শনিবার, ১২ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

সুরে ও উচ্চারণে বিরহী উকিল

মুহম্মদ আকবর

‘শোয়াচান পাখি’ মানে শুইয়ে আছেন চান পাখি। অর্থাৎ উকিল মুন্সির স্ত্রী বা ছেলে মারা যাওয়ার পর লাশের পাশে বসে তিনি এ গান রচনা করেছেন বা গেয়েছেন এমন গল্প আমরা শুনেছি প্রখ্যাত বংশীবাদক ও সংগীতশিল্পী প্রয়াত বারী সিদ্দিকীর কাছে। তিনি বিভিন্ন টিভি প্রোগ্রামে, মঞ্চে এসে এসব হাস্যকর কথা বলেছেন। যদিও গানটি অনেক পুরনো। আদৌ গানটি উকিলের কি না সে প্রশ্নও আছে। যাই হোক, বারী সিদ্দিকীর এ ব্যাখ্যা কিছু মানুষের কাছে হাস্যকর মনে হলেও অনেক মানুষের কাছেই জায়গা করে নিয়েছে। একজন সহজ মানুষ বা সাধক যখন একটা শব্দ উচ্চারণ করেন তখন একে এত সহজভাবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। সহজ মানুষকে যে ‘দিব্যজ্ঞানে’ দেখতে হয় ওই কথাটা হয়তো ওই সময় তাঁর মাথায় ছিল না।

ভিতরের মানুষটাকে নিয়ে খেলা করা যার কাজ, ধ্যান, জ্ঞান। তাঁর কাছে ইহজগতে প্রাণের আসা-যাওয়ার চেয়ে এ প্রাণের ভিতরকে জাগ্রত করা বেশি প্রাধান্য পাবে এটাই স্বাভাবিক। সেই ভিতরের মানুষকে সোনার ময়না পাখি, শোয়াচান পাখি এ রকম কত নামেই না উকিল মুন্সিরা ডাকেন, জাগ্রত করার চেষ্টা করেন। না জাগলে তাঁরা অনুশোচনায় ভোগেন। ভোগেন বিচ্ছেদে, বিরহে।

এই যে উকিল মুন্সির একটা গান- ‘ধনু নদীর পশ্চিম পাড়ে/সোনার জালালপুর/সেইখানেতে বসত করে উকিলেরই মনচোর...।’ এটা কি কেবলই উকিলের জাগতিক প্রেমের গল্প? নাকি জীবন ও পরমের রসায়ন। এই জালালপুরকে যদি গ্রাম হিসেবে বিবেচনা করি তাহলে বলা যায়, এই গ্রামের এক মেয়ের সঙ্গে প্রেমে আবদ্ধ হয়ে নানা ঘটনা ও প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তিনি বিয়ে করেন। কিন্তু উকিল মুন্সির মতো সাধক মানুষের কাছে জালালপুর, ধনু নদ, কেবলই প্রতীকী নাম, ধ্যানের অবলম্বন তথা পরমাত্মার কাছে পৌঁছার উপায়।

সচেতন কিংবা অবচেতনভাবে উকিল মুন্সিকে ভাটি এলাকার মানুষ বিচ্ছেদী শিল্পী হিসেবেই জানেন। লোকমুখে বলা হয় ‘কইলজা ছিঁড়া’ বিচ্ছেদ গানের শিল্পী উকিল মুন্সি। সৃজনে কিংবা ব্যক্তিজীবনে উকিল মুন্সি সেই বিরহে পুড়েছেন। নিজেকে পোড়াতে পোড়াতে হয়তো ভিতরের মানুষকে জাগ্রত করেছেন এবং তিনি নিজে সোনায় পরিণত হয়েছেন। ঘরে, বেতাই বা ধনু নদের পাড়ে, গানের আসরে কিংবা মসজিদে বসে দিনের পর দিন কেঁদেছেন আর গান রচনা করেছেন, গেয়েছেন। সেই গান শুনলে, পাঠ করলে বোঝা যায় উকিল মুন্সির মানসজগৎ। আর সুর শুনলে বোঝা যায় ভাটি মানুষ ও মানুষের জীবন নিয়ে তাঁর কি দারুণ উপলব্ধি। এর জন্য সংগীতবিশারদ হওয়ার প্রয়োজন হয় না। তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ গানের কথা ও সুরে বিচ্ছেদের নজিরবিহীন উপস্থাপন করেছেন। কথাকে যেমন জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার বিচ্ছেদের অপূর্ব সৃষ্টি বলা যায়, তেমনি হাওর এলাকার পানিপ্রবাহ ও দুঃখকষ্টে সেখানকার মানুুষের বিশেষ করে নারীদের কান্না এ গানে পাওয়া যায়। এটাই উকিল মুন্সি, এটাই তাঁর নিজস্বতা।

উকিল মুন্সির সঙ্গে মানুষের দ্ধন্ধ ও দূরত্ব কম ছিল। এর কারণ তাঁর বিশ্বাসের সঙ্গে যাপিত জীবনের দূরত্বও ছিল না। অন্যের বিশ্বাসে কখনো তিনি আঘাত করতেন না। বলা যায়, অন্যের বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি নিজের বিশ্বাসের কথা বলতেন। আর সেই বিশ্বাস-বাণী পরম্পরায় এলাকার সীমানা পেরিয়ে পৌঁছে যেত দেশে ও দেশের বাইরে। মসজিদে ইমামতি এবং বাউল গান একসঙ্গে করার নজির বাংলাদেশে অন্য কোথাও আছে কি না আমার জানা নেই। উকিল মুন্সি তা সম্ভব করে তুলেছিলেন। তিনি মোহনগঞ্জের অন্তত সাতটি মসজিদে ইমামতি করেছেন। বাধা যে আসেনি তা নয়, তবে বাধার চেয়ে মেনে নেওয়ার লোকই ছিল বেশি।

উকিল মুন্সি মানুষের মনে ও মননে কীরকম প্রভাব ফেলেছেন তারও প্রকৃষ্ট উদাহরণ আছে। অনেকে জীবদ্দশায় বলে যেতেন যেন উকিল মুন্সি তাঁর জানাজা নামাজ পড়ান। গোলাম এরশাদুর রহমান তাঁর নেত্রকোনার বাউলগীতির ৭২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, ‘... বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি মৃত্যুর পর জানাজা, দোয়ার জন্য উকিল মুন্সিকে ইমাম হিসেবে রাখার জন্য সন্তানদের বলে যেতেন। অনেক ক্ষেত্রে বাউল গানের আসর স্থগিত রেখে জানাজা নামাজে ইমামতি করতে যেতে হয়েছে।’ অথচ আজকের এই দিনে তা কল্পনাই করা যায় না। তাঁর লেখা ‘আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে...’ গানে হাওয়ার এলাকার তথা ভাটি এলাকার রূপ-বৈচিত্র্য ও ঐতিহ্য ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি জীবাত্মা ও পরমাত্মা অর্থাৎ সৃষ্টি ও স্রষ্টার কথা বলেছেন।

উকিল মুন্সির পুরো নাম আবদুল হক আকন্দ। তিনি ১৮৮৫ সালের ১১ জুন জন্মগ্রহণ করেন। পিতা গোলাম রসুল আকন্দ ছিলেন খালিয়াজুরী উপজেলার নূরপুর বোয়ালী গ্রামের একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি। উকিল মুন্সির মামাবাড়ি ধলা চৌধুরী বাড়ি। খালাবাড়ি ইটনা ঠাকুরবাড়ি। এতেই বোঝা যায় তাঁদের পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান। কিন্তু এর কিছুই টানেনি উকিল মুন্সিকে। শৈশবেই তিনি মরম ও পরমের আহ্‌বানে সাড়া দিয়ে বাড়ি ছেড়েছেন। ধর্মীয় শিক্ষা নেওয়ার পাশাপাশি ঘেটু গানে যোগ দেন। বলা যান, ঘেটু গানের মধ্যেই উকিলের গানের জগতে প্রবেশ। একপর্যায়ে হবিগঞ্জের রীচি গ্রামের মোজাফফর আহাম্মদের (রহ.) শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। গজলের সঙ্গে যোগ হয় অন্যান্য গান। সুরে অনুষঙ্গ হয় একতারা। রচিত হয় একের পর এক বিরহী গান। সৃষ্টি হয় মন পাগল করা একেক সুর। ডাক পেলেই যান গানের আসরে। একপর্যায়ে কুলিয়াটি গ্রামের আবদুল জলিলের কাছে বাউল গানের তালিম নেন। পরে বারহাট্টার চন্দ্রপুরের মোফাজ্জল হক চিশতির কাছেও যান। সেখানে নিজেকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা চালান। তত দিনে উকিল মুন্সি বিরহী বাউল হিসেবে নেত্রকোনা তথা ময়মনসিংহে পরিচিতি লাভ করেন। ত্রিশের দশকের শুরুর দিকে বাউল রশিদ উদ্দিনের সঙ্গে উকিল মুন্সির সামনাসামনি সাক্ষাৎ হয়।  বয়সে উকিল রশিদ উদ্দিনসহ নেত্রকোনার পরিচিত অনেক বাউল থেকে অগ্রজ হলেও জ্ঞানপিপাসু উকিল নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্য অনেকের কাছেই দৌড়েছেন।

ব্যক্তিগত জীবনে উকিল একের পর এক স্বজন হারিয়েছেন। মা, বাবা, ভাই, সন্তান ও স্ত্রী হারানো বেদনা তাঁকে পুড়িয়েছে তার চেয়ে বেশি ‘মনচোরের’ বিরহে পুড়েছেন। ১৯৭৮ সালে মতান্তরে ১৯৭৯ সালের ৬ আগস্ট মৃত্যুর আগমুহুর্ত পর্যন্ত তিনি ‘আমার শ্যাম শোক পাখি গো/ধইরা দে ধইরা দে...’ বলে ‘মনচোরের’ সন্ধান করেছেন। বাঙালির মরমি স্থান ভাটি এলাকায় জন্ম নেওয়া এই সাধকের জন্মবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর