শনিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ভোট ছাড়া নির্বাচন, বেচারা জনগণ

সৈয়দ বোরহান কবীর

ভোট ছাড়া নির্বাচন, বেচারা জনগণ

অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত একজন গুণী মানুষ। প্রথিতযশা চিকিৎসক। দুই দফা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। গরিবের জন্য অন্তঃপ্রাণ। বহু দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা বিনামূল্যে করেছেন। রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিত্ব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। ওয়ান-ইলেভেনের কঠিন সময়ে শেখ হাসিনার চিকিৎসক দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। যখন কুমিল্লা-৭ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হলো তখন অনেকের মতো আমিও উল্লসিত হয়েছি। দুর্বৃত্তায়নের রাজনৈতিক চক্র ভাঙতে প্রাণ গোপাল দত্তের মতো মানুষের রাজনীতিতে আসা জরুরি। তার চেয়েও জরুরি, মনোনয়ন এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ায় তাদের সুযোগ করে দেওয়া যাতে তারা রাজনীতিতে অবদান রাখতে পারেন। কুমিল্লা-৭ আসনের উপনির্বাচনের প্রয়োজন হয়েছিল সেখানকার সংসদ সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফের মৃত্যুর কারণে। যেহেতু বিএনপি এখন কোনো নির্বাচনেই অংশগ্রহণ করছে না তাই এ শূন্য আসনে আওয়ামী লীগ কাকে মনোনয়ন দেয় তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ প্রয়াত আলী আশরাফের আসনে তাঁর ছেলে মুনতাকিম আশরাফও মনোনয়ন-প্রত্যাশী ছিলেন। একজন জাতীয়ভাবে পরিচিত, প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি মনোনয়ন পাবেন, না উত্তরাধিকারের রাজনীতি জয়ী হবে- এ নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল সব মহলে। আওয়ামী লীগ এবং মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি এ মনোনয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার প্রমাণ রাখেন। ১১ সেপ্টেম্বর মনোনয়ন বোর্ডের সভায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ‘নেতা-মন্ত্রী কিংবা সংসদ সদস্যদের সন্তানরা রাজনীতিতে থাকতে চাইলে স্ট্রাগল করে আসুক।’ তাই প্রাণ গোপাল দত্তের মনোনয়ন লাভ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এ ঘটনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী উত্তরাধিকারের রাজনীতি হটিয়ে যোগ্যতার রাজনীতি সামনে আনলেন। অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত এমনিতেই এলাকায় বেশ জনপ্রিয়। গত কয়েক বছর তিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকায় বেশ কাজ করেছেন। জনসংযোগ করেছেন, কাজেই খুব বড় অঘটন না ঘটলে এ উপনির্বাচনে তাঁর বিজয় ছিল মোটামুটি নিশ্চিত। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় দেখা গেল চারজন জমা দিয়েছেন। বাছাইয়ে একজনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। কিছুদিন ধরেই সারা দেশে নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের অনীহা দেখা যাচ্ছে। ভোটাররা ভোট দিতে যান না। এমনকি দলের কর্মী-সমর্থকরাও কেন্দ্র থেকে দূরে থাকেন। জনগণের এ উদাসীনতার কারণ নিয়ে নিশ্চয়ই গবেষণা হচ্ছে এবং হবে। কিন্তু প্রাণ গোপাল দত্তের মতো সর্বজনগ্রহণযোগ্য ব্যক্তিরা যখন নির্বাচনে দাঁড়ান তখন ভোটবিমুখ মানুষকে কেন্দ্রে নিয়ে আসার একটি উপলক্ষ তৈরি হয়। এ ভোট প্রাণ গোপাল দত্তকে জেতানোর জন্য নয়, তাঁকে প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত সমর্থন জানানোর জন্য। আমি প্রত্যাশা করেছিলাম এ নির্বাচনের মাধ্যমে ভোট উৎসবে আবার মানুষ ফিরে আসবে। কিন্তু আমি এবং আমার মতো কিছু মানুষ আশাহত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান জাতীয় পার্টি এবং ন্যাপ প্রার্থী। জাতীয় পার্টির প্রার্থী লুৎফর রেজা দলটির কেন্দ্রীয় নেতা। তিনি জেলার আহ্বায়ক। তাঁকে নির্বাচন থেকে কেন সরে যেতে হবে? চাপের মুখে তিনি যে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি তা নিশ্চিত। তাঁর প্রার্থিতা প্রত্যাহার নিয়ে নানা রকম কথাবার্তা শোনা যায়। জাতীয় পার্টিও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। জাতীয় পার্টি এবং ন্যাপ প্রার্থীর সরে দাঁড়ানোর পর অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বিনা ভোটে এমপি হলেন। বেচারা জনগণ। ভোট দিয়ে প্রাণ গোপালকে স্বাগত জানাতে পারল না। শুধু কুমিল্লা-৭ আসন নয়, ২০ সেপ্টেম্বর দেশের ১৬০ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। স্থানীয় পর্যায়ের এ নির্বাচনেও বিনা ভোটের রেকর্ড হয়েছে। ১৬০টির মধ্যে ৪৫টিতেই ভোট হয়নি চেয়ারম্যান পদে। ইউনিয়ন পরিষদ হলো বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় ক্ষুদ্রতম একক। এ নির্বাচনে বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হবেন এটা অকল্পনীয়। কারণ দলীয় পরিচয়ের বাইরে এ নির্বাচনে অনেকে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ নির্বাচনব্যবস্থায় সর্বশেষ ব্যাধির নাম ভোটবিহীন নির্বাচন। এখন ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পেলেই হলো। এরপর তাদের প্রধান লক্ষ্য হয় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া। এজন্য তিনি অন্য প্রার্থীদের ছলেবলে-কৌশলে নির্বাচন থেকে বিচ্ছিন্ন করেন। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী গোঁ ধরে থাকেন সেখানে নির্বাচন হয়। কিন্তু তত দিনে পরিস্থিতি এমন হয় যে মানুষ ভোট দেওয়ার আগ্রহই হারিয়ে ফেলে। ফলে ভোট উৎসব হয়ে গেছে বিবর্ণ। যিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন তিনিই নির্বাচিত হবেন, এটাই যেন এখন নিয়তি। কোথাও নামমাত্র ভোট হয়। কোথাও ভোটের আগেই প্রার্থী বিনা ভোটে বিজয়ী হন। এটা যে গণতন্ত্রের জন্য কত বড় সর্বনাশ তা কি বিনা ভোটে জয়ী জনপ্রতিনিধিরা বোঝেন? বাংলাদেশের সংবিধানের ১২২ (১) ধারায় বলা হয়েছে- ‘প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার ভিত্তিতে সংসদের নির্বাচন হবে।’ কিন্তু ভোটই যদি না হয় তাহলে একজন সংসদ সদস্য কি বৈধ? এটি সাংবিধানিক বিতর্কের বিষয়। আমি সে বিতর্কে যেতে চাই না। কিন্তু আমার মনে একটি প্রশ্ন, জনগণের ভোট না পেয়েই যদি কেউ জনপ্রতিনিধি হন, তিনি কি মোটেও লজ্জিত হন না? ভোটার এবং প্রার্থীর সম্পর্ক হবে ফেভিকলের মতো। কিন্তু এখন যেন প্রার্থীরা ভোটারদের থেকে দূরে থাকতে চান। সামাজিক দূরত্ব রেখে জনগণের কাছে না গিয়ে জনপ্রতিনিধি হওয়ার এক ব্যাধি ক্রমে সংক্রমিত হচ্ছে দেশে। এ দেশের জনগণ ভোটের অধিকারের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। বুকের রক্ত দিয়েছে। ভোট নিয়ে এ দেশের মানুষই সম্ভবত সবচেয়ে প্রতারিত হয়েছে। বিনা ভোট হলো জনপ্রতারণার সর্বশেষ নজির। অগণতান্ত্রিক, অবৈধ এবং স্বৈরাচাররা ভোটব্যবস্থা নষ্ট করেছে নিজেদের স্বার্থে। ’৭৫-এর পর জিয়া হ্যাঁ-না ভোটের তামাশা করেছেন। জিয়াকে খুশি করতে ‘হ্যাঁ’র বক্সে এত জাল ভোট দেওয়া হয়েছিল যে হ্যাঁ ভোটের সংখ্যা ১০০ ভাগের ওপর চলে গিয়েছিল। ১৯৭৭ সালের ৩০ মে অনুষ্ঠিত হ্যাঁ-না ভোটের কৌতুকে জিয়ার পক্ষে ৯৮ দশমিক ৮০ ভাগ ভোট পড়ে। প্রয়াত সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহর ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া অব বাংলাদেশ : এ পলিটিক্যাল বায়োগ্রাফি’ গ্রন্থে সাইফুর রহমানের বরাতে বলা হয়েছিল- ‘এটি ছিল অবিশ্বাস্য এবং অতি উৎসাহীদের কান্ড’। (পৃষ্ঠ-৭১)। ১৯৭৯ সালে জিয়ার নেতৃত্বে আরেকটি ভোট প্রহসন মঞ্চস্থ হয়। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। সাজানো এবং পরিকল্পিত নির্বাচনে সেনা পোশাক পরে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন জিয়াউর রহমান। নির্বাচনী প্রচারণায় জিয়া ঘোষণা করেন, আওয়ামী লীগকে ৪০টির বেশি আসন দেওয়া হবে না। বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ তখন বিভক্ত। একাংশের নেতৃত্বে ছিলেন মালেক উকিল, অন্য অংশের মিজানুর রহমান চৌধুরী। মালেক উকিলের আওয়ামী লীগই ছিল মূল আওয়ামী লীগ। এ আওয়ামী লীগই নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ (মিজান) পায় মই প্রতীক। আওয়ামী লীগ (মালেক) ২৯৫ আসনে প্রার্থী দেয়। ৩৯ আসনে জয়ী হয়। আর আওয়ামী লীগ (মিজান) ১৮৪ আসনে প্রার্থী দিয়ে দুটি আসনে জয়ী হয়। এ নির্বাচন ছিল জনগণের সঙ্গে প্রতারণা। জিয়ার মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ছিল জনগণের ভোটাধিকার হরণের আরেক দলিল। সে সময় আওয়ামী লীগের নবযাত্রার সূচনা হয়েছে। আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। জিয়ার মৃত্যুর পর কোন্দলে জর্জরিত বিএনপি। এ সময় কোন্দল এড়াতে উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী তিনি (বিচারপতি সাত্তার) ছিলেন নির্বাচনের অযোগ্য। তাকে প্রার্থী করতে সংবিধান সংশোধন করে বিএনপি। আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী হিসেবে বেছে নেয় ড. কামাল হোসেনকে। এটি ছিল প্রকাশ্য জালিয়াতি এবং ভোট ডাকাতির এক লোমহর্ষক নির্বাচন। কেন্দ্রে পুলিশ বেষ্টিত অবস্থায় প্রশাসনের লোকজন বিএনপি প্রার্থী সাত্তারের পক্ষে সিল দেয়। (সূত্র : দৈনিক সংবাদ, ১৬ নভেম্বর ১৯৮১)। ভোট ছিনতাই করেই রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন বিচারপতি সাত্তার। তবে ভোট ছিনতাই করে রাষ্ট্রপতি হওয়া সাত্তার সিংহাসনে বেশি দিন থাকতে পারেননি। মাত্র চার মাসের মাথায় মঞ্চে আসেন সেনাপ্রধান এরশাদ। আবার একই কায়দায় বেতার-টেলিভিশনে ভাষণ। জিয়ার মতো এরশাদও প্রথমে ছিলেন পেছনে। বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরী ছিলেন কাগজ-কলমে রাষ্ট্রপতি। জিয়ার মতোই এরশাদ বলেন, ‘আমি সৈনিক, রাজনীতি আমার কাজ নয়, আমি ব্যারাকে ফিরে যাব।’ জিয়ার মতো জনগণকে প্রতারিত করে এরশাদ সামরিক পোশাকেই দল গঠন করেন। ১৯৮৬ সালের ৭ মে এরশাদ সংসদ নির্বাচন দেন। ওই নির্বাচনে ভোট কারচুপি এবং ভোট প্রহসনের এক নতুন ফরমুলা আবিষ্কার হয়। এর নাম ‘মিডিয়া ক্যু’। ওই নির্বাচন নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। সব বিরোধী দল ওই নির্বাচনে যাওয়ার কথা থাকলেও আকস্মিকভাবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়। জাসদসহ আরও কয়েকটি দল নির্বাচন বয়কট ও প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়। ফলে ১৫ দল ভেঙে যায়। এ রকম পরিস্থিতির মধ্যেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আট দল নির্বাচনে এক গণজোয়ার সৃষ্টি করেছিল। সহিংস এ নির্বাচন শেষে যখন বেতার ও টেলিভিশনে ফলাফল ঘোষণা শুরু হয় তখন দেখা যায় আওয়ামী লীগ এগিয়ে। মধ্যরাতে হঠাৎ ফলাফল ঘোষণা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ নিশ্চিত জয়ের পথে যাচ্ছে এমন তথ্যের পর ফলাফল ঘোষণা বন্ধ করা হয়েছিল সেদিন। এরপর এক ভুতুড়ে পরিস্থিতি তৈরি হয়। নির্বাচন কমিশনে বসে বানোয়াট ফলাফল তৈরি হয়। ১১ দিন পর ১৯ মে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফল ঘোষিত হয়।

১৯৮৬-এর নির্বাচন আওয়ামী লীগকে সমালোচিত করেছে, বিএনপিকে লাভবান করেছে। তার চেয়েও বড় কথা, জনগণের আকাক্সক্ষা হরণ করা হয়েছে। জনগণের রায়কে মিডিয়া ক্যুর মাধ্যমে পাল্টে ফেলা হয়েছে। এরশাদের আরেক কৌতুক ছিল রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। ১৯৮৬-এর ১৫ অক্টোবর এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রধান প্রধান সব বিরোধী দল এ নির্বাচন বর্জন করে। তাতে কি, এরশাদ ১২ জন প্রার্থী জোগাড় করে ফেলেন। এরা যেন প্রার্থী নন, কৌতুক অভিনেতা অথবা ভাঁড়। এদের মধ্যে অলিউল ইসলাম চৌধুরী (ছক্কু মিয়া) কৌতুক অভিনেতা হিসেবে প্রশংসিত হন। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে এরশাদ ১৯৮৬-এর জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন। ১৯৮৮-এর ৩ মার্চ আবার নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে আবারও জাতিকে কৌতুক উপহার দেন এরশাদ। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব বিরোধী দল ওই নির্বাচন বর্জন করে। আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে এরশাদের পৃষ্ঠপোষকাতায় গড়ে ওঠে সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ)। এ জোটে এমন সব দল ছিল যে তাদের খুঁজে বের করাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ওই নির্বাচনে অংশ নিয়ে আ স ম আবদুর রব ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের খেতাব পান। ১৯৮৮-এর নির্বাচনেও কোনো ভোট হয়নি। জনগণ ভোট দেয়নি। নির্বাচন কমিশন টেবিলে বসে মনের মাধুরী মিশিয়ে ফলাফল তৈরি করেছে। এরপর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা তৈরি করেন। এরশাদের পতনের লক্ষ্যে এই এক দফা দাবিতে গড়ে ওঠে তীব্র গণআন্দোলন। এরশাদের পতন হয়। ১৯৯১-এ প্রথমবারের মতো দেশে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনের পর সবাই আশা করেছিল মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’- এ স্লেøাগান বাস্তবতা পাবে। কিন্তু বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে আবার জনগণের ভোটাধিকার হরণের খেলায় মেতে ওঠেন। মাগুরা ও মিরপুর উপনির্বাচনে নির্লজ্জ কারচুপির ঘটনা ভোটব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করে। আবার নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে যায় এ দেশের মানুষ। এ আন্দোলনের মধ্যেই ক্ষমতায় থাকার মরিয়া চেষ্টা করে বিএনপি। ১৯৯৬-এএর ১৫ ফেব্রুয়ারি এক ভুতুড়ে নির্বাচন করে। স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে বেগম জিয়া বানোয়াট ফলাফল ঘোষণা করেন। গোটা জাতি ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারি কলঙ্কিত নির্বাচন অবশ্য বেগম জিয়াকে মাত্র কয়েক দিন ক্ষমতায় রাখতে পেরেছিল। বেগম জিয়া নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য হলেন। ১৯৯৬ ও ২০০১-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এ নির্বাচনে প্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল, কারচুপি হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষপাতও নজর এড়ায়নি। কিন্তু এতসব ত্রুটি-বিচ্যুতির পরও মানুষ ভোট দিতে পেরেছে এবং জন-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু ২০০১-এর অক্টোবর নির্বাচনের পর বিএনপি ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করতে চায়। এখানেই আবার সংকটে পড়ে গণতন্ত্র এবং নির্বাচন। বিএনপি-জামায়াত জোট ২০০১-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করতে চায়। তবে তা রাজনৈতিকভাবে নয়, পাশবিক ও সন্ত্রাসী কায়দায়। ১ অক্টোবর ভোটের ফলাফলের পর সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর শুরু হয় নির্মম পাশবিকতা। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ চলে নির্বিচারে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু নিঃশেষের এক মিশনে নামে বিএনপি-জামায়াত। এরপর শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতাদের হত্যা করা শুরু হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা ছিল এ মাস্টারপ্ল্যানের চূড়ান্ত বাস্তবায়ন। কিন্তু ওই ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। একদিকে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিজেদের মতো করে সাজানোর পরিকল্পনা নেয় বিএনপি। সাবেক বিএনপি নেতা কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি-জামায়াত জোট। বিচারপতি হাসান যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান থাকতে পারেন সেজন্য সংবিধান সংশোধন করে প্রধান বিচারপতির বয়স বাড়ানো হয়। নির্বাচন কমিশনে বসানো হয় একান্ত অনুগত ব্যক্তিদের। দেড় কোটি ভুয়া ভোটার তৈরি করা হয়। প্রশাসন বিএনপি-জামায়াত পন্থিদের নিয়ে সাজানো হয়। ১০ জনকে ডিঙিয়ে সেনাপ্রধান করা হয় বিশ্বস্ত জেনারেল মইন উ আহমেদকে। এত কিছু করেও শেষরক্ষা হয়নি বিএনপির। ১/১১ ঝড়ে সব ল-ভ- হয়ে যায়। দুই বছর সেনাসমর্থিত অনির্বাচিত শাসনের পর জনতার জয় হয়। ২০০৮-এর ডিসেম্বর বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে আরেকটি মাইলফলক। আমি এ নির্বাচনকে অনেকটাই ১৯৭০-এর ভোট বিপ্লবের মতোই মনে করি। জনগণের রায়ের এক স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ ২০০৮-এর নির্বাচন। আবার গণতন্ত্রের সড়কে চলা শুরু করে বাংলাদেশ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপির নোংরা ও কুৎসিত রাজনৈতিক খেলার কারণেই এ নির্দলীয় ব্যবস্থা বিতর্কিত হয়ে যায়। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলোপ হওয়াটা ছিল অনিবার্য পরিণতি। সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। ফলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের চ্যালেঞ্জটা আসে রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের ওপর। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সবকটিতে বিএনপি জয়ী হয়। ওই নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার, ‘সব দলের অংশগ্রহণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের’ প্রস্তাব দিয়েছিল। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী গণভবনে চায়ের দাওয়াত দিয়েছিলেন। এতসব কিছুর পরও বিএনপি ২০১৪-এর নির্বাচন বয়কট করে। কেন? বিএনপির অনেক নেতাই এ প্রশ্বের উত্তর জানেন না।

২০১৮-তে আবার সব দল নির্বাচনে অংশ নেয়। বিএনপি তখন বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত। সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় ছিল সুনিশ্চিত। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে কী হয়েছে দেশের জনগণ জানে। যারা অতি উৎসাহী হয়ে ওই নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন তারা কি আওয়ামী লীগের শুভাকাক্সক্ষী? ২০১৮-এর নির্বাচন আর এখন আমলাদের দৌরাত্ম্যের মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা রাজনীতির জন্যই জরুরি। বিনা ভোটের মঞ্চ যেন গণতন্ত্রকে ফাঁসিতে ঝোলানোর মঞ্চ। ভোট জনগণের একটি অধিকার। জনগণ যত এ অধিকার প্রয়োগ করবে ততই গণতন্ত্র সংহত ও শক্তিশালী হবে। জনগণকে বাদ দিয়ে যদি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হন, তিনি তো আর জনপ্রতিনিধি থাকেন না। তাই গণতন্ত্র বাঁচাতে ভোটে ফেরাতে হবে জনগণকে। জনগণকে ‘বেচারা’ বানালে গণতন্ত্রই অচল হবে।

 

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর