মঙ্গলবার, ২৪ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

দাতব্যশিল্প : কভিড সাহায্য প্রতারণা

মধ্যমণিদের মধ্যে রয়েছেন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, চিহ্নিত সন্ত্রাসী আর অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি আর্মি জেনারেল

প্রতিদিন ডেস্ক

দাতব্যশিল্প : কভিড সাহায্য প্রতারণা

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে (চীন ছাড়া) ‘ভারতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের কল্যাণে কাজ করছে’ ভঙ্গি দিয়ে মানবতাবাদীদের থেকে অর্থ সংগ্রহের পর আত্মসাতের কাহিনি ফাঁস করে দেয় এশিয়ার প্রথম ডিসইনফো ল্যাব নামক ডিজিটাল গবেষণা সংস্থা। এ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হচ্ছে ভুয়া সংবাদ আর প্রচারণার ব্যাপারগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরা। এ পর্যায়ে সম্প্রতি ইসলামের নাম ব্যবহার করে যারা প্রতারণায় লিপ্ত তাদের কুকীর্তি প্রকাশ করে এবং অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে সম্বল করে বাংলাদেশের একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও পাকিস্তানের অবসরপ্রাপ্ত এক লে. জেনারেল কী কী অনাচার করেছেন তার বর্ণনা দেয়। ‘দাতব্যশিল্প : কভিড সাহায্য প্রতারণা’ শীর্ষক সেই প্রতিবেদন ব্যাপক আলোড়ন তোলে। বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৪ আগস্ট থেকে পর্যায়ক্রমে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করছে। আজ পঞ্চম কিস্তি উপস্থাপন করা হলো :

তহবিল লুটপাটের এই যে উৎসব তাতে অংশ নিয়েছিল আরেকটি দাতব্যপ্রতিষ্ঠান, যার নাম ‘মুসলিম এইড অস্ট্রেলিয়া’। মুসলিম এইড অস্ট্রেলিয়া স্থাপিত হয় ১৯৯১ সালে। নিবন্ধন পায় ২০১২ সালের ৩ ডিসেম্বর। অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মতোই, মুসলিম এইড অস্ট্রেলিয়াও ‘লাঞ্চগুড’ প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে ভারতে কভিড-১৯ সংকটে সাহায্যের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে।

এবার তারা একধাপ এগিয়ে একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসীকে তহবিল সংগ্রহের অনুপ্রেরণা হিসেবে উপস্থাপন করেছে তার নাম ড. বিল্লাল ফিলিপ। ৩ মে মুসলিম এইড অস্ট্রেলিয়া তহবিল সংগ্রহ প্রচারাভিযান শুরু করে এবং ২৫ হাজার ডলার লক্ষ্য স্থির করে। বিল্লাল ফিলিপ তার ফেসবুক পেজে ভারতের কভিড আক্রান্তদের সাহায্যার্থে অনুদান চেয়ে পোস্ট দেন।

দাতাদের প্রভাবিত করতে মুসলিম এইড অস্ট্রেলিয়া ‘লাঞ্চগুড’-এর একটি ছবি ব্যবহার করেছে যা একজন যক্ষা রোগীর ছবি। অথচ তারা কভিড-১৯ তহবিল সংগ্রহ প্রচারণার জন্য ছবিটি ব্যবহার করে।

মুসলিম এইড অস্ট্রেলিয়ার ২৭ মের পোস্ট অনুযায়ী তারা ভারতে ৪০টি অক্সিজেন যন্ত্র পাঠিয়েছে। তবে উপকারভোগী হাসপাতাল, ক্লিনিক বা স্বেচ্ছাসেবীদের ব্যাপারে কোনো তথ্য দেয়নি। শুধু তাই নয়, কোন রাজ্যের কোন জেলায় কাদের মাধ্যমে এ সাহায্য বিতরণ হলো তা-ও অজানা।

সন্ত্রাসী সমাজসেবক? : মুসলিম এইড অস্ট্রেলিয়া সেলিব্রেটি প্রচারাভিযান কর্তা ড. বিল্লাল ফিলিপ আদতে কানাডীয় মুসলিম শিক্ষক যিনি বর্তমানে কাতারে বসবাস করেন। তিনি চরমপন্থি ইসলামী জিহাদি তৈরির কারখানা খ্যাত Islamic Education Research Academy (IERA)-এর সাবেক পর্ষদ সদস্য। তিনি তালেবান ও হামাসের সাহায্যকারী এবং মদদদাতা হিসেবেও খ্যাত। মুসলিম এইডের জন্য তহবিল সংগ্রহের দায়ে তাকে খোদ অস্ট্রেলিয়ার কয়েকটি রাজ্যে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করা হয়। বিদেশেও তাঁর ইমেজ সুবিধার নয়। সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে সংশ্লিষ্টতা ও চরম জিহাদি ধ্যানধারণা পোষণের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কেনিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, বাংলাদেশ ও ফিলিপাইন তাকে নিষিদ্ধ করেছে।

অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা ড. বিল্লাল ফিলিপকে ২০০৭ সালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। যুক্তরাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর তাকে ২০১০ সালে, কেনিয়া ২০১২ সালে, ফিলিপাইন ২০১৪ সালে, বাংলাদেশ ২০১৪ সালে এবং ডেনমার্ক ২০১৭ সালে নিষিদ্ধ করে।

সন্ত্রাসী শিক্ষাবিদ :  বিল্লাল ফিলিপ ২০০৯-১০ সালে ভারতে কাজ করার সময় চেন্নাইতে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান Preston International College Ges AL-Fayr International School প্রতিষ্ঠা করেন। উভয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পর্ষদ সদস্যরা ছিলেন একই। আহমদ মিরান, জিফি কাশিম ও আবদুস সামাদ।

উভয় প্রতিষ্ঠানের মূল ব্যক্তিবর্গের মধ্যে দুজন ছিলেন একই। মোহাম্মদ উমর সোলাইমান (পরিচালক অপারেশন) ও আজিজুর রহমান (ব্যবস্থাপক অপারেশন)।

মুসলিম এইড ইউকে : এটি হচ্ছে প্রথম প্রতিষ্ঠিত সংগঠন যার জন্ম হয় ১৯৮৫ সালে। নিবন্ধন নম্বর CEO12794 এবং দাতব্য নম্বর ১১৭৬৪৬২। মুসলিম এইড ইউএসএর মতো মুসলিম এইড ইউকেও তার পর্ষদ সদস্যের পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছিল ২০১৬-১৮ সালে। এ পরিবর্তনের সম্ভাব্য কারণ গাম্বিয়া ও সুদানে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কেলেঙ্কারি। মূলত এটা ঘটেছিল ২০১০-১২ সালে।

মুসলিম এইড ইউকের বর্তমান কর্মকর্তারা হলেন- ইফতিখার আওয়ান- চেয়ারম্যান; সারা পান্তুলিংবানো- ডেপুটি চেয়ারম্যান,  ট্রাস্টি : মোহাম্মদ আবদুল আজিজ, আকিল আহমদ, মুস্তফা ফারুকি ও সলিম ওমর।

তহবিল সংগ্রহ : অন্যান্য ফ্রন্টের মতো মুসলিম এইড যুক্তরাজ্য ও ভারতে কভিড-১৯ রোগীদের সাহায্যার্থে তহবিল সংগ্রহ অভিযান চালায়। প্রচারাভিযান প্রধানত মে ২৩, মে ২৭ ও জুন ১০, ২০২১-এ পরিচালিত হয়।

তাদের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফরমে ব্যবহৃত সব চিত্রই ‘Shatter Stock’ বা অন্য সূত্র থেকে ৫০০ ডলারে কেনা। এ চিত্রের বেশির ভাগই ভারতে কভিড সংকটের সংশ্লিষ্ট নয়, এমনকি ভারত থেকে সংগৃহীত নয় যেজন্য অনুদান চাওয়া হয়েছিল। মালয়েশিয়ার এক রোহিঙ্গা বাসিন্দার ছবি ভারতের কভিড সংকটের বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

মজার ব্যাপার হলো, তাদের যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়াস্থ জ্ঞাতিদের মতোই মুসলিম এইড ইউকে তাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সরাসরি দান গ্রহণ করেছে, যার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আদৌ ছিল না। তহবিল বিতরণের প্রশ্ন তো থেকেই গেল।

সর্বশেষ খবর