রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

নেতাজি এবং আমাদের পাঠ্যপুস্তক

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

নেতাজি এবং আমাদের পাঠ্যপুস্তক

গত ২৩ জানুয়ারি ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন। দু-একটি পত্রিকায় লেখনী, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অনুষ্ঠান এবং একটি নেতাজি গবেষণা সংস্থা ছাড়া তেমন কোনো অনুষ্ঠান হয়নি নেতাজির ওপর। অথচ এই মহান ব্যক্তির সম্পর্কে আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন ছোটবেলা থেকেই নেতাজির প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ আকর্ষণ এবং তাঁর কর্মকান্ড দিয়ে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বঙ্গবন্ধু এবং নেতাজির মধ্যে ছিল বহু মিল। দুজনই ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির ছিলেন অতন্দ্রপ্রহরী, দুজনই দেশ স্বাধীন করার জন্য প্রথম গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় চেষ্টা করে পরে লড়াইয়ের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দুজনই ছিলেন অগ্নিবর্ষী বক্তা, দুজনের বক্তৃতায়ই থাকত সম্মোহনী শক্তি; যা শুনে মানুষ আপ্লুত হতো, দুজনই ছিলেন নীতির প্রশ্নে আপসহীন, দুজনই জীবন বিসর্জন করেছিলেন দেশের স্বাধীনতার জন্য, দুজনেরই জীবনের একমাত্র চাওয়া ছিল দেশের মানুষকে শৃঙ্খলমুক্ত করা। অথচ এই আত্মত্যাগী মহাবিপ্লবী নেতা আজ বাংলাদেশে অনেকটাই অপরিচিত।

কয়েক মাস আগে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সটার্নাল আইনের ছাত্রদের জন্য ঢাকাভিত্তিক এক শিক্ষায়তনে শিক্ষাদানের সময় প্রসঙ্গক্রমে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের কথা উঠলে দেখলাম ক্লাসের ৪০ জনের মতো ছাত্রছাত্রীর, যাদের সবাই হয় যুক্তরাজ্যের এ লেভেল বা বাংলাদেশের এইচএসসি পাস, কেউই জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাযজ্ঞের কথা দূরে থাক, তারা জালিয়ানওয়ালাবাগের নামও কখনো শোনেনি। আর একদিন এক স্নাতক ডিগ্রিধারী লোকের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর কথা উঠলে তিনি বলেছিলেন এটি কলকাতা বিমানবন্দরের নাম। দুটি ঘটনায় বিস্মিত হয়ে ভাবলাম একটি বিরাট জনসংখ্যা আমাদের ইতিহাস না জানার জন্য দায়ী আমাদের পাঠ্যব্যবস্থা, পাঠ্যপুস্তক। আমরা স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করেছি ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান আমলে। তখনো আমরা জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুসহ অগ্নিযুগের বাঘা যতীন, মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ক্ষুদিরাম বসু প্রমুখের কথা পড়েছি, পড়েছি রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সৈয়দ আমির আলী, স্যার সৈয়দ আহমদ, শ্রীচৈতন্য দেব, কাঙ্গাল হরিনাথ প্রমুখ মনীষীর কথা। অথচ আজ ধর্মনিরপেক্ষ দেশে পাঠ্যব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতা এত শক্ত অবস্থানে পৌঁছেছে যে, এসব লোকের কথা পড়ানো হয় না, যাঁরা আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, নেতাজির ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’, যারা আসামের ইম্ফল দখল করেছিলেন ১৯৪৩-৪৪ সালে এবং যা দেখে ইংরেজ নিয়ন্ত্রিত ভারতের বহু নৌসেনা ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজ্যের অস্তিত্ব কঠোর আঘাত না হানলে তারা ভারতবর্ষ ত্যাগ করতেন না। এসব কারণে ব্রিটিশ শাসকরা ভারতবর্ষে তাদের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারাচ্ছন্ন বলে মনে করতে বাধ্য হয়েছিলেন। মহাত্মা গান্ধীজির অবদান নিশ্চয়ই অনস্বীকার্য হলেও এটা বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে, তাঁর অহিংস অসহযোগ ব্রিটিশ শাসকদের ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য করেনি। তারা সিপাহি বিপ্লবের কথা ভেবে আজাদ হিন্দ ফৌজের কয়েক হাজার সৈন্যের দৃঢ়প্রত্যয় এবং যুদ্ধে পারদর্শিতা দেখেই ভারত ছেড়েছে। আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যরা যেহেতু মূলত ব্রিটিশ ভারতীয় সৈন্যদের দ্বারা গঠিত তাই ইংরেজদের মনে শঙ্কা হয়েছিল একসময় ব্রিটিশ ভারতের ভারতবর্ষীয় সৈন্যদের বিরাট অংশ ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে আর সে ভয়ই তাদের ভারতত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। এ কথাগুলোর সমর্থন পাওয়া যায় সে সময়ের ইংরেজ বড়লাট লর্ড ওয়াভেলের পাঠানো গোপন বার্তা থেকে, যাতে তিনি লিখেছিলেন সুভাষ বসু যেভাবে লড়াই করে ভারতবাসীকে অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন তাতে আর বেশি দিন ভারতকে ব্রিটিশ শাসনে রাখা যাবে না।

বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গান্ধী এবং সুভাষ বসু উভয়ের পন্থাই অবলম্বন করেছিলেন বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে। প্রথম তিনি গান্ধীপন্থায় অহিংস পথে নির্বাচনের মাধ্যমে চেষ্টা করলেন এবং সে পন্থায় স্বাধীনতা না পাওয়ায় অবশেষে নেতাজির অস্ত্র হাতে নেওয়ার পন্থায় দেশ স্বাধীন করেছিলেন। অবশ্য বিশ্বের সমর্থন পাওয়ার জন্য প্রথমে অহিংস পথে নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টাও ছিল একান্ত আবশ্যকীয়, নয় তো যুদ্ধে যাওয়ার পন্থায় সাফল্যের দ্বারে পৌঁছানো সম্ভব নাও হতে পারত।

অবিভক্ত ভারতবর্ষে যেসব নেতা অসাম্প্রদায়িকতার শীর্ষে ছিলেন বঙ্গবন্ধুসহ নেতাজি সুভাষ বসু ছিলেন তাঁদের অন্যতম। আর যাঁদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় তাঁদের মধ্যে ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা শওকত আলী, মোহাম্মদ আলী, শরৎচন্দ্র বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা ফজলুল হক। মহাত্মা গান্ধী, পন্ডিত নেহরু, সরোজিনী নাইডু, ডা. বিধানচন্দ্র রায়, গোপালকৃষ্ণ গোখলে, আবুল হাশিম প্রমুখকেও এ তালিকার শেষের দিকে রাখা যায়। পন্ডিত নেহরু লিখেছিলেন তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িকতার তত্ত্ব পেয়েছেন মুঘল সম্রাট আকবরের নীতি থেকে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং নেতাজির মধ্যে কে বেশি ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন তা দাঁড়িপাল্লায় তুললে নির্ধারণ করা কঠিন হবে। ১৯২৬ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু জেলখানায় বসেই বলেছিলেন একজন হিন্দু হয়েও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন মুসলমানদের পরম বন্ধু। অন্যদিকে নেতাজির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজনদের বিরাট অংশ ছিলেন মুসলমান। তাঁর সবচেয়ে কাছের মানুষটি ছিলেন কর্নেল জয়নাল আবেদিন সাফরানি, যার নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ সৈন্যরা আসামের ইম্ফল দখল করেছিলেন। তা ছাড়া তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে ছিলেন কর্নেল হাবিবুর রহমান, ক্যাপ্টেন শাহনেওয়াজ, লোকমান খান শেরওয়ানিসহ আরও অনেক মুসলিম বিপ্লবী। তিনি ভারতের জাতীয় সংগীত লেখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন কর্নেল জয়নাল আবেদিন সাফরানি, যিনি একজন কবিও ছিলেন এবং মোমতাজ হোসেনকে। স্বামী বিবেকানন্দ এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অনুসারী হিসেবেই নেতাজি অসাম্প্রদায়িকতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাদের মধ্যে ধর্মীয় ব্যবধানে ভিন্ন ভিন্ন পাকে খাওয়ার ব্যবস্থা বিলোপ করে এক পাকে খাওয়ার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। নেতাজি কলকাতার মেয়র থাকাকালে বহু মুসলমানকে সেখানে চাকরি দিয়েছেন।

১৯৩৮ সালে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালে ঘোষণা করেছিলেন তাঁর দলে হিন্দু এবং মুসলিম চরমপন্থিদের কোনো স্থান নেই। তিনি তাঁর বই ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল-এ চরম উগ্রহিন্দুবাদকে আক্রমণ করতে ছাড়েননি। নেতাজি ১৯৪৩ সালের ১৮ জুলাই ব্যাংকক রেডিওর মাধ্যমে এ জন্য সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন যে, আজাদ হিন্দ ফৌজে তখন মুসলমানের সংখ্যা বেশি ছিল এবং সাম্প্রদায়িক প্রীতি ছিল সত্যি গর্ব করার মতো।

তিনি আজাদ হিন্দ সৈন্যদের জন্য একটি স্লোগান তৈরি করতে বললে জয়নাল আবেদিন সাফরানি ‘জয় হিন্দ’ শব্দ প্রস্তাব করেন এবং নেতাজি তা গ্রহণ করেন।

তাঁকে ‘নেতাজি’ উপাধিটি দিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে হিটলারও তাঁকে ‘ফুহরার’ (নেতা) বলে সম্বোধন করেছিলেন।

জালিওয়ানওয়ালাবাগ হত্যাযজ্ঞের পর তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস ট্রেনিং প্রক্রিয়া থেকে ইস্তফা দিয়ে ১৯২০ সালে লন্ডন ছেড়ে ভারতে ফিরে আসেন।

ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান দখল করার পরও তিনি অত্যন্ত লোভনীয় পদে চাকরি না নিয়ে ভারতবর্ষকে ইংরেজ শৃঙ্খলমুক্ত করার প্রত্যয় নিয়ে রাজনীতিতে নেমে পড়েন দেশবন্ধুর আহ্বানে। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত তাঁর বই দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল-এ তিনি স্বাধীন ভারতের চিত্রপট তুলে ধরেছিলেন। তাঁর মোটো ছিল- একতা, বিশ্বাস, আত্মত্যাগ। তিনি প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন মানবিক রূপের সমাজতন্ত্র, যে তত্ত্ব সম্পর্কে তিনি টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেওয়ার সময় বিশদ আলোচনা করেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতায় তিনি ছিলেন কঠোর। তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতির পদও পেয়েছিলেন, ছিলেন কলকাতার মেয়র। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর অহিংস তত্ত্বের মাধ্যমে ইংরেজ তাড়ানোর নীতির সঙ্গে একমত হতে পারেননি। যার কারণ তিনি দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল পুস্তকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি এক বোধাতীত, অলৌকিক পন্থায় ইংরেজদের জেল থেকে মুক্তি পেয়ে অবশেষে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে ইংরেজ নিয়ন্ত্রিত গোয়েন্দা, পুলিশ এবং প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে যেভাবে আফগানিস্তান হয়ে জার্মানি পৌঁছেছিলেন সেটি এক বিস্ময়ের ব্যাপার বইকি? অনেকে মনে করেন দৈবিক ক্ষমতা দিয়েই তিনি সেটি পেরেছিলেন। তিনি মোটেও নাৎসিবাদের বা ফ্যাসিস্টের সমর্থক ছিলেন না। তাঁর নীতি ছিল ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’। তিনি জাপানিদের যুদ্ধজয়েও আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জন। জাপানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আণবিক বোমা নিক্ষেপের পরে তিনি মিত্রশক্তির অন্যতম দেশ রাশিয়ার সাহায্যে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার জন্য রাশিয়ায় চলে গিয়েছিলেন বলে কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। বাঘা যতীন ভারতবর্ষে জার্মানির অস্ত্র এনে দেশ স্বাধীন করার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ায় এবং মাস্টারদা সূর্য সেন ইংরেজদের অস্ত্র দখল করে দেশ স্বাধীন করার চেষ্টা বিফল হওয়ায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাঘা যতীন ও মাস্টারদার পন্থায় দেশ স্বাধীন করা যাবে না আর তাই তিনি প্রথম জার্মানি ও পরে জাপান গিয়েছিলেন তাদের সাহায্যে ভারতবর্ষ স্বাধীন করতে, তবে সেসব ভারতীয় সৈন্যের দ্বারা যারা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে জাপানিদের হাতে বন্দী হয়েছিলেন।

নেতাজি সিঙ্গাপুর পৌঁছেই সেখানকার রেডিও মারফত ভারতবাসীর উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’, তাঁর এ বাণীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বিশ্বনন্দিত ৭ মার্চের সেই কথার তত্ত্বগত মিল রয়েছে যেখানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’ বাঘা যতীনেরও একই ধরনের মতবাদ ছিল। তিনি বলেছিলেন, আমরা মরব, দেশ স্বাধীন হবে।

নেতাজির সেই অমর স্লোগান ‘চল চল দিল্লি চল’ তিনি সিঙ্গাপুর বেতার কেন্দ্র থেকেই উচ্চারণ করে ভারতবাসীকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তিনি বলতেন, ‘আদর্শ তৈরি করতে জীবন চলেও যেতে পারে, কিন্তু মৃত্যুর পর আদর্শ অন্যদের প্রেরণা জোগাবে।’ তিনি আরও বলতেন, রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করলে স্বাধীনতার মর্ম বোঝা যায়। তাঁর কথা ছিল ‘স্বাধীনতা কেউ দেয় না, এটা ছিনিয়ে নিতে হয়।’ তিনি বলতেন, ইংরেজ ভারতবর্ষে তাদের শাসন পাকাপোক্ত করার জন্যই হিন্দু-মুসলমান বিভক্তির নীতির সূচনা করেছে, তাই ইংরেজ বিদায় হলে এ বিভেদেরও সমাপ্তি ঘটবে।

নেতাজিও কিন্তু গণতান্ত্রিক উপায়ই বেছে নিয়েছিলেন, যার প্রমাণ তাঁর কংগ্রেস সভাপতির পদ গ্রহণ এবং ১৯৩০ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে কলকাতার মেয়র হওয়া।

নেতাজির বড় ভাই ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা শরৎচন্দ্র বসু শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম সাহেবের সঙ্গে মিলে সংযুক্ত স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা করেছিলেন; কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট কংগ্রেস নেতা বল্লভ ভাই প্যাটেল এবং মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তা নস্যাৎ করে দেন। নেতাজি বা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কংগ্রেসের নেতৃত্বে থাকলে জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব কখনো সফল হতো না, ১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলমানের রক্তে ভারতবর্ষের মাটি লাল হতো না।

স্বাধীন-সার্বভৌম ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে যদি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মওলানা মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী, মওলানা আজাদ, বাঘা যতীন, মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ক্ষুদিরাম বসু, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্যার সৈয়দ আহমদ, সৈয়দ আমির আলী, কাঙ্গাল হরিনাথ, শ্রীচৈতন্য দেব, স্বামী বিবেকানন্দদের কথা না লেখা থাকে, যদি জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের কথা এবং এ হত্যাকান্ডের পর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘স্যার’ উপাধি বর্জন করেছিলেন, এসব কথা না লেখা হয় তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দেশের ইতিহাসের জ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে যাবে, যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। এ উদ্দেশ্যে আমাদের পাঠ্যপুস্তক কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই সাম্প্রদায়িকতামুক্ত করতে হবে। সাম্প্রদায়িক অপশক্তিগুলোর চাপ অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর লেখাগুলো ব্যাপকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পশ্চিম বাংলায় নেতাজিকে নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে, বিশেষ করে অন্তিমে তাঁর কী হয়েছিল এ প্রশ্ন নিয়ে এখনো গবেষণারত রয়েছেন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী, সাবেক বিধায়ক কবীর সুমন। গবেষণাভিত্তিক ছবি করেছেন প্রখ্যাত পরিচালক শ্যাম বেনেগল ও সৃজিত মুখোপাধ্যায়। আশা করা যায়, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর নেতাজি আইডিওলজি নামক ঢাকাভিত্তিক সংস্থা তাদের গবেষণা এবং প্রচারের পরিধি বাড়িয়ে এই যুগান্তকারী নেতার স্মৃতি অম্লান করে রাখবে।

শেষ মুহূর্তে নেতাজির কী হয়েছিল, সে প্রশ্নে এখনো রয়েছে ধূম্রজাল। বিচারপতি মুখার্জি কমিশনে সাক্ষ্য দিয়ে কর্নেল হাবিবুর রহমান দাবি করেছেন, তিনি এবং নেতাজি ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইওয়ানে এক যুদ্ধবিমানে চড়লে বিমানটি কিছু দূর ওঠার পর নিচে পড়ে যায়, এতে আগুন ধরে যায়, যে আগুনেই নেতাজির মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এ দাবি অনেকে মেনে নিতে পারছেন না। এ ছাড়া শাহনেওয়াজ কমিশন এবং প্রধান বিচারপতি খোশলা কমিশনের প্রতিবেদনেও ধূম্রজাল কাটেনি। নেতাজির শেষ পরিণতি কী হয়েছিল এ প্রশ্ন থেকেই গেল। কয়েক বছর আগে উত্তর প্রদেশে গুমনামি বাবা নামে এক সাধুর আবির্ভাব হলে অনেকে তাকে নেতাজি ভাবতে থাকেন। অবশ্য সেই সাধুও এখন মৃত।

পত্রিকার খবরে প্রকাশ, ভারত সরকার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মতিথি উদ্যাপন উপলক্ষে ৮৪ জনের সমন্বয়ে একটি উচ্চমর্যাদার কমিটি গঠন করেছে, যাতে রয়েছেন ভারতের প্রতিটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীগণ, কয়েকজন রাজ্যপাল, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, সৌরভ গাঙ্গুলী, অস্কার পদকপ্রাপ্ত সংগীত পরিচালক এ আর রহমান, মিঠুন চক্রবর্তী, বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী প্রমুখ বিশিষ্টজন। কমিটির নেতৃত্বে থাকবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী  নরেন্দ্র মোদি। আমাদের গর্বিত করে উক্ত অভিজাত কমিটিতে রাখা হয়েছে আশরাফুল ইসলাম নামক এক বাংলাদেশি নাগরিককে, যিনি ঢাকাভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর নেতাজি আইডিওলজি’ নামক সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। জানা গেছে, এই ভদ্রলোক এক দশকের বেশি সময় নেতাজির মহান আদর্শের চর্চায় তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে আসছিলেন। উল্লিখিত গৌরবময় কমিটিতে তাঁর বিরল অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতভাবে গোটা বাংলাদেশকে গৌরবান্বিত করেছে, যার কারণে তিনি সবার অভিনন্দন পাওয়ার দাবিদার। তিনি যে নেতাজিকে নিয়ে গবেষণা করেছেন সে কথা আমার মতো অনেকেরই জানা ছিল না।

এ মাসেই কবির খান নামক এক ভারতীয় গুণীজন অ্যামাজনের স্টুডিওতে তৈরি করেছেন ‘আজাদি কি লিয়ে’ নামে নেতাজির ওপর শ্রদ্ধাঞ্জলিমূলক এক ভিডিও, যাতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাদের বীরত্বগাথার ওপর। নেতাজির ওপর চলবে আরও গবেষণা। কিন্তু তাতে আমাদেরও শরিক হতে হবে, যার জন্য স্কুলপর্যায় থেকেই জানতে হবে এই মহান আত্মত্যাগীকে। তাঁকে কোনো অবস্থায়ই ভারতের নেতা ভাবার সুযোগ নেই। তিনি যুদ্ধ করেছিলেন অবিভক্ত গোটা উপমহাদেশের মুক্তির জন্য।

            লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর