রবিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

সহজ নয় এডিস ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ

মো. খলিলুর রহমান

করোনা মহামারীর সময় বাহকবাহিত রোগের মধ্যে যেটি সবচেয়ে বেশি জনসমস্যা হিসেবে চিহ্নিত তা হলো ডেঙ্গু, যা একসময়ের শহরের রোগ থাকলেও ২০১৯ সাল থেকে প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদে ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি কোনো কোনো অঞ্চল বা জেলায় বড় স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হতে যাচ্ছে। যে বিষয়টি স্বাস্থ্য বিভাগকে বেশি ভাবিয়ে তুলেছে তা হলো, ডেঙ্গু আস্তে আস্তে গ্রামের স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হতে যাচ্ছে। এডিস মশা মূলত শহরের মশা যা এডিস ইজিপ্টি নামে পরিচিত এবং গ্রামাঞ্চলে এ মশার যে জাত পাওয়া যায় তা অ্যালবোপিকটাস নামে পরিচিত, যাকে মনে করা হয় ডেঙ্গু রোগের সেকেন্ডারি ভেক্টর, যার রোগ বিস্তারের যৎসামান্য ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। এডিস ইজিপ্টি মশা মূলত পুরনো টায়ারে জমা পানি, নির্মাণাধীন ভবনের মেঝেতে জমা পানি, লিফটের গর্তে জমা পানি, মিটারের গর্তে জমা পানি এবং প্লাস্টিক ড্রাম, প্লাস্টিকের পরিত্যক্ত পাত্র, দই পাত্রসহ অন্যান্য পরিত্যক্ত পাত্রে ডিম পাড়ে। এডিস অ্যালবোপিকটাস মশা মূলত গ্রামীণ মশা হিসেবে পরিচিত। এ মশা ন্যাচারাল পাত্র যেমন গাছের কোটর/গর্ত, কলা ও মানকচু জাতীয় গাছের কান্ড; বাঁশের গোড়ার পরিত্যক্ত অংশের গর্ত এবং গ্রামে ব্যবহৃত পরিত্যক্ত পাত্র যেমন সিমেন্টের চারি, মাটির মটকা, কলসসহ অব্যবহৃত পাত্রে জমা পানিতে ডিম পাড়ে; যার সঠিক ব্যবস্থাপনা বেশ কঠিন। মশার জাতসমূহের মধ্যে এডিস একমাত্র মশা যা বিশেষ কিছু বিশেষত্ব বহন করে। এডিস মশা পাত্রের গায়ে পানির সার্ফেসের আর্দ্রতাযুক্ত স্থানে ডিম পেড়ে দেহনিঃসৃত এক ধরনের গ্লু বা আঠার মাধ্যমে পাথরের গায়ে আটকিয়ে রাখে। পাত্রের পানি শুকিয়ে গেলেও তা সুপ্ত অবস্থায় ছয় মাস এমনকি এক বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। যখন পানি ও উপযুক্ত পরিবেশ পায় তখন ডিম থেকে ফুটে লার্ভা ও পরিপক্ব মশা জন্ম নেয়। সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো ওই ডিম যদি ভাইরাসবাহী হয়, ডিম থেকে যেসব লার্ভা ও পরিপক্ব মশা বের হয় তা-ও ভাইরাসবাহী হয়, যা পরবর্তী বছর পরিবেশে ভাইরাস সংক্রমণের জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে তিন-চার বছর ধরে ডেঙ্গু চারটি টাইপের মধ্যে অপেক্ষাকৃত মারাত্মক টাইপ  DEN-3 ভাইরাস সংক্রমণ কমিউনিটিতে বিরাজমান। বিষয়টি বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ বছর জিন সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে নিশ্চিত করলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. মো. সাইফুল্লাহ মুন্সি তাঁর গবেষণায় তিন-চার বছর ধরেই ডেঙ্গুর সেরোটাইপ বিশ্লেষণে  DEN-3 -এর অস্তিত্ব কমিউনিটিতে পেয়েছেন। ২০০০ সালে ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে EN-1 ও DEN-2 টাইপ সংক্রমিত হওয়ায় ওই টাইপের প্রতি দেহে অনেকাংশেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয় এবং এ টাইপ দুটির প্রতি অনেকাংশেই ইমিউনিটি অর্জন করেছে। এ বছর  DEN-3 সংক্রমণ হওয়ায় ডেঙ্গু অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে ও মৃত্যুঝুঁকি অনেকটা বেড়ে গেছে। জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা, সিডিসি, স্বাস্থ্য অধিদফতর ২০০০ সালে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু থেকে এডিস মশার ওপর জরিপ চালিয়ে আসছে। মাঝে কয়েক বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ কম থাকায় এ কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ২০১৪ সাল থেকে পুনরায় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু জরিপ কাজ পরিচালনা করা হলেও ২০১৭ সালে চিকুনগুনিয়া মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ায় ওই জরিপ কাজ নিয়মিতভাবে বছরে তিনবার মৌসুম-পূর্ব, মৌসুম, মৌসুম-পরবর্তী সময়ে পরিচালনা করে আসছে। মৌসুম-পূর্ব, মৌসুম ও মৌসুম-উত্তর জরিপ কাজের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বিল্ডিংয়ের মেঝে, প্লাস্টিকের বালতি, ড্রাম, পরিত্যক্ত টায়ার, ফুলের টব, মাটির পাত্র ও মিটারের গর্তে জমা পানিতে সর্বাধিক লার্ভার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। একইভাবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা, সিডিসি, স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ জরিপ কাজে দেখা যায় নির্মাণাধীন ও বহুতলবিশিষ্ট ভবনে সর্বাধিক এডিস মশার ঘনত্ব পাওয়া যায়। যেসব ভবনে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায় তার মধ্যে নির্মাণাধীন ও বহুতল ভবনের সংখ্যা শতকরা ৫০ ভাগের বেশি। এসব ভবনে রক্ষিত ও পরিত্যক্ত প্রজননস্থলগুলো সর্বাধিক এডিস মশার লার্ভা উৎপাদনে ভূমিকা রাখে, যা কখনো কখনো ১০০ থেকে ১ হাজার গুণ পর্যন্ত হয়। মৌসুম ঋতুতে যেহেতু প্রতিনিয়ত বৃষ্টি হয় তাই রিমুভাল ছোট ছোট প্রচুর পরিত্যক্ত পাত্রে জমা পানিতেও এডিস মশার লার্ভা উৎপন্ন হয়, যা বৃষ্টির সময় যথেষ্ট লার্ভা উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য এ মুহূর্তে যে বিষয়গুলো বেশি জোর দেওয়া প্রয়োজন তা হলো- ১. যেহেতু পরিবেশে প্রচুর পরিপক্ব ভাইরাসবাহী মশা রয়েছে যা তিন থেকে চার সপ্তাহ, কখনো ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত ভাইরাস সংক্রমণে ভূমিকা রাখে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরিপক্ব মশা মেরে তার ঘনত্ব কমিয়ে আনা প্রয়োজন। ২. পরিপক্ব মশা মারার পাশাপাশি পরিবেশে বিদ্যমান ডিম ও লার্ভা ধ্বংসে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেহেতু ওই ডিম ও লার্ভা ভাইরাসবাহী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ৩. ঢাকা শহরের বড় বড় অনেক নালায় প্রচুর পরিত্যক্ত পাত্র রয়েছে যা বৃষ্টি ঋতুতে মশার প্রজনন উৎস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব পরিত্যক্ত কনটেইনার দূরীকরণ ও যন্ত্রচালিত মেশিনের মাধ্যমে লম্বা হোসপাইপ ব্যবহারের সাহায্যে লার্ভিসাইড স্প্রে করে ওইসব এলাকায় লার্ভা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ৪. প্রতিটি নির্মাণাধীন ভবনের শ্রমিককে লার্ভিসাইড স্প্রের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান করে নির্মাণাধীন ভবন কর্তৃপক্ষের নিজ নিজ ব্যবস্থাপনায় প্রতি সপ্তাহে একবার লার্ভিসাইড স্প্রের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ ও নিয়মিত মনিটরিংয়ের দায়িত্ব পালন করতে পারে। ৫. প্রতি মহল্লায় যেসব সোসাইটি রয়েছে তাদের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে এডিস মশার প্রজননস্থান নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মৌসুম শুরুর আগে এপ্রিল-মেতে এডিস মশার মাদার প্রজননস্থলসমূহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মৌসুমের শুরুতেই এডিস মশার ঘনত্ব নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখার ব্যবস্থা করলে পরে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সহায়ক হবে।

লেখক : সাবেক জাতীয় পরামর্শদাতা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বাংলাদেশ ও সাবেক প্রধান কীটতত্ত্ববিদ, সিডিসি, ডিজিএইচএস।

সর্বশেষ খবর