সাহিত্যামোদীদের এক আড্ডায় কথা হচ্ছিল চুল নিয়ে। এক বন্ধু বললেন, জীবনানন্দ দাশ বনলতা সেন কবিতায় তাঁর ‘মানসকন্যা’র চুলের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা বাংলা কবিতার রাজ্যে অমরতা লাভ করেছে। ‘চুল তার কবে কার অন্ধকার বিদিশার নিশা’ এ অনন্য উপমা আর কোনো কবির কবিতায় মেলা ভার। আড্ডা এগোতেই এক বন্ধু ফোড়ন কেটে বললেন, রাজনীতিকদের চুলোচুলি এ ‘কলহপ্রিয় প্রজাতি’র জন্য বারবার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। চুলোচুলির মতো নিকৃষ্ট বিষয় রাজনীতিতে এনে তারা যে ভুল করেছেন তার খেসারত দিতে হয়েছিল ওয়ান-ইলেভেনে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্টান্টবাজির অভিলাষে শক্ত হাতে শুধু চুলোচুলি নয়, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের মাথার চুল থেকে দুর্নীতি নামের উকুন মারার কাজও শুরু করে। এ উকুন মারার প্রক্রিয়ায় অনেক রাজনীতিকের রাজনৈতিক জীবন প্রশ্নের মুখে পড়ে।
বলা হয়, চুল সৌন্দর্যের প্রতীক। কারও কারও কাছে যৌবনের প্রতীকও। শক্তির প্রতীক তো বটেই। প্রাচীনকালের বীরদের সবাই ছিলেন দীর্ঘ চুলের অধিকারী। বয়সে নবীন এমন কারও মাথায় যদি শোভা পায় চকচকে টাক তবে তার তারুণ্য কিছুটা হলেও ম্লান মনে হবে। আমাদের রমণীকুলের দীর্ঘ চুলের সুনাম সেই প্রাচীনকাল থেকে। এ দেশের লোকসাহিত্যে নন্দিত হয়েছে কেশবতীরা। ‘কুঁচবরণ কন্যা রে তার মেঘবরণ কেশ’- এ গান শোনেনি এমন বাঙালি খুব একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। শুধু লোককবিদের গানে নয়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের নারী বন্দনায়ও চুলের শোভা স্থান পেয়েছে অনন্যভাবে। ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে/মুক্ত বেণি পিঠের ‘পরে লোটে- এ গানটি সম্ভবত অনেকেরই প্রিয়। এমনকি বাউল কবিরাও এদিক থেকে পিছিয়ে নেই। পূর্ণদাস বাউলের সেই গানটির কথা ধরা যাক, ‘আমার যেমন বেণি তেমনি রবে চুল ভিজাব না।’
পশ্চিমা লোককাহিনিতেও সুকেশীদের জয়জয়কার। কেশহীন যারা অর্থাৎ মাথার ওপর যাদের চাঁদের মতো জ্বলজ্বলে টাক তাদের অবশ্য হতাশ হওয়ার কিছু নেই। টেকো বা কেশহীনদের দুঃখ নিবারণে রয়েছে পরচুলার ব্যবস্থা। সেই প্রাচীনকালেও সভ্যতার আদিভূমি মিসরে পরচুলা ফ্যাশন বলে বিবেচিত হতো। রাজা, রানী, মন্ত্রী, সভাসদরা পরচুলা ব্যবহার করে রূপের বাহার বাড়াতেন। গ্রিসেও ছিল পরচুলা ব্যবহারের প্রচলন। ইরান থেকে পরচুলা রপ্তানি হতো গ্রিসে।
টাক নিয়ে গর্ববোধ করেন এমন লোকের সংখ্যা কম নয়। ‘আঙুর ফল টক’- এ তত্ত্বে বিশ্বাসী তারা। বলা হয়, টাক আর টাকার সম্পর্ক নাকি খুবই নিবিড়। ধনীর এক বড় অংশ টেকো- এ ধারণা থেকে ওই তত্ত্বের উদ্ভব। বিজ্ঞানের এ উৎকর্ষতার যুগে টেকোদের জন্য রয়েছে নানা সুখবর। টাকমাথায় চুল গজানোর জন্য রয়েছে হরেক ব্যবস্থা। কিন্তু সেই প্রাচীন যুগে চিকিৎসাবিজ্ঞান ছিল নিতান্তই আঁতুড়ঘরে। গ্রিক চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিপ্পোক্রেটাসের মাথায় ছিল বিশাল এক টাক। তিনি বলতেন, টাক হলো মরদের লক্ষণ। ভাবটা এমন যাদের মাথায় টাক নেই তারা পুরুষই নয়। তাঁর অভিমত, টাকওয়ালা পুরুষই হলো সেরা। টাক সম্পর্কে গ্রিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীর এমন গর্বিত উচ্চারণ সত্ত্বেও টেকো হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে চান এমন একজন মানুষ পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ! রোম সম্রাট জুলিয়াস সিজার ছিলেন টেকো। তিনি পরচুলার ওপর মুকুট পরতেন। মুকুটে টাক ঢাকার সুযোগ থাকলেও অতটুকুতে সন্তুষ্ট ছিলেন না এই সাহসী রাজা। সে যুগে রোমান সুন্দরীদের মধ্যেও পরচুলা ব্যবহারের প্রচলন ছিল। যুদ্ধে পরাজিত বিভিন্ন জাতির নারীদের মাথা মু-ন করে সংগ্রহ করা হতো এ চুল। রোমান নারীদের বাহারি কেশের মধ্যে লুকিয়ে থাকত ভাগ্যহত ভিন জাতির ললনাদের দীর্ঘশ্বাস। চুল বাঙালি নারীর চিরায়ত সৌন্দর্যের অন্যতম উপাদান। সারা দুনিয়ার নিরিখে গড়পড়তা হিসেবে বাঙালি নারীরাই দীর্ঘ চুলের অধিকারী। চুলোচুলির দিক থেকেও আমাদের রমণীকুলের জুড়ি মেলা ভার। গ্রামদেশে ননদ-ভাবির সম্পর্ক যেমন মধুর, তেমন তাদের চুলোচুলির ঘটনাও মশহুর। আমাদের সমাজের একান্নবর্তী পরিবারগুলোয় ফাটল ধরার পেছনে চুলোচুলির অবদান কম নয়। কেউ কেউ বলেন, চুলোচুলির ঘটনাটি নিতান্তই গ্রামীণ এবং শহুরে সংস্কৃতিতে এর কোনো প্রভাব নেই। কিন্তু রাজধানীর যে কোনো বস্তিতে চুলোচুলির ঘটনা তো নিত্যনৈমিত্তিক। তবে এ প্রবণতা শুধু গ্রাম বা শহুরে বস্তির জায়া-জননী-ভার্যাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের সুশিক্ষিত রমণীকুলও এদিক থেকে কম যান না। ধরা যাক ইডেন কলেজের কথা। দেশের নারী শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এটি। এ মশহুর কলেজটির ছাত্রীদের চুলোচুলি বহুবার পত্রপত্রিকায় শিরোনাম হয়ে এসেছে। একদা এ কলেজটিতে দোর্দ- প্রতাপে রাজত্ব করতেন খান উপাধিধারী এক ছাত্রনেত্রী। চুলোচুলিতে তার ছিল দারুণ উৎসাহ। চুলের সঙ্গে ‘চুলচেরা বিচার’ কথাটির সম্পর্ক কি নিছক কাকতালীয়? আমাদের বিচারকরা নাকি দীর্ঘ চুলের অধিকারী। এ ক্ষেত্রে মাথার শোভাবর্ধনে ভূমিকা রেখেছে বিচারকদের জন্য নির্ধারিত ‘উইগ’ বা পরচুলা। ব্রিটিশ আমলে মহামান্য বিচারকদের জন্য যে পোশাক নির্ধারণ করা হয় উইগ তার অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বলা হয়, পরচুলা নাকি এ ক্ষেত্রে পেশার স্বাতন্ত্র্য ও আভিজাত্যের দ্যোতক। ব্রিটিশরা বিচারকদের জন্য পরচুলাযুক্ত পোশাক কেন নির্ধারণ করেছিলেন তা নিয়েও বিতর্ক কম নয়। অনেকে বলেন, শুধু পেশার স্বাতন্ত্র্য বা আভিজাত্য ফুটিয়ে তোলা নয়, অপরাধীদের মনে ভয় ঢোকানোর উদ্দেশ্যও এতে ক্রিয়াশীল। ব্রিটিশ রাজপ্রাসাদের গার্ডদের টুপিও পরচুলাযুক্ত। অপরাধী বা অনাহূতরা যাতে ভয় পায় তার জন্যই নাকি এ আয়োজন। আমাদের দেশে চুলের আলাদা মাহাত্ম্য সেই প্রাচীনকাল থেকেই স্বীকৃত। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ব্রাহ্মণদের আভিজাত্য আকাশছোঁয়া। এ দেবপুত্রদের চেনার প্রধান উপায় তাদের মাথার টিকি। টিকি নামে অভিহিত এ চুল শুধু আভিজাত্য নয়, মর্যাদার প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত। চুলের সঙ্গে ধর্ম ও আধ্যাত্মিক জগতের সম্পর্কও নাকি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন বাবরি চুলের অধিকারী। শ্মশ্রুমন্ডিত এই মহাপুরুষের চেহারায় ছিল অদ্ভুত এক সম্মোহনশক্তি। যা মানুষকে অনায়াসে আপন করে নিতে পারত। খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিস্টও ছিলেন দীর্ঘ চুল ও শ্মশ্রুমন্ডিত। হিন্দুধর্মের প্রবর্তক হিসেবে অসংখ্য মুনি-ঋষির কথা বলতে হয়। তারাও ছিলেন দীর্ঘ চুলের অধিকারী। শিখধর্মের প্রবর্তক গুরুনানক চুল-দাড়িকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ ভাবতেন। শিখ পুরুষরা চুল-দাড়ি কাটাকে অপরাধ বলেই ভাবেন।
সেই প্রাচীন যুগ থেকেই চুলকে ভাবা হয় শক্তির প্রতীক হিসেবে। দেবতাদের কাছে প্রাণের মতোই শ্রেষ্ঠ এক অর্ঘ্য মাথার চুল। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন মন্দিরে অর্ঘ্য হিসেবে নিবেদন করা হয় ভক্তের চুল। বাইবেলে বর্ণিত অমর প্রেম কাহিনি নিয়ে বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে হলিউডে নির্মিত হয় ‘স্যামসন অ্যান্ড ডেলায়লা’ নামের বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র। এ ছবির নায়ক স্যামসনের লম্বা চুল ছিল তার অপরাজেয় ক্ষমতার উৎস। এ ক্ষমতাবলে তিনি পরাভূত করেন প্যালেস্টাইনের এক অত্যাচারী রাজাকে। স্যামসন খালি হাতে সিংহ বধ করার মতো শক্তিশালী ছিলেন। যারা এ ছবিটি দেখেছেন তাদের মানসপটে দৃশ্যগুলো গেঁথে থাকার কথা। ধর্মের সঙ্গে মার্কসীয় চিন্তার দ্বন্দ্ব বহু পুরনো। কার্ল মার্কস ধর্মকে তুলনা করেছেন আফিমের সঙ্গে। মানুষকে এ নেশামুক্ত করার সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন এই খ্যাতনামা দার্শনিক। ধর্মের সঙ্গে মার্কসীয় দর্শনের চুলোচুলির সম্পর্ক থাকলেও চুলপ্রীতির দিক থেকে মার্কসবাদীরাও মনে হয় অভিন্ন। সমাজতান্ত্রিক মতবাদের দুই তাত্ত্বিক পুরুষ কার্ল মার্কস ও অ্যাঙ্গেলস ছিলেন বাহারি চুলের অধিকারী। দুজনই শ্মশ্রুমন্ডিত। দুনিয়ার প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা ভøাদিমির ইলিচ লেনিনও ছিলেন চুল পারিপাট্যের জন্য খ্যাত। তাঁর বিশেষ স্টাইলের দাড়িও সমর্থকদের মধ্যে সম্মোহন সৃষ্টি করত। লেনিনের মৃত্যুর পর তাঁর লাশ মমি করে রাখা হয়। কাচের বাক্সে রাখা সে লাশ দেখলে মনে হবে কমরেড লেনিন যেন কাজ শেষে বিশ্রাম নিচ্ছেন। মমি অবস্থায় তাঁর চুল-দাড়ি যাতে অক্ষুণœœ থাকে সেজন্য প্রতি সপ্তাহেই নেওয়া হয় বিশেষ পরিচর্যা।
লাতিন আমেরিকার বিপ্লবী চে গুয়েভারার নাম দুনিয়ার লাখ লাখ মানুষের কাছে পরিচিত। চে গুয়েভারা ছিলেন আর্জেন্টিনার অধিবাসী। পেশায় ডাক্তার। মার্কসবাদের দীক্ষা নেওয়ার পর নিজেকে তিনি উৎসর্গ করেন শোষণমুক্তির সংগ্রামে। কিউবার বিপ্লবে অসামান্য অবদান রাখেন এই ভিনদেশি বিপ্লবী। বিপ্লবের পর ফিদেল কাস্ত্রোর সরকারে তিনি অর্থমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন। সে দেশের মুদ্রায় ছিল চে গুয়েভারার স্বাক্ষর। মন্ত্রী অবস্থায় চে কিউবা ত্যাগ করেন বলিভিয়ার বিপ্লবী আন্দোলনের ডাকে। সে দেশে গিয়ে শুরু করেন গেরিলা যুদ্ধ। মার্কিন তাঁবেদার সরকারের সামরিক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এই বিপ্লবী নেতা। তাঁকে আটক অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যার পর চের চরিত্র হননেরও অপপ্রচার চলে। কিন্তু বলিভিয়ার সাধারণ মানুষের কাছে চে এখনো একটি প্রিয় নাম। এমনকি ধার্মিক মানুষের কাছেও। চে ছিলেন দীর্ঘ চুল আর শ্মশ্রুমন্ডিত। অনেকটা খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিস্টের মতো। মানুষের মুক্তির জন্য যিশু যেমন প্রাণ হারিয়েছেন চে গুয়েভারাকেও সেভাবে মূল্যায়ন করেন বলিভিয়ার ধার্মিক মানুষ।
কিউবান বিপ্লবের নেতা ফিদেল কাস্ত্রোও ছিলেন দীর্ঘ চুল ও শ্মশ্রুমন্ডিত মুখাবয়বের অধিকারী। সারা দুনিয়ার লাখ লাখ বিপ্লবীর চোখে সত্যিকারের বীর হিসেবে স্বীকৃত এই কিউবান নেতা। পরাশক্তি বলে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের অপছন্দনীয় ব্যক্তিদের তালিকায় ফিদেল কাস্ত্রোর নাম ছিল শীর্ষস্থানে। কাস্ত্রোর নেতৃত্বে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে তাঁবেদার বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করা হয়। ওয়াশিংটন তাদের নাকের ডগায় একটি সমাজতান্ত্রিক দেশের অভ্যুদয় কখনো মেনে নেয়নি। কাস্ত্রোর পতনের জন্য তারা শুরুতেই নৌসেনা পাঠায়। কিন্তু নৌসেনারা পরাজিত হয় কিউবান বিপ্লবীদের হাতে। ইতিমধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়া এগিয়ে আসে কিউবার সমর্থনে। প্রয়োজন হলে কিউবা রক্ষায় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারেরও হুমকি দেন তৎকালীন রুশ নেতা নিকোলাই ক্রুশ্চেভ। ক্রুশ্চেভের এ হুমকিতে কাজ হয়। গোঁফ নামায় আমেরিকা। কিন্তু তারা কাস্ত্রোকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র থেকে কখনো সরে আসেনি। কিউবায় মার্কিন ষড়যন্ত্র সফল করার পথে প্রধান বাধা বলে তারা ভাবত ফিদেল কাস্ত্রোকে। শ্মশ্রুমন্ডিত এই নেতা কিউবানবাসীর কাছে বিপ্লব ও সাহসের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। আর তাই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর টার্গেটে পরিণত হয় তার চুল-দাড়ি। তারা কাস্ত্রোর চুল-দাড়ি নষ্ট করতে শত শত কোটি ডলার ব্যয়ও করে। খাবার পানীয় বা হাভানা চুরুটে বিষ মিশিয়ে তাঁকে শ্মশ্রুহীন করার চেষ্টাও চলে। কিন্তু সেসব চেষ্টা ব্যর্থ হয় কিউবানদের সতর্কতায়।
চুল যেহেতু সৌন্দর্য ও ভাবমূর্তির অন্যতম বাহন সেহেতু কেশ পরিচর্যার গুরুত্ব অপরিসীম। অভিনেতা, অভিনেত্রী, মডেলরা যেমন বিষয়টি অগ্রাধিকারের চোখে দেখেন তেমন দেখেন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরাও। রাষ্ট্রনেতাদের জন্যও বিষয়টি বিশেষ মনোযোগের দাবিদার। পঞ্চাশের দশকে কলকাতার সিনেমা নায়ক উত্তমকুমার ও ষাটের দশকে ঢাকার সিনেমা নায়ক রহমান এবং লাহোরের ওয়াহিদ মুরাদের চুলের স্টাইল ছিল যুবকদের অনুকরণীয়। আর প্রিন্সেস ডায়ানার চুলের স্টাইল যে দুনিয়ার লাখ লাখ তরুণীর হৃদয় কেড়েছে সে তথ্য কার না জানা।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের কেশ পরিচর্যায় অবিশ্বাস্যরকম অর্থ বরাদ্দ করা হয়। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে যখন তালেবানবিরোধী অভিযান চলে তখন প্রেসিডেন্ট বুশের কেশ পরিচর্যাকারী ছিলেন একজন আফগান রমণী। আমাদের জাতীয় নেতাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর চুলের স্টাইলের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শত ব্যস্ততার মধ্যেও কেশ পরিচর্যায় সময় দিতেন। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, দুনিয়ার একজন নামি রাষ্ট্রপ্রধানের পেশাই ছিল কেশ পরিচর্যাকারী হিসেবে। নামিবিয়ার রাষ্ট্রপিতা ও প্রেসিডেন্ট শ্যাম নাজোমো একসময় ছিলেন নাপিত বা নরসুন্দর। সেখান থেকে তিনি যোগ দেন দেশের মুক্তিসংগ্রামে। ঔপনিবেশিক প্রভুদের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে শুরু করেন লড়াই। যে লড়াই সারা দুনিয়ায় নন্দিত হয়। শ্যাম নাজোমোর কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয় দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন শ্বেতাঙ্গ সরকার। তারা মেনে নেয় এ দেশটির স্বাধীনতা।
আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা শপথ নিয়েছিলেন চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তারা চুল-দাড়ি কাটবেন না। বাবরি চুল আর শ্মশ্রুমন্ডিত মুখ মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতিতে পরিণত হয়েছিল। দুজন খ্যাতনামা মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম ও মেজর জলিলকে তাদের দীর্ঘ চুল ও দাড়ি ছাড়া ভাবা অসম্ভব মনে হতো। স্বাধীনতার পর গঠিত নতুন প্রজন্মের বিপ্লবীদের দল জাসদ নেতা-কর্মীদের দীর্ঘ চুল ছিল লক্ষ্য করার মতো। এ দলের তাত্ত্বিক নেতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম রূপকার সিরাজুল আলম খানও সুপরিচিত তাঁর দীর্ঘ চুল ও দাড়ির জন্য। রাজনীতির এই রহস্যপুরুষের চুল-দাড়ি যেন তাঁকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হিসেবে তুলে ধরেছে। বাংলা ভাষার দুজন শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন দীর্ঘ চুল ও শ্মশ্রুধারী। জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের বাবরি চুল ছিল বিদ্রোহ আর তারুণ্যের প্রতীক।
চুল মাহাত্ম্যের এ লেখাটি শেষ করছি এক সহকর্মীর কাছে শোনা চুটকি দিয়ে। শহরের এক ধনাঢ্য ব্যক্তি তার একমাত্র শিশু সন্তানকে নিয়ে গেলেন এক জ্যোতিষীর কাছে। উদ্দেশ্য একমাত্র সন্তান বড় হলে কী হবে তা যাচাই করে দেখা। জ্যোতিষী ধনাঢ্য ব্যক্তিটির অভিলাষের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর তাকে নিয়ে গেলেন ভিতরের রুমে। সেখানে টেবিলের ওপর ছিল একটি ধর্মগ্রন্থ, পরচুলা আর বোতলভর্তি মদ। ধনাঢ্য ব্যক্তিকে তিনি বললেন, আপনার ছেলেকে এখানে ডাকুন। এ টেবিল থেকে যেটি ওর পছন্দ হয় বেছে নিতে বলুন। ও যদি ধর্মগ্রন্থ পছন্দ করে বুঝতে হবে ভবিষ্যতে সে ধার্মিক হবে। আর যদি পছন্দ করে পরচুলা ভাববেন ও বড় হলে হয় অভিনেতা নতুবা বিচারক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবে। আর যদি হাতে তুলে নেয় মদের বোতল তবে বুঝতে হবে বড় হলে ও হবে নির্ঘাত মাতাল। এরপর ছেলেকে ডাকা হলো পাশের ঘর থেকে। বলা হলো টেবিলের ওপর রাখা তিনটি জিনিসের যে কোনো একটি পছন্দ করে নিতে। ছেলেটি বাবার নির্দেশ পেতেই প্রথমেই হাত দিল পরচুলায়। তারপর সেটি ধীরেসুস্থে মাথায় পরে ধর্মগ্রন্থটি রাখল ডান বগলে। তারপর মদের বোতলটি বাঁ বগলে রেখে বলল তিনটি জিনিসই সে নিতে চায়। ছেলের কান্ড দেখে তো বাবার চক্ষু চড়কগাছ। তিনি উৎকণ্ঠিত হয়ে জ্যোতিষীকে জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে আমার ছেলে ভবিষ্যতে কী হবে? জ্যোতিষী বললেন, কোনো চিন্তা নেই ও হবে একজন ডাকসাইটে রাজনীতিবিদ।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।
ই-মেইল :[email protected]