সোমবার, ২৬ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা
বাসবী বড়ুয়া স্মরণে

সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে

হুসেইন ফজলুল বারী

সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের প্রভাষক বাসবী বড়ুয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রে। জিন্স আর সুতির পাঞ্জাবি পরা উৎসুক এক জোড়া চোখ নিয়ে নবীন গবেষকটি এসে জানতে চাইল আইনের প্রায়োগিক দিক আর সমাজবিজ্ঞানের যুগলবন্দী বিষয়ে। আমি কী একটা মামলার পিটিশন মুসাবিদা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলাম তখন। প্রথমে কিছুটা বিরক্তই হয়েছিলাম। তবু তরুণী গবেষকটির কথাবার্তার সহজ-স্বাভাবিকতা আমার মনে ধরল। তার কাছে এক রাশ জিজ্ঞাসার ঝাঁপি। সে কথা বলে দ্রুত। আমি যা-ই বলি না কেন, সব কিছু সে ডায়েরিতে টুকে রাখতে শুরু করল। আমি হেসে বললাম, আমার কথা কোনো ঐশী বাণী নয়, এসব কিছুই লেখার দরকার নেই। কিশোরীর উচ্ছ্বাসে সে খিলখিল করে হেসে উঠল। আমি বললাম, গবেষণা করতে তাড়াহুড়োর কিছু নেই, কয়েক দিন এসে আড্ডা দিলে তত্ত্ব আর তথ্য দুই-ই পেয়ে যাবে। সে লেবু-চা খেয়ে বস্তি উচ্ছেদ সংক্রান্ত রায়ের ফটোকপি নিয়ে বিদায় হলো।

এর পরের কয়দিন উচ্চতর আদালতের কয়েকটা জনস্বার্থ রায় পড়ে বাসবী বেশ উচ্ছ্বসিত। আবার আরেক দিন এসে কী একটা বিষয়ে রীতিমতো আমার সঙ্গে ঝগড়া করে গেল। কোনো ভনিতা নেই। বেশ ক্ষোভ রায়ের স্থবির বাস্তবায়ন বিষয়ে। আমি বললাম, উচ্চতর আদালতে রুল এখনো চলমান। তুমি গবেষণা করে বের কর আইন প্রয়োগের সমস্যা নিয়ে। সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে গম্ভীর মুখে কফির পেয়ালায় চুমুক দেয়। এরপর বাসবী প্রায়ই আসত আমাদের ইউনিটে। আমরা কৌশলে তাকে দিয়ে বেশ কিছু কাজ টাইপ করিয়ে নিতাম। সহজ-সরল বেচারি সম্ভবত বুঝতে পারত না। তার ইংরেজি ড্রাফট ছিল বেশ উন্নতমানের। গবেষণার বাইরে আলাপচারিতা এগোলে দেখলাম সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য পড়েছে ঠিকই, তবে তার মূল অনুরাগ শ্রেণিহীন সমাজ বিনির্মাণে। চিন্তা-চেতনা বেশ শানিত। জানলাম, সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা তরুণীটি বামপন্থি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল। তার হাতে সব সময় শোভা পেত সাহিত্য কিংবা সমাজ-সমীক্ষণ বিষয়ক কোনো বই। একদিন একটা রাশ ভারী পুস্তক দেখিয়ে আমাকে বলল, বইটা পড়তে চান? আমি বইয়ের মলাট খুলে নেড়ে চেড়ে বললাম, জটিল বই, সহজে হজম হবে না! বাসবী তখন হাসতে হাসতে বিষম খায়। এক সময় সরকারি চাকরির সুবাদে আমি ঢাকা আর মানবাধিকার সংস্থাকে বিদায় জানিয়ে মফস্বলে গিয়ে বিচার-আচার শুরু করি। বেশ উৎসাহ নিয়ে দাগ-খতিয়ান, দলিল-দস্তাবেজ আর চুরি-চামারির গল্পে বিভোর হয়ে ধূলি-ধূসরিত নথি ঘাঁটি। উকিল-পুলিশ আর মক্কেলের হট্টগোলে লাল দালানে বসে আইনের ফস্কা-গেরো নিয়ে ভাবী আর খসখস করে ফাইলে অবিরাম স্বাক্ষর করি। নারকেলবন-ছাওয়া বারান্দায় অলস অবসরে বসে ঢাকার ব্যস্ত জীবনকে মনে হয় কোনো সুদূর অতীতের স্মৃতি। ধীরে ধীরে নতুন সহকর্মী, ধীর-কর্মপরিবেশ আর প্রটোকলে অভ্যস্ত হচ্ছি। ঢাকায় যাই কালে-ভদ্রে। নিছক কোনো প্রয়োজন বা প্রশিক্ষণে। দিনে দিনে পুরনো সহকর্মী বাসবীদের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন। তখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম চালু হয়নি। বাসবীর কথা এক সময় ভুলেই গেলাম। নোয়াখালী আর চাটগায় কাজ করে এক সময় লন্ডনে গিয়ে হাজির হলাম উচ্চশিক্ষার্থে। বিলেতে পরিচয় আর বন্ধুত্বের সুবাদে এক তরুণীর সঙ্গে পরে গাঁটছড়াও বাঁধলাম। কথায় কথায় জানলাম, ভূতপূর্ব সহকর্মী বাসবী বড়ুয়া আমার স্ত্রীর আবাল্য সখী। একসঙ্গে চট্টগ্রাম ইস্পাহানি স্কুল, চট্টগ্রাম কলেজ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে তারা কয়েকজন হয়ে গেছে পরস্পরের ছায়াসঙ্গী। অনেক বছর পর দিল্লিতে মসলাদার সুবাসিত বিরিয়ানি খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে ভাত-মাছের সন্ধানে বাসবীকে ফোন করলাম। তিনি তখন দিল্লিতে দ্বিতীয় মাস্টার্স শেষে এম-ফিল করছেন। ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখি, বাসবী মোটা ফ্রেমের চশমা পরে বিখ্যাত জওহরলাল ইউনিভার্সিটিতে ফোকলোর নিয়ে গবেষণায় নিমগ্ন। পরনে সেই আগের মতোন জিন্স আর পাঞ্জাবি। তার সঙ্গে ইউনিভার্সিটির একটা ক্যান্টিনে ভাত-মাছ খেয়ে একটা সেমিনারে যোগ দিয়েছিলাম সেদিন। কয়েক বছর আগে বাসবী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছে শুনে খুশি হয়েছিলাম বেশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈসর্গিক পরিবেশ বেশ ভালো লেগেছে জানাল। আবার কখনো নতুন কোনো পড়া বই নিয়ে উচ্ছ্বাস জানালে আমি বললাম, ওই বইটা কিন্তু অশোভন। শ্যালিকা-সুলভ ব্রীড়ায় হেসে সে দ্বিমত জানাল। এরই মাঝে এক দিন অশ্রুসজল চোখে আমার স্ত্রী জানাল, বাসবীর শরীরে কর্কট রোগ ধরা পড়েছে। চিকিৎসা শুরু হলো দেশে-বিদেশে। কিন্তু মরণব্যাধি শেষ পর্যায়ে শুনে আমার স্ত্রী হাহাকার করে উঠল। স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিলাম, প্রভুর কৃপায় প্রিয় বাসু সেরে উঠবে। ব্যয়বহুল আর কষ্টকর চিকিৎসার জাঁতাকলে পড়ে ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়লেও ফোনে বাসবীর কণ্ঠ ছিল সহজ-স্বাভাবিক, অনেকটা আগের মতোন অদম্য- উৎসুক। গত বছর করোনার গ্রহণকালে ভারতে গিয়ে কেমোথেরাপি নিয়েছে। চিটাগাংয়ে ফিরে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এর মাঝে করোনার ছোবলে জর্জরিত হয়ে সেরেও উঠেছিল। সুস্থতা আর অসুস্থতার দোলাচালে তার অনেক দিন কেটেছে। তবে শেষের দিকে খুব কষ্ট পাচ্ছিল। তবে সে এখন সব জাগতিক ও শারীরিক কষ্টের ঊর্ধ্বে। বাসবী এসএসসি ও এইচএসসিতে সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম দিকে স্থান পেয়েছিল। সুঠাম বাসবী হাঁটত দ্রুতলয়ে, কথাও বলত দ্রুত। চিন্তা-চেতনায়ও ছিল অন্যদের চেয়ে এগিয়ে। পথিকৃৎ বলেই হয়তো সমসাময়িকদের পিছনে ফেলে খুব দ্রুতই পাড়ি জমাল পরপারে। কিন্তু রেখে গেল পুরনো বইয়ের স্তূপ, কয়েকটা বলপয়েন্ট, কিছু অসমাপ্ত গবেষণা, কয়েক দিস্তা সাদা কাগজ, মা-বাবা, ভাইবোন আর বন্ধুদের।  আমার কিছু সাহিত্যকর্ম পড়ে উচ্ছ্বাস জানিয়েছিল বাসবী। তবে মাস্টারের মতো আজ্ঞাও দিয়েছিল এই বলে যে, নিয়মিত লিখবেন। হ্যাঁ, বাসবী, এই তো লিখছি তোমাকে নিয়ে। তুমি কি এখন হয়ে গেছ কিছু অসংলগ্ন অক্ষর? কয়েক মাস আগে তোমার ঠিকানায় আমার বইমেলায় প্রকাশিত ভ্রমণালেখ্য ‘বিলেতি সৌরভ’ পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু আর কোনো দিনই জানা যাবে না তোমার মতন গ্রন্থকিট মেধাবী মানুষটির পাঠ-প্রতিক্রিয়া। কোনো দিনই শুনতে পাব না বইপাগল মানুষটির হাসিমাখা অকপট অভিব্যক্তি। তুমি যে এখন অনন্ত-ভ্রমণের অভিযাত্রী! শোকস্তব্ধ হয়ে প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশেরই দ্বারস্থ হলাম :

সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে! কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে

সহজ লোকের মতো!

 

লেখক : যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক ও কথাশিল্পী।

সর্বশেষ খবর