারা

সুমন পালিত

জিন্নাহকে ভারত ভাগের দিকে ঠেলে দেয় কারা

‘কায়েদে আজম’ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন তার ভিত্তি ছিল মুসলিম লীগের ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। অথচ এ প্রস্তাবে সুনির্দিষ্টভাবে পাকিস্তান নামের কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছিল ‘ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব এলাকাসমূহের মতো যেসব অঞ্চলে  ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ (স্টেটস) গঠন করা হবে, সে গঠনকারী এককগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।’  লাহোর প্রস্তাবে ভারতবর্ষে মুসলিমপ্রধান দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা প্রকাশ পায়। এর একটি পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান নিয়ে। অন্যটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অবিভক্ত বাংলা কিংবা বাংলা আসামকে নিয়ে আলাদা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। লাহোর প্রস্তাবের গাইডলাইন অনুযায়ী ১৯৪৭ সালে একদিকে পাকিস্তান এবং অন্যদিকে বাংলা ও আসাম প্রদেশ, কিংবা অখ- বাংলা বা পূর্ববাংলাকে নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে ’৭১ সালের ঘটনাবলির যে উদ্ভব হতো তা সহজেই অনুমেয়।

১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনের আগ পর্যন্ত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ অখ- ভারতের প্রবক্তা ছিলেন। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশরা বিদায় নেওয়ার পর স্বাধীন ভারতে মুসলমানরা যাতে ন্যায্য অধিকার নিয়ে মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারে। জিন্নাহর এই প্রত্যাশায় কোনো বাড়াবাড়ি ছিল না।

জিন্নাহ চেয়েছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রদেশগুলো স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে। এর ফলে মুসলিমপ্রধান প্রদেশগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের আধিপত্য থেকে নিরাপদ থাকবে। একইভাবে যেসব প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘিষ্ঠ সেখানে তাদের নির্দিষ্ট প্রতিনিধিত্ব থাকবে। মহাত্মা গান্ধী জিন্নাহর এ ফর্মুলা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু আপত্তি তোলেন জওহরলাল নেহরু। তিনি ভারতীয় জনগোষ্ঠীকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করার বিরোধী ছিলেন। নেহরু ছিলেন অগ্রসর ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী। তিনি এমন একটি ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখতেন যেখানে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ধর্মের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকবে না। তবে ভারতীয় সমাজ জীবনের প্রেক্ষাপটে সেটি বাস্তবসম্মত ছিল কিনা সেটি প্রশ্নের ঊর্ধে নয়। ১৮৫৭ সালের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম বা সিপাহি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা ভারতীয়দের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টিকে তাদের টিকে থাকার কৌশল হিসেবে বেছে নেয়। এর আগে ভারতের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে আলাদা জাতি ভাবার প্রবণতা ছিল না। কিন্তু ব্রিটিশরা নিজেদের স্বার্থে যে ভেদনীতি গ্রহণ করে তার পরিণতিতে দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ অনেকাংশে নষ্ট হয়ে যায়।

১৯২৭ সালের নভেম্বরে ভারতীয় শাসনতান্ত্রিক সমস্যা বিবেচনার জন্য সাইমন কমিশন নামের একটি ব্রিটিশ সংসদীয় কমিশন নিয়োগ করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে কংগ্রেসের উদ্যোগে ১৯২৮ সালের জানুয়ারিতে সর্বদলীয় সম্মেলনে একটি কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির কাজ ছিল স্বাধীন ভারতের জন্য শাসনতন্ত্রের মূলনীতি নির্ধারণ করা। বিশেষত ভারতবর্ষের ঐক্যের পক্ষে অন্তরায় সৃষ্টিকারী সাম্প্রদায়িক সমস্যা পর্যালোচনা করে ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের সঙ্গে এর সম্পর্ক নিরূপণ করা। ওই সম্মেলনে ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন মতামতের ২৮টি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। সম্মেলনে সর্বদলীয় কমিটি গঠন করা হলেও এটি ছিল পিতা-পুত্রের কমিটি। মতিলাল নেহেরু ছিলেন কমিটির সভাপতি। তিনি ছাড়া কমিটির অন্যান্য সদস্য ছিলেন আলী ইমাম, শোয়েব কোরেশী, এম এস অ্যানী, এম আর জয়াকর, জি আর প্রধান, সরদার মঙ্গল সিং, তেজ বাহাদুর সপ্রু ও এম এন যোশী। কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক মতিলাল নেহেরুর পুত্র প-িত জওহরলাল নেহরু কমিটির সচিব হিসেবে কাজ করেন।

কমিটি ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র প্রণয়ন সম্পর্কে যেসব সুপারিশের কথা বলে তার একটি ধারা ১৯১৬ সালের হিন্দু-মুসলিম সমঝোতাকে পুরোপুরি পাল্টে দেয়। রিপোর্টে ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমানদের ওপর কর্তৃত্ব করবে এমন আশঙ্কাকে অমূলক ভীতি হিসেবে অভিহিত করা হয়। কমিটি পৃথক নির্বাচনের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং যেসব প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু শুধু সেখানে তাদের জন্য কিছু আসন সংরক্ষণের সুপারিশ করে। তড়িঘড়ি করে প্রণীত খসড়া রিপোর্টটির অন্যান্য বৈশিষ্ট্য হলো : পূর্ণ দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার প্রতি দৃষ্টি রেখে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস অর্জন; দেশীয় রাজ্যসমূহের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধাদি বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনতন্ত্রের ব্যবস্থা রাখা; উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জন্য একটি পূর্ণ মর্যাদার প্রদেশ প্রতিষ্ঠা; শাসনতন্ত্রে অধিকারসমূহের ঘোষণা অন্তর্ভুক্ত করা। নেহেরু রিপোর্ট মুসলমানদের দারুণভাবে হতাশ করে। যে জিন্নাহ ছিলেন ভারত ভাগের বিরুদ্ধে, তার মন বিষিয়ে দেয় এ রিপোর্ট। নেহেরু রিপোর্টকে কেন্দ্র করে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে প-িত জওহর লাল নেহরুর বিসংবাদও সৃষ্টি হয়। নেহরু প্রস্তাবের পর স্বাধীন ভারতে মুসলমানদের সম্মানজনক অস্তিত্ব রক্ষার অজুহাতে জিন্নাহ ১৯২৯ সালের ২৮ মার্চ দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সম্মেলনে ১৪ দফা প্রস্তাব দেন। এতে বলা হয়, ভবিষ্যৎ সংবিধানের রূপ হবে ফেডারেল পদ্ধতির, যেখানে প্রাদেশিক বিষয় প্রদেশের হাতে অর্পিত হবে। সকল প্রদেশের একই প্রকার স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে হবে।

রাষ্ট্রের সব আইনসভা ও অন্যান্য নির্বাচিত সভা নির্দিষ্ট নিয়মের ভিত্তিতে নির্বাচিত হবে এবং সব প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব হ্রাস না করে সংখ্যালঘুদের কার্যকরী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে অথবা প্রতিনিধিত্ব সমান করতে হবে। কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম প্রতিনিধিত্ব এক-তৃতীয়াংশের কম হতে পারবে না। সম্প্রদায়গত গোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে বর্তমানের মতো পৃথক নির্বাচন চালু থাকবে, নিশ্চিত করা হবে যে, যেকোনো সম্প্রদায় যুক্ত নির্বাচনের স্বার্থে পৃথক নির্বাচন ত্যাগের অধিকার রাখবে। আঞ্চলিক পুনর্বিন্যাস করা হলে তা মুসলিম সংখ্যাগুরুদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারবে না। পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা, অর্থাৎ, বিশ্বাস, উপাসনা ও রীতি, প্রচারকার্য, সংগঠন ও শিক্ষা, সব সম্প্রদায়ের জন্য সুরক্ষিত করতে হবে।

কোনো আইনসভা বা নির্বাচিত প্রতিনিধি সভা এমন কোনো বিল বা প্রস্তাব পাস করতে পারবে না যাতে সে সভার কোনো সম্প্রদায়ের সদস্যদের তিন-চতুর্থাংশের সম্মতি নেই। বোম্বে প্রেসিডেন্সি থেকে সিন্ধু পৃথক করতে হবে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানে অন্যান্য প্রদেশের মতো সংস্কার করতে হবে।

অন্য ভারতীয়দের মতো রাষ্ট্র ও অন্যান্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতা সাপেক্ষে মুসলিমদের পর্যাপ্ত অংশ নিশ্চিতকরণে সংবিধানে বিধান রাখতে হবে।

মুসলিম সংস্কৃতি, শিক্ষা, ভাষা, ধর্ম, ব্যক্তিগত আইন ও মুসলিম দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষা এবং রাষ্ট্র ও আঞ্চলিক সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অনুদানের সুরক্ষায় সংবিধানে বিধান রাখতে হবে। কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক, কোনো মন্ত্রিসভা কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ মুসলিম মন্ত্রী ছাড়া গঠিত হতে পারবে না। কেন্দ্রীয় আইনসভা কর্তৃক সংবিধানের কোনো পরিবর্তন ভারতীয় ফেডারেশনের অঙ্গরাজ্যের ঐকমত্য ছাড়া করা হবে না।

জিন্নাহর ১৪ দফা প্রস্তাবে স্বাধীন ভারতে মুসলমানদের সম্মানজনক অবস্থানের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। ভারত ভাগের কিংবা মুসলমানদের নিয়ে স্বাধীন দেশ গঠনের কোনো আগ্রহ সে সময় জিন্নাহর মাথায় ছিল না। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ জিন্নাহর ১৪ দফাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যানের চরমপন্থা বেছে নেন। জওহর লাল নেহরু জিন্নাহর প্রস্তাবকে ‘হাস্যকর’ হিসেবে অভিহিত করেন। ব্রিটিশ সরকার রাজনৈতিক সংস্কার সম্পর্কে আলোচনার জন্য গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু গোলটেবিল বৈঠক নিষ্ফল হয়ে যায় জিন্নাহর ১৪ দফা সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের অনুদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। অন্যদিকে কংগ্রেস সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব নির্ধারণে আপত্তি জানায়। একই সময়ে অভিজাত সম্প্রদায় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মুসলিম লীগে জিন্নাহকে কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়।

১৯৩০ সালে লন্ডনে যে প্রথম গোলটেবিল বৈঠক হয় তাতে জিন্নাহকে প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া হয়নি। জিন্নাহর কোনো বক্তব্যই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কিংবা কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ বিবেচনায় আনতে রাজি ছিল না। দ্বিতীয় বৈঠকে মুসলিম লীগ প্রতিনিধি দলের নেতা করা হয় তৃতীয় আগা খানকে। ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের এই শীর্ষ আধ্যাত্মিক নেতা ছিলেন ব্রিটিশদের অতি প্রিয়পাত্র। অন্যদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্ব দেন মহাত্মা গান্ধী। তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠকে জিন্নাহকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি খোদ মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে। জিন্নাহ বুঝতে পারেন কংগ্রেস কিংবা ব্রিটিশ শাসক শুধু নয়, মুসলিম লীগের নবাব-জমিদার অভিজাত নেতারাও তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাধ্য হয়ে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার কথা ভাবেন। ১৯৩১ সালে জিন্নাহ স্থায়ীভাবে লন্ডনে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। বোম্বে তথা ভারতের সেরা আইনজীবী লন্ডনে প্রিভি কাউন্সিল বারে আইন ব্যবসাও শুরু করেন।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে মুসলমান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়। এ আইন অনভিজাত অর্থাৎ জমিদার বা নবাব নয় এমন জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মুসলিম নেতৃবৃন্দের আহ্বানে জিন্নাহ ভারতে ফিরে এসে মুসলিম লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। নতুন ভারত শাসন আইনের অধীনে ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দেখা যায় ভারতের ১০ কোটি মুসলমান সংঘবদ্ধ সম্প্রদায় হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। তারা ছিল বিচ্ছিন্ন, একে অপরের কাছে অনেকটা অপরিচিত এবং ধর্ম ছাড়া তাদের মধ্যে অন্য কোনো যোগসূত্র ছিল না। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলমান হলেও সেখানে কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম লীগ একটি আসনও পেল না। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাবে মুসলমানরা বিভিন্ন পুরনো দলের পতাকাতলে সংঘবদ্ধ হয়। জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন পুনরুজ্জীবিত মুসলিম লীগের প্রতি তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না। সিন্ধু প্রদেশে মুসলমানরা মুসলিম লীগকে পাত্তা না দিয়ে ভারত বিভক্তির বিরোধিতা করে কংগ্রেসের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। নির্বাচনে মুসলিম লীগ শুধু বাংলায় জয়লাভ করে এবং কৃষক প্রজা পার্টির নেতা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করে।

১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে প্রথমবারের মতো ভারতবর্ষের মুসলমানদের জন্য একাধিক স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ প্রস্তাব পেশ করেন ভারতবর্ষের সবচেয়ে বেশি মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত প্রদেশ অখ- বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক।

মুসলিম লীগের ‘লাহোর প্রস্তাবে’ ভারত বর্ষের মুসলমানদের জন্য একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করা হলেও অধিবেশনে যোগদানকারী নেতাদের মাথায় পাকিস্তান নামের কোনো কিছু ছিল না। কিন্তু কংগ্রেস সমর্থক পত্রিকাগুলো একে ‘পাকিস্তান’ প্রস্তাব নামে অভিহিত করে। তাদের সুসংবদ্ধ প্রচারণায় লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তান প্রস্তাব হিসেবে পরিচিতি পায়। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজে বসবাসকারী ভারতীয় মুসলমান রহমত আলী পাকিস্তান নামের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। পাঞ্জাব, আফগান বা পাঠান অধ্যুষিত উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, কাশ্মীর, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান নিয়ে এ রাষ্ট্রটি গঠিত হওয়ার কথা। রহমত আলীর মাথায় বাংলার মুসলমানদের কোনো ঠাঁই ছিল না। যদিও ভারতবর্ষের অন্য যে কোনো এলাকার চেয়ে অবিভক্ত বাংলায় মুসলমানের সংখ্যা ছিল বেশি।

মুসলিম লীগের সে সময়কার সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে অবিভক্ত বাংলার হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের অবিসংবাদিত নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের মানসিক দ্বন্দ্ব ছিল বেশ প্রকট। শেরেবাংলা মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে জিন্নাহর অধিষ্ঠানকে সম্ভবত প্রচ্ছন্নভাবে মেনে নিতে পারেননি।

অন্যদিকে বাঙালি মুসলমানদের জননন্দিত নেতা শেরেবাংলার প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্পর্কে জিন্নাহর মধ্যে শঙ্কা ছিল। শেরেবাংলার রাজনীতিতে হাতেখড়ি ঢাকার নবাব এবং মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা স্যার খাজা সলিমুল্লাহ ও নওয়াব আলী চৌধুরীর কাছে। ১৯১৩ সালে তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন। সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক পদেও অধিষ্ঠিত হন তিনি। ১৯১৬ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন শেরেবাংলা। মুসলিম লীগের রাজনীতিতে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক জড়িত হন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আগে। দলে জিন্নাহর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল প্রতিপক্ষ কংগ্রেস এবং ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে দর কষাকষির ক্ষেত্রে তার অসামান্য যোগ্যতার কারণে। জিন্নাহ ছিলেন তার সময়ের অপ্রতিদ্বন্দ্বী আইনজীবী। যুক্তিতর্কের লড়াইয়ে তাকে হারানোর সাধ্য ভারতবর্ষের অন্য কোনো নেতার ছিল না। তবে জিন্নাহ একই সঙ্গে ছিলেন স্ববিরোধী চরিত্রের প্রতিকৃতি। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে জিন্নাহর প্রভাব গড়ে উঠলেও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের মতো কোনো বিশেষ এলাকায় তার সম্মোহনী ভাবমূর্তি গড়ে ওঠেনি। তিনি ধর্মাচারের ধার না ধারলেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে নিজের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। জিন্নাহর অস্ত্র ছিল রাজনৈতিক ইসলাম।  এই ট্রাম্পকার্ড ব্যবহার করে তিনি প্রায় শূন্য অবস্থান থেকে মুসলিম লীগকে মুসলিম সম্প্রদায়ের সমর্থনপুষ্ট জনপ্রিয় দলে পরিণত করতে সক্ষম হন।  কংগ্রেসের উপেক্ষা এবং মুসলিম স্বার্থ রক্ষায় আপত্তি মুসলিম লীগ শুধু নয়,  জিন্নাহকে মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর