সোমবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

বাড়ছে মৃত্যু অভাব সচেতনতার

তপন কুমার ঘোষ

বাড়ছে মৃত্যু অভাব সচেতনতার

বিশ্বজুড়ে তান্ডব চালাচ্ছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। ২০১৯ সালের শেষ দিক থেকে শুরু। করোনার প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারের পর মানুষ আশার আলো দেখতে পায়। কয়েকটি কোম্পানির প্রতিষেধক এরই মধ্যে বাজারে এসেছে। বিলম্ব না করে বিশ্বের অনেক দেশ টিকাকরণের কাজ শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ফের ভয়ংকর হয়ে উঠেছে করোনা। করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট বা প্রজাতির হদিস মিলেছে ব্রিটেন, দক্ষিণ আফিকা, ব্রাজিল এবং ভারতে। গোটা বিশ্বে এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভয়ংকর এসব ভাইরাস। কিছু দিন ধরে শোনা যাচ্ছিল, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসছে এবং প্রথম ঢেউ থেকে দ্বিতীয় ঢেউ হবে আরও মারাত্মক। গবেষকরা বলছেন, ভাইরাসের নতুন প্রজাতির সংক্রমণ এবং মারণক্ষমতা আগের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। ঘন ঘন রূপ বদলানোর কারণে নতুন ভাইরাসের গতি-প্রকৃতি বুঝে উঠতে সময় লাগছে গবেষকদের।

গত ১৭ এপ্রিলের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ৩০ লাখ ছাড়িয়েছে। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। ৬ লাখ ছুঁই ছুঁই। মৃত্যুর পরিসংখ্যানে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। যুক্তরাষ্ট্রের নিকট-প্রতিবেশী মেক্সিকোর অবস্থান তৃতীয়। ইউরোপে প্রাণহানি দিন কয়েক আগেই ১০ লাখের গন্ডি পেরিয়েছে। এশিয়ার মধ্যে করোনায় বেশি বিপর্যস্ত ভারত। করোনায় মৃত্যু বিবেচনায় চতুর্থ অবস্থানে আছে জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই দেশটি। এই মৃত্যু-মিছিলের শেষ কোথায়? জবাব নেই।

এই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতিও বেশ উদ্বেগজনক। এ বছরের মার্চ থেকে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার। গত বছরের মার্চে করোনায় আমাদের দেশে প্রথম মৃত্যুর খবর জানা যায়। এ পর্যন্ত হতচ্ছাড়া করোনা ১০ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। করোনায় মৃত্যু বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন পর্যন্ত ৩৮তম।

করোনার প্রথম ঢেউ ভালোভাবেই সামাল দেয় বাংলাদেশ। চলতি বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশে সংক্রমণের হার অনেকটাই কমে আসে। চলতি বছর জানুয়ারিতে পরীক্ষামূলক টিকাদান কর্মসূচি শুরু করা হয় বাংলাদেশে। ফেব্রুয়ারি থেকে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসতে থাকে। একপর্যায়ে তা এক অঙ্কে নেমে আসে। মানুষ আশান্বিত হয়। সবকিছু বোধহয় স্বাভাবিক হয়ে আসছে! কিন্তু সে আশার গুড়েবালি। মার্চের মাঝামাঝি থেকে ছবিটা বদলে যেতে শুরু করে। দিন দিন হু হু করে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। কোনো উপসর্গ নেই। অথচ করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট পজিটিভ। এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। শিশু এবং যুবকরাও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। দিন যতই গড়াচ্ছে ভয়াবহ হচ্ছে করোনা পরিস্থিতি। গত ১৬ এপ্রিল দেশে করোনায় এক দিনে মৃতের সংখ্যা তিন অঙ্ক ছুঁয়েছে। ওই দিন করোনায় ১০১ জন মৃত্যুবরণ করে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে এই উদ্বেগের মধ্যেই জোর কদমে এগিয়ে চলেছে টিকাকরণের কাজ। দ্বিতীয় ডোজের টিকাদান শুরু হয়েছে ৮ এপ্রিল থেকে। এর পাশাপাশি প্রথম ডোজেরও টিকাদান চলছে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সেই শুরু থেকে বলে আসছেন, করোনা সংক্রমণ রুখতে ‘কভিড-বিধি’ মেনে চলতে হবে। সোজা কথায়, মাস্ক পরতে হবে, সাবান দিয়ে ঘন ঘন হাত ধুতে হবে, নির্দিষ্ট শারীরিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। মানতে হবে অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি। কেন স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে সেটাও বোঝানো হচ্ছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! এত কিছুর পরও এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব স্পষ্ট। মাস্ক না পরার কারণ জানতে চাইলে অজুহাতের অন্ত নেই। বিশেষজ্ঞরা বারবার জনসাধারণের কাছে আবেদন করছেন, টিকা নেওয়াটা যেমন জরুরি, তেমনি করোনাবিধি মেনে চলাটাও জরুরি। এক ডোজ টিকা নেওয়া মানে করোনা জয় নয়। টিকার কোর্স সম্পন্ন করতে হবে। টিকা নেওয়ার পরও আক্রান্ত হয়েছেন অনেকে। এ ছাড়া টিকার কার্যকারিতা কখন থেকে শুরু হবে এবং কত দিনই বা কার্যকর থাকবে, এ নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। করোনার নতুন প্রজাতির ক্ষেত্রে এই টিকা কতটা কী কার্যকর হবে, এ নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। এতদিন বলা হচ্ছিল, করোনাভাইরাস বাতাসে ছড়ায় না। এখন বলা হচ্ছে, এ ভাইরাস বাতাসের মাধ্যমেও ছড়ায়। গবেষণায় প্রাপ্ত নিত্যনতুন তথ্যে বিভ্রান্ত মানুষ। তাই এ মুহূর্তে স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনের কোনো বিকল্প নেই।

করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি রুখতে সারা দেশে গত ১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের সর্বাত্মক লকডাউন চলছে। আগামী ২১ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত এ লকডাউন চলবে। জল্পনা আছে, আরও এক সপ্তাহ বাড়তে পারে লকডাউন। লকডাউন কার্যকরে কঠোর অবস্থানে আছে পুলিশ প্রশাসন। রাজধানীর মূল সড়কে মানুষের আনাগোনা কম থাকলেও অলিগলি ও কাঁচাবাজারে মানুষের ভিড় চোখে পড়ছে। মানুষকে ঘরবন্দী করে রাখার কাজটি নিঃসন্দেহে কঠিন। জীবন-জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে বের হতে হয়। পেটের দায় বড় দায়! বাংলা নববর্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে কিছু কঠোর ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে।’ জীবন-জীবিকার প্রশ্নে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘মানুষের জীবন সর্বাগ্রে। বেঁচে থাকলে আবার সবকিছু গুছিয়ে নিতে পারব।’ আসলে নীতিনির্ধারকরা উভয় সংকটে। পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে দুকূল সামলে। ‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম।’ পুরনো প্রবাদ। আমরা সবাই জানি। কিন্তু কজন মানি? মারণ ভাইরাস রেয়াত করছে না কিন্তু কাউকেই!

            লেখক : সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা            পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

সর্বশেষ খবর