বৃহস্পতিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর (রা.)

এম এ মান্নান

আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর (রা.)

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) মক্কার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। ইসলাম প্রচারকালে কুরাইশদের মধ্যে সর্বসাকল্যে ১৭ জন শিক্ষিত লোক ছিলেন। হজরত ওমর (রা.) ছিলেন তাদের অন্যতম। ইসলাম প্রচারের আগে তিনি ছিলেন এ ধর্মের অন্যতম শত্রু। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যার অভিলাষও ব্যক্ত করেছিলেন হজরত ওমর (রা.)। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর তিনি রসুল নামের পরশ পাথরের স্পর্শে সোনার মানুষে পরিণত হন। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন তার পর যদি কেউ নবী হতেন তবে তিনি ওমর (রা.)। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা বিশাল ইসলামী হুকুমতের শাসক হওয়া সত্ত্বেও অতি সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন। তাঁর শাসনাধীন রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করাকে নিজের কর্তব্য বলে ভাবতেন। সারা দিন কঠোর পরিশ্রম করা সত্ত্বেও রাত জেগে প্রজাদের খোঁজখবর নিতে বেরিয়ে পড়তেন। কোথাও কারও অভাব-অনটন ও দুর্ভোগ চোখে পড়লে নিরসনের চেষ্টা করতেন। আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর (রা.)-এর গোলাম আসলাম (রা.) বলেন, ‘একবার আমি খলিফার সঙ্গে মদিনার মরুভূমি হাররার দিকে যাচ্ছিলাম। দূরে এক স্থানে আগুন জ্বলতে দেখা গেল। হজরত ওমর (রা.) বললেন হয়তো কোনো কাফেলা হবে, যারা রাত হয়ে যাওয়ায় শহরে প্রবেশ না করে বাইরে অবস্থান করছে। চল আমরা তাদের খোঁজখবর ও অবস্থা জেনে আসি। প্রয়োজনে তাদের পাহারার ব্যবস্থা করে দেব। হজরত ওমর (রা.) সেখানে পৌঁছে দেখতে পেলেন একজন মহিলার সঙ্গে কয়েকজন শিশু বাচ্চা রয়েছে। যারা কাঁদছে তো কাঁদছে। আর চুলার ওপর পানি ভরা একটি হাঁড়ি রয়েছে তার নিচে আগুন জ্বলছে। তিনি দূর থেকে সালাম দিয়ে মহিলাটির কাছে গেলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন এই শিশুরা কেন কাঁদছে? মহিলাটি বলল ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন এ হাঁড়িতে কী? মহিলাটি বলল এদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য পানিভরা হাঁড়ি চুলার ওপর রেখে দিয়েছি যেন এরা দেখে শান্ত হয় এবং ঘুমিয়ে পড়ে। মহিলাটি আরও বলল আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর (রা.) ও আমার ফয়সালা আল্লাহর দরবারেই হবে, কেন তিনি আমার এ দুরবস্থার খবর নেন না। হজরত ওমর (রা.) মহিলাটির এ কথা শুনে কাঁদতে শুরু করলেন এবং বললেন আল্লাহ তোমার প্রতি দয়া করুন। ওমর কি তোমার দুরবস্থার কথা জানেন? মহিলা বলল তিনি আমাদের আমির হয়েছেন অথচ তিনি আমাদের দুরবস্থার খবর রাখবেন না!’

আসলাম (রা.) বলেন, ‘হজরত ওমর (রা.) আমাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন এবং একটি বস্তায় বায়তুল মাল (রাষ্ট্রীয় কোষাগার) থেকে কিছু আটা, খেজুর, চর্বি, কয়েকটি কাপড় এবং কিছু দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) ভরে নিলেন। আমাকে বললেন এ বস্তাটি আমার পিঠের ওপর উঠিয়ে দাও। আমি বললাম এটি আমিই নিয়ে যাব। তিনি বললেন না, আমার ওপরই তুলে দাও। দু-তিনবার যখন আমি একই কথা বললাম তখন তিনি বললেন কিয়ামতের দিনেও কি তুমি আমার বোঝা বহন করবে? এটা আমিই বহন করব। কেননা কিয়ামত দিবসে আমাকেই জবাবদিহি করতে হবে। অবশেষে বাধ্য হয়েই বস্তাটি তার পিঠে উঠিয়ে দিলাম। এরপর তিনি অতি দ্রুতবেগে মালামালগুলো মহিলার কাছে নিয়ে পৌঁছালেন। আমিও সঙ্গে ছিলাম, সেখানে পৌঁছে তিনি নিজেই সেই হাঁড়িতে কিছু আটা, চর্বি এবং খেজুর রেখে রান্না শুরু করলেন এবং নিজেই চুলায় ফুঁকাতে শুরু করলেন। আসলাম (রা.) বলেন, হজরত ওমর (রা.)-এর ঘন দাড়ির ভিতর দিয়ে ধোঁয়া বের হতে দেখছিলাম। একপর্যায়ে হারিরাহ নামের নরম সুস্বাদু খাবার প্রস্তুত হয়ে গেল। এরপর নিজ হাতে হাঁড়ি থেকে উঠিয়ে সেই ক্ষুধার্ত শিশুদের পরিবেশন করলেন। শিশুরা তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে নিজেদের মধ্যে হাসি ও খেলায় লিপ্ত হয়ে গেল। অবশিষ্ট খাদ্য তিনি মহিলার কাছে দিয়ে এলেন। মহিলাটি অনেক আনন্দিত হয়ে বলল আল্লাহ তোমাকে এর উত্তম প্রতিদান দিন। হজরত ওমর (রা.)-এর পরিবর্তে তুমিই খলিফা হওয়ার বেশি উপযুক্ত ছিলে।

হজরত ওমর (রা.) তাকে সান্ত¡না দিয়ে বললেন আপনি যখন খলিফার দরবারে যাবেন তখন আমাকেও সেখানে দেখতে পাবেন। হজরত ওমর (রা.) সেখান থেকে কিছুটা দূরেই মাটির ওপর বসে পড়লেন। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর চলে এলেন এবং বললেন আমি এজন্য সেখানে বসেছিলাম যে আমি তাদের কাঁদতে দেখেছিলাম, আমার মন চাচ্ছিল কিছুক্ষণ আমি তাদের হাসতেও দেখি।’ তথ্যসূত্র হেকায়েতে সাহাবা।

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চার খলিফাই খেলাফত পরিচালনায় সাধারণ মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন। যে কারণে ইসলামী খিলাফতে মানবাধিকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে। মানবতার পতাকা উড্ডীন হয়েছে অন্য সব পতাকার ওপর। মহান চার খলিফা এ শিক্ষা পেয়েছেন রসুলের কাছ থেকে। মানবতার সেবাকে যিনি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন।

আবু সাইদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো বিবস্ত্র মুসলমানকে কাপড় পরিধান করাবে, আল্লাহতায়ালা কিয়ামতের দিন তাকে জান্নাতের সবুজ কাপড় পরিধান করাবেন। যে ব্যক্তি কোনো আনসারি মুসলমানকে আহার দান করবে, আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতের ফল দ্বারা আহার দান করাবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানকে পানি দ্বারা সিক্ত করবে, আল্লাহতায়ালা তাকে সিলমোহরকৃত বিশুদ্ধ পানীয় পান করাবেন।

 

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর