শিরোনাম
সোমবার, ৩০ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

লকডাউনে ইত্যাদি

হানিফ সংকেত

লকডাউনে ইত্যাদি

মানুষ যা দেখতে চায় তা নিজের গরজেই দেখে, আবার অনেক সময় নিজের খরচেও দেখে। তবে ইদানীং ‘মান’ সংকটের কারণে পয়সা দিয়েও কেউ যেমন কোথাও অনুষ্ঠান দেখতে যায় না, তেমনি বিনা পয়সায়ও অনেকে টিভি অনুষ্ঠান দেখতেও আগ্রহী হয় না। আসলে চ্যানেলে চ্যানেলে অনুষ্ঠান সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে দেখানোর আগ্রহ বাড়লেও দর্শকের দেখার আগ্রহ খুব একটা বাড়েনি। রিমোট হাতে নিয়ে নিজের অজান্তেই কে যে কখন কোন চ্যানেলে কতবার ছুটে বেড়ায় তা সে নিজেও জানে না। যে যেই চ্যানেলেই যান বা তাকান, খবর-গান-ফান কিংবা আলোচনা অনুষ্ঠান, সবই যেন এক সমান। বেশির ভাগই ইনডোরভিত্তিক। টকশো, রকশো, লাইভ শো, কুইজ শো, সেলিব্রেটি শো, আড্ডা শো, প্রতিযোগিতা শো সবই স্টুডিওর চার দেয়ালের মধ্যেই। সংবাদের রিপোর্টিং, আর নাটকের বহির্দৃশ্য ছাড়া স্টুডিওর বাইরের দৃশ্য খুব একটা চোখে পড়ে না। আর কখনো যদি কোনো একটি নতুন বিষয় পাওয়া যায় তখন চলে লাইভ আর লাইভ, আলোচনা, পর্যালোচনা, সমালোচনা। যেমন পরীমণি। সে সময় করোনা বা ডেঙ্গুর ভয়াবহতার কথাও অনেকে ভুলে যায়। কারণ এখানেও ভিউ প্রতিযোগিতা। তবে এসব অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষ কোনো পরিকল্পনা বা গবেষণার প্রয়োজন হয় না। কজন টকার, কজন শিল্পী ও সেলিব্রেটিকে ডাকলেই এক ঘণ্টার একটি অনুষ্ঠান অনায়াসে নির্মাণ করা যায়। আর উপস্থাপকের হাসিমাখা মুখে রাশি রাশি এ ধরনের অনুষ্ঠানে দর্শক আকর্ষণে টান টান মান থাকে না বলে আজকাল টিভি অনুষ্ঠানও দেখতে চান না অনেকে। অনুষ্ঠান সৃষ্টিতে দৃষ্টিগ্রাহ্য অনেক অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে মূলত কৃষ্টিহীনতার কারণে। প্রত্যাশী দর্শকের প্রত্যাশিত প্রত্যাশার প্রাপ্তি ঘটে না, ফলে অনুষ্ঠানের মান মনোমতো ও মনোগত না হলে মনোতুষ্টির বদলে মনোকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এসব নানা কারণে আমরা আড়াই যুগ আগে থেকেই বৈচিত্র্য আনার জন্য স্টুডিওর চার দেয়াল থেকে অনুষ্ঠানকে নিয়ে যাই বাইরে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানে বিস্তৃত আমাদের শিকড়। উদ্দেশ্য শেকড়কে জানা এবং দর্শকদের তা জানানো। তাই দীর্ঘদিন থেকে আমরা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, সংস্কৃতি, প্রত্নতাত্তি¡ক নিদর্শন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত দৃষ্টিনন্দন স্থান, আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় স্থানসহ বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে গিয়ে ‘ইত্যাদি’ ধারণ করে আসছি। পরিকল্পনা অনুযায়ী যখন যেখানে প্রয়োজন সেখানে যাচ্ছি। ইত্যাদির এ দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় হঠাৎ করেই ছেদ পড়ার কারণ অতিমারী করোনা। গত দুই বছরে এ করোনার আপ-ডাউনের কারণে বিভিন্ন সময়ে নানান মেয়াদে বিধিনিষেধের লকডাউন দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন মহলের সোচ্চার দাবির মুখে কিছু কিছু বিধিনিষেধের লক আবার খুলেছেও। যদিও এ অতিমারী থেকে বাঁচার প্রধান অস্ত্র সবার স্বেচ্ছা সচেতনতা। এ অতিমারীতে সবকিছুর মতো থমকে গেছে ইত্যাদিও। মনে পড়ে ২০২০ সালের মার্চের কথা। প্রায় ৬০ জন বিদেশিকে নিয়ে ঈদ অনুষ্ঠানের মহড়া দিচ্ছিলাম, ধারণের আগেই বিদেশিরা করোনার ভয়ে ভীত হয়ে একে একে দেশ ছাড়তে শুরু করে। পরে নির্ধারিত সময়ের এক মাস আগেই ৩৫ জনকে নিয়ে কোনোরকমে ধারণ করেছি বিদেশি পর্ব। পরদিনই শুরু হলো ধারাবাহিক লকডাউন। সে সময় কোনো বাড়িতে করোনা রোগীর সন্ধান পাওয়া গেলে পুরো এলাকা লকডাউন করে দেওয়া হতো। ভয়ে সেই এলাকার সামনের রাস্তা দিয়েও কোনো গাড়ি যেত না। বিদেশি পর্ব শুটিং করার পর সেসময় আর কোনো শুটিং করা সম্ভব হয়নি। ২০২০ সালের ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়, যা চলে ৩০ মে পর্যন্ত। তাই দর্শকদের হতাশ না করে আমরা ঈদের ‘ইত্যাদি’ সাজাই সম্পাদনার টেবিলে। ঈদুল আজহায়ও লকডাউনে পড়ে আবারও লক হয়ে যাই। করি আরেকটি সংকলিত অনুষ্ঠান। সংকলিত হলেও অনুষ্ঠান দুটি দর্শকরা পছন্দ করেছিলেন। ২০২০ সালের ঈদুল আজহার পর সীমিত আকারে অফিস-আদালত খুলে দেওয়া হয়। করোনায়ও কিছুটা ভাটা পড়ে। আমরাও নতুন ইত্যাদি নিয়ে ভাবতে থাকি-স্বাস্থ্যবিধি মেনে, কম দর্শক এনে, সুশৃঙ্খলভাবে, কোথায় কীভাবে করা যায়। আগেই বলেছি ইত্যাদি ধারণ স্থানেরও একটি বিশেষত্ব থাকতে হয়। যে কোনো স্থান বা খোলা মাঠ পেলেই ধারণ করা হয় না। অনেক ভেবেচিন্তে নিরাপদ স্থান হিসেবে রাজশাহীর সারদায় অবস্থিত বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে ইত্যাদি করার সিদ্ধান্ত নেই। এ একাডেমি যেমন ঐতিহ্যবাহী তেমনি এর রয়েছে কিছু প্রাচীন নিদর্শন ও ইতিহাস। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সারদা পুলিশ একাডেমির স্থানটি ছিল নবাব আলীবর্দী খানের একটি সেনানিবাস। পরবর্তীতে ছিল ওলন্দাজদের বসতি স্থান। এখানে রয়েছে আড়াই শ বছর আগে নির্মিত গ্রিক ও রোমান স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত দুটি দৃষ্টিনন্দন ভবন ছোট কুঠি ও বড় কুঠি। আমরা অনুষ্ঠান করেছিলাম ছোট কুঠির সামনেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে এ একাডেমিতে অবস্থানরত কয়েক হাজার পুলিশ সদস্যকে আমরা দর্শক হিসেবে নিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানটি প্রচার হয় ২৯ অক্টোবর। এ দুর্যোগের সময় এখানে অনুষ্ঠান না করলে দর্শক নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ত। কারণ বিভিন্ন স্থানে ইত্যাদি ধারণের সময় লক্ষাধিক দর্শকও হয়। যা নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক সময় স্থানীয় প্রশাসনকেও হিমশিম খেতে হয়।

আমাদের পরবর্তী অনুষ্ঠান ছিল এ বছরের অর্থাৎ ২০২১ সালের ২৯ জানুয়ারি। তখনো করোনার প্রাদুর্ভাব ছিল। লকডাউন না থাকলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাসহ সীমিত বিধিনিষেধ ছিল। চিন্তায় পড়ে গেলাম এবার কোথায় অনুষ্ঠান করব? পুলিশ একাডেমির অভিজ্ঞতা নিয়ে ভাবনায় এলো চট্টগ্রাম নেভাল একাডেমির কথা। এখানেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনুষ্ঠান করা সম্ভব। কারণ এখানে আমাদের সুশৃঙ্খল নৌসদস্যরা থাকেন। আবার অনুষ্ঠানস্থল হিসেবে এ স্থানটির গুরুত্বও অপরিসীম। একদিকে কর্ণফুলী নদী, অন্যদিকে বঙ্গোপসাগর। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য বাংলাদেশ নেভাল একাডেমিকে যেমন ভিন্নমাত্রা দিয়েছে, তেমনি শৈলী ও শিল্পের বিচারে নিয়ে গেছে অন্যরকম উচ্চতায়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্ম হয় আমাদের ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশ নৌবাহিনীর। বর্তমানে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ১১৮.৮১৩ বর্গকিলোমিটার বিশাল সমুদ্রসীমার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে আসছে। আর আমাদের নৌসেনারা যুদ্ধ এবং শান্তিকালীন দুটি দায়িত্বই পালন করে থাকেন। সুতরাং এটি অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ এলাকা।

যোগাযোগ করলাম সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। আন্তরিক সহযোগিতা পেলাম। এ একাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য যে নৌসেনারা অবস্থান করছেন তাদের এবং নৌ কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের দর্শক হিসেবে নেওয়ার ফলে এখানেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা অনুষ্ঠানটি ধারণ করি। সাবমেরিন, যুদ্ধ জাহাজ, বঙ্গোপসাগর আর নান্দনিক ভবন বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্সের সামনে মঞ্চ নির্মাণ- সবকিছু মিলিয়ে ৩০ জানুয়ারি প্রচারিত এ অনুষ্ঠানটিও দর্শক প্রশংসিত হয়েছিল।

এরপরের অনুষ্ঠানটিই ছিল ঈদুল ফিতরের অনুষ্ঠান। প্রচার ঈদের পরদিন অর্থাৎ ২০২১ সালের ১৫ মে। আমরা মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে একটু একটু করে অনুষ্ঠানের শুটিং করতে লাগলাম এবং চূড়ান্ত ধারণের জন্য ১১ এপ্রিল ইনডোর স্টেডিয়াম বরাদ্দ নিলাম। কিন্তু করোনা বিস্তারের কারণে আবার পড়ে গেলাম লকডাউনে। ৫ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের জন্য ঘোষিত লকডাউন বাড়ানো হলো ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত। আবার বরাদ্দ নেই ১৯ তারিখ। উদ্দেশ্য ছিল এবার দর্শক ছাড়া দিনের বেলায়ই কোনোরকমে অনুষ্ঠানের বাকি কাজ সেরে ফেলব। কিন্তু আবারও পড়ে গেলাম লকডাউনে। ১৪ তারিখ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত লকডাউন ঘোষণা করা হলো, যা পরবর্তীতে ১৫ জুলাই পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সুতরাং সব প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও এবারও ঈদের নতুন ‘ইত্যাদি’ করতে পারলাম না। অনুষ্ঠান সাজালাম সম্পাদনার টেবিলে। ঈদ গেল এভাবেই, এলো পরবর্তী নতুন ইত্যাদি। প্রচারের তারিখ ৩০ জুলাই ২০২১। মাঝখানে সময় মাত্র একটি মাস-জুন। এদিকে করোনার ব্যাপক সংক্রমণের কারণে দেশব্যাপী মৃত্যু এবং আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাড়তে বাড়তে প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা গড়ে প্রায় আড়াই শ-তে গিয়ে পৌঁছেছে। চারদিকে ভীতিকর পরিবেশ। তারপরও বিভিন্ন মহলের সবকিছু খুলে দেওয়ার দাবি। সঙ্গে ইত্যাদির দর্শকরাও আমাদের ফ্যান পেজে এবং ই-মেইলে নতুন ইত্যাদি করার দাবি তুলেছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনেক কিছু হচ্ছে তাহলে ইত্যাদি কেন হবে না? তবে এটা কোনো রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক দাবি নয়-ভালোবাসার দাবি। কিন্তু ইত্যাদির দীর্ঘদিনের যাত্রায় হাজার হাজার দর্শক নিয়ে ধারণ করার যে সংস্কৃতি চলে আসছে তা থেকে হঠাৎ বের হওয়া যেমন কঠিন, তেমনি করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং শিল্পীসহ সবার স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা চিন্তা করে অনুষ্ঠান করাও কঠিন। আবার লকডাউনের কারণে ঢাকার বাইরে যাওয়াও সম্ভব নয়। তাই আমরা অনেক ভেবেচিন্তে ঢাকা ও এর আশপাশে গুরুত্বপূর্ণ স্থান কী আছে তা নিয়ে ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের স্বপ্নের মেট্রোরেল নিয়ে অনুষ্ঠান করব। কারণ মেট্রোরেল একটি জনগুরুত্বপূর্ণ মহা প্রকল্প। যথারীতি মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে লাইন-৬ এর কিছু স্থাপনা, উড়াল রেলপথ এবং স্টেশন পরিদর্শন করলাম এবং মেট্রোরেলের ডিপোতে গিয়ে অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম। যেখানে রয়েছে মেট্রোরেলের প্রধান প্রশাসনিক দফতরসহ ৫৫টি স্থাপনা। পরবর্তীতে মেট্রোরেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করায় তিনি সানন্দে অনুমতি দিলেন। শুটিং তারিখ নির্ধারণ করলাম ১৬ জুলাই। কারণ লকডাউন ঘোষণার চতুর্দশ দফায় ঈদুল আজহা উপলক্ষে ১৪ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ইতিপূর্বে আরোপিত সব বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়। আমরা ডিপোতে অবস্থিত ৪০ হাজার বর্গফুটের বিশাল ওয়ার্কশপে দুটি মেট্রোট্রেনের সামনে অনুষ্ঠান ধারণের স্থান ঠিক করলাম। বিদেশ থেকে আসার পর এই ওয়ার্কশপই হচ্ছে মেট্রোট্রেনের প্রথম গন্তব্যস্থল। এখানেই যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর ট্রেন চলার জন্য ছাড়পত্র দেওয়া হয়। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম স্বাস্থ্যবিধি মেনে মেট্রোরেলে কর্মরত স্থপতি, প্রকৌশলী ও তাদের পরিবার এবং কর্মীদের দর্শক হিসেবে নিয়ে অনুষ্ঠানটি করব। কিন্তু হঠাৎ করেই ধারণের ঠিক এক দিন আগে আবারও পড়ে গেলাম লকডাউনে। কারণ ১৪ জুলাই আরেকটি নির্দেশনায় শিথিল করা বিধিনিষেধের মধ্যে জনসমাগম হয় এ ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের ওপর পুনরায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। দর্শক নিয়ে এক ধরনের পরিকল্পনা করা হয়েছে, কিন্তু লকডাউনে লক হয়ে এখন আবার দর্শক ছাড়া চিন্তা করতে হবে। সময় নেই তাই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম, অনুষ্ঠান যেমন ছিল তেমনি হবে। দর্শকদের চেয়ারও থাকবে, কিন্তু কোনো দর্শক থাকবে না। চেয়ারগুলো থাকবে দর্শকশূন্য। নির্দিষ্ট দিনে কর্তৃপক্ষের আন্তরিক সহযোগিতায় রাত ১২টা পর্যন্ত মঞ্চের অংশ ধারণ করলাম।

যদিও কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তুরাগ নদী দিয়ে কোচ আসা থেকে শুরু করে মেট্রোস্টেশন, উড়াল রেলপথ, স্প্যান নির্মাণ ও বসানো, ওয়ার্কশপ, স্ট্যাবলিং হাউস বা মেট্রোরেলের বিশ্রামাগার, সাবস্টেশন, ওয়াশিং প্লান্টসহ মেট্রোট্রেনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো আগেই ধারণ করে ফেলি। মূলত ইত্যাদিতে ব্যাপক আয়োজন এবং প্রামাণ্য প্রতিবেদন থাকে বলে এর সম্পাদনার কাজটিও অত্যন্ত জটিল। ২০ থেকে ২৫ দিন একনাগাড়ে সম্পাদনা করতে হয়। তাই প্রতিবারই ইত্যাদি যে মাসে প্রচারিত হয় সে মাসের প্রথম সপ্তাহে ধারণ করে থাকি। কিন্তু এবার লকডাউন ও বিধিনিষেধের কারণে প্রচারের মাত্র ১৪ দিন আগে ধারণ করতে হয়েছে। ফলে সম্পাদনার সময় পেয়েছি মাত্র ১০ দিন। ১০/১২ দিনের শুটিং করা ফুটেজ কম্পিউটারে ঢোকানোর পর কেটেছেঁটে অনুষ্ঠান দাঁড় করাতে সবাইকে অনেক পরিশ্রম ও ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। সকাল ৭টা থেকে প্রতিদিন রাত ২/৩টা পর্যন্ত সম্পাদনা করে ২৪ তারিখ বিকালের মধ্যে অনুষ্ঠান প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলি। বাকি থাকে দুই দিনের কাজ মিউজিক, শব্দ নিয়ন্ত্রণ এবং টুকটাক কিছু মেরামতের কাজ। ২৬ তারিখ জমা দিতে হবে, কারণ প্রিভিউ। বিটিভির একটি বিশেষ প্রিভিউ কমিটি প্রচারের আগে অনুষ্ঠান দেখার নিয়ম রয়েছে। যেটি এখন অনেক স্বাধীন চ্যানেলেই নেই। আমরা দুটি কম্পিউটারে সম্পাদনার কাজ করছিলাম। ২৪ তারিখ সন্ধ্যায় হঠাৎ করে কারেন্ট চলে গেলে একটি কম্পিউটার অটো শাটডাউন হয়ে যায়। কারেন্ট এলেও উইন্ডোজ অন হচ্ছিল না। অথচ অনুষ্ঠানের ৮০ শতাংশ ফুটেজ এই কম্পিউটারে। এডিটররা অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে কজন পরিচিত ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভিডিও কলে তাদের নির্দেশনা অনুযায়ীও চেষ্টা করা হয়, তাতেও কোনো কাজ হলো না। এই করতে করতে রাত ১২টা বেজে যায়। এরপর পরিচিত একজন নির্ভরযোগ্য প্রকৌশলীর সঙ্গে যোগাযোগ করি, তিনি জানালেন তিনি হাসপাতালে। তার স্ত্রীর বাচ্চা হবে-সিজারিয়ান। মুখ বন্ধ হয়ে গেল। শুভ কামনা জানিয়ে নিজের অশুভ অবস্থার কথা ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়লাম। রাত ১টার দিকে গাড়ি পাঠিয়ে ধানমন্ডি ও শেওড়াপাড়া থেকে দুজন ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে আসি। তারা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করার পরও ঠিক হলো না। তারপর যেই হার্ডডিস্কে ইত্যাদির ফুটেজ আছে সেগুলো খুলে অন্য কম্পিউটারে লাগিয়ে চেষ্টা করা হলো কিন্তু তাদের অভিব্যক্তিতে বোঝা গেল হার্ডডিস্কে ফুটেজ থাকলেও সেটা এই মুহুর্তে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। কারণ কম্পিউটারে এরর দেখাচ্ছে। খুব হতাশ হয়ে গেলাম। ঘামতে লাগলাম। রাত সাড়ে ৩টা। সবার মধ্যেই টেনশন। কী হবে? আদৌ কি ফুটেজ পাওয়া যাবে? আজ রাতের মধ্যেই যদি ঠিক না হয় তাহলে এক দিনের মধ্যে সম্পাদনাও শেষ করা যাবে না। সম্পাদনা কক্ষের বাইরে এসে আবারও সেই ইঞ্জিনিয়ারকে ফোন দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার স্ত্রী কেমন আছে?’ বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ স্যার-আমার ছেলে সন্তান হয়েছে।’ খুশি হলাম। নিজ থেকেই জানতে চাইল, আমার সমস্যার সমাধান হয়েছে কিনা, বললাম-‘না’। ‘তাহলে এখন কী করবেন?’ বললাম, ‘তুমি কী আসতে পারবে? জানি এ অবস্থায় এটা বলাও আমার ঠিক হচ্ছে না কিন্তু প্রোগ্রামটা না গেলে আমার মতো অনেকেই কষ্ট পাবে। তাছাড়া পত্রপত্রিকায় প্রচার তারিখ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ সে বলল, ‘স্যার আমার আসতে আপত্তি নেই কিন্তু আমিতো এখন টঙ্গীতে, তাছাড়া লকডাউন চলছে। আসব কী করে?’ আমি আশ্বস্ত হলাম। তাকেও আশ্বস্ত করলাম। কারণ গণমাধ্যম লকডাউনের আওতামুক্ত। রাত ৩টা ৪০ মিনিটে টঙ্গীতে গাড়ি পাঠালাম, ৪৫ মিনিটের মধ্যেই চলে এলো। তার অক্লান্ত চেষ্টায় সকাল ৭টায় কম্পিউটারে লুকিয়ে থাকা হারানো সম্পদ ফিরে পেলাম। সারা দিন আর রাতের ক্লান্তি যেন এক নিমিষেই চলে গেল। ইঞ্জিনিয়ারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিলাম। আর আমরা লেগে পড়লাম কাজে। যে কাজ শেষ হলো পরদিন অর্থাৎ ২৬ তারিখ সকালে। অর্থাৎ ২৪ তারিখ সকাল থেকে টানা প্রায় ৫০ ঘণ্টা একনাগাড়ে সম্পাদনা কক্ষে আশা-নিরাশা-হতাশা আর সম্পাদনাযুদ্ধ শেষে বাসায় যখন ফিরলাম তখন সকাল ১১টা। সম্পাদনা কক্ষে থাকা আমরা চারটি প্রাণী ছাড়া এ সম্পাদনাযুদ্ধের খবর আর কেউ জানল না। বাসায় এসে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত শরীর এলিয়ে দিলাম বিছানায়। এভাবেই নানা ঘটনায় জন্ম হয় এক একটি ‘ইত্যাদি’র। আমি জানি দর্শকরা ইত্যাদি দেখার জন্য তাদের সময় রেখে দেন, আমরাও তাদের সেই সময়ের মূল্য দিতে চেষ্টা করি। শত পরিশ্রম, ক্লান্তি আর অশান্তির পর যখন অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়-সারা দেশের দর্শকের সঙ্গে অনুষ্ঠানটি দেখি। তখনো টেনশন কাজ করে, দর্শকদের প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে। ভালো লাগে তখন যখন অনুষ্ঠান দেখে দর্শকরা প্রশংসা করেন, বাবার বয়সী কেউ দোয়া করে বলেন-বেঁচে থাকো বাবা। পত্রিকায় শিরোনাম দেখি, ‘এবারের ইত্যাদি ছিল দূরদর্শী ও মানবিক চিন্তার ইত্যাদি’-দৈনিক ইনকিলাব। ‘গতিময় জ্যোতিময় এবারের ইত্যাদি’-দৈনিক মানবজমিন। ‘করোনাকালেও ইত্যাদি ছিল উপভোগ্য’-দৈনিক যুগান্তর। ‘আফসোস! চেষ্টা করেও কেউ ‘ইত্যাদি’-কে ঠিকঠাক নকল করতে পারল না!’-দৈনিক ইত্তেফাক। ‘শিক্ষা-তথ্য-বিনোদনে ভরা প্রশান্তিময় ইত্যাদি’-দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন। তখন আমাদেরও ভালো লাগে। ভুলে যাই সব কষ্ট, শ্রম, ভোগান্তি, আর ক্লান্তি। মনটা ভরে ওঠে এক অনাবিল প্রশান্তিতে।

লেখক : গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়নকর্মী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর