শুক্রবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক

ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন

বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক

প্রায় ১৭ বছর আগের ঘটনা। ড্রয়িংরুমে বসে অস্ট্রেলিয়ান বন্ধুদের সঙ্গে টেলিভিশন দেখছি। আফ্রিকান কোনো একটি শহরের ছবিতে কয়েকটি ইটের তৈরি ভবন দেখে এক অস্ট্রেলিয়ান বন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, বাংলাদেশে এ রকম ভবন আছে? বন্ধুর প্রশ্নে আমি খুব একটা অবাক হইনি। কারণ তখন অধিকাংশ অস্ট্রেলিয়ানের কাছে বাংলাদেশ মানে ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত দরিদ্র একটি দেশ। এখন দিন বদলেছে। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ইমেজ বদলে গেছে। বিশেষ করে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছেন। পৃথিবীর কাছে বাংলাদেশ আজ এক উন্নয়ন বিস্ময়! অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসহ উন্নয়নের সব সূচকে বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাপারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে যেমন বাংলাদেশের অভাবিত এ উন্নয়নের রহস্য উন্মোচনে বিশ্ব উন্মুখ, আরেকদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নেও অনেক দেশের আগ্রহ বেড়েছে। এ তালিকায় এখন যোগ হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার নাম। পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কোন্নয়নের সব সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কটা যেন তার কাক্সিক্ষত মাত্রায় পৌঁছাতে পারছিল না। এ নিয়ে দুই দেশেরই পারস্পরিক আগ্রহে বোধ হয় ঘাটতি ছিল। অথচ পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়াই স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি প্রদান করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ভূমিকা রাখার জন্য অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক ওডারল্যান্ডকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ওডারল্যান্ডই একমাত্র বিদেশি যিনি মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ভূমিকার জন্য বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছিলেন। তবে আশার কথা হলো, গত কয়েক বছরে এ সম্পর্কের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে অস্ট্রেলিয়ান সরকারসহ নীতিনির্ধারকদের ধারণা অনেক বদলে গেছে। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে এখন নিয়মিত যোগাযোগ হয়। ৩১ অক্টোবর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে শুরু হওয়া জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬-এ অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সাক্ষাৎটা অস্ট্রেলিয়ার অনুরোধের ভিত্তিতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আগে যেখানে অস্ট্রেলিয়ার ডিপার্টমেন্ট অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স ও ট্রেডের (ডিফাট) বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মানবিক সহায়তা প্রদানের ব্যাপারটাই মূলত উল্লেখ থাকত, সেখানে ২০২০-২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম ‘কি-পার্টনার কান্ট্রি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একই প্রতিবেদনে শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান, নেপাল ও পাকিস্তান সম্পর্কে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষ থেকে মানবাধিকার ও মানবিক সহায়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে বিনিয়োগে অস্ট্রেলিয়ার আগ্রহ বেড়েছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বর্তমানে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও হচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় এ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া গত বছর সেপ্টেম্বরে ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক অ্যারেঞ্জমেন্ট (টিফা)’ শীর্ষক একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ভবিষ্যতের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশকে শুল্ক ও কোটা মুক্ত সুবিধা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রেও দুই দেশের সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধিত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল সিকিউরিটি কলেজ, অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউট, লোয়ি ইনস্টিটিউটের মতো বিখ্যাত নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠানগুলোও আজকাল বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা খাতে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক নিয়ে কথা বলছে। এদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে নিয়ে সম্প্রতি একাধিক নিবন্ধ লেখা হয়েছে। ঢাকার অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনে ডিফেন্স অ্যাটাশের অফিস খোলার ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ান সরকার বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুমতি চেয়েছে। এর থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশ সম্পর্কে অস্ট্রেলিয়ান নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বদলেছে। এ ছাড়া শিক্ষা খাত, ভিসা সহজীকরণ, বাংলাদেশ থেকে দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক আমদানিসহ বহুমুখী খাতে দুই দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা চলছে। সিডনি-ঢাকা সরাসরি বিমান যোগাযোগের ব্যাপারেও আমাদের হাইকমিশনের পক্ষ থেকে জোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ সবকিছুই বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কের উন্নতিই নির্দেশ করে। দুই দেশের সামগ্রিক সম্পর্ক উন্নয়নের মূলে রয়েছে দুই দেশেরই সরকারি পর্যায়ে এ ব্যাপারে আগ্রহ। বিশেষ করে ২০১৮ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অস্ট্রেলিয়া সফরের পর থেকে দ্বিপক্ষীয় এ সম্পর্ক বিনির্মাণের প্রচেষ্টাগুলো অধিক গতি পায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুুল মোমেনও অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েই দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আর এ সম্পর্কোন্নয়নে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত আমাদের হাইকমিশনের কর্মকর্তারাও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ক্ষেত্রে সাবেক হাইকমিশনার কাজী ইমতিয়াজ হোসেন ও বর্তমান হাইকমিশনার মো. সুফিউর রহমানের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। আমাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল ক্যানবেরায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের একটি নিজস্ব ভবন হবে। আমাদের সে আশাও আজ পূর্ণ হওয়ার একেবারে দ্বারপ্রান্তে, আশা করি অচিরেই এ ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হবে। সিডনিবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি সিডনিতে হাইকমিশনের একটি অফিস খোলা হয়েছে। সিডনির কনস্যুলেটের অবস্থান ও কার্যক্রম ইতোমধ্যে কমিউনিটির প্রশংসা অর্জন করেছে। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য শহরেও নিয়মিত কনস্যুলার ক্যাম্প আয়োজন করা হচ্ছে, যার ফলে বাঙালি কমিউনিটি উপকৃত হচ্ছে।

২৬ জানুয়ারি ছিল অস্ট্রেলিয়া দিবস। আর্থার ফিলিপের নেতৃত্বে ১৭৮৮ সালের ২৬ জানুয়ারি সিডনির জলসীমায় ব্রিটিশ পতাকাবাহী যে প্রথম নৌবহরটি এসেছিল, সেটিই অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটিশ উপনিবেশের সূচনা করেছিল। এ দিনটিকেই বর্তমানে সরকারিভাবে অস্ট্রেলিয়া দিবস উপলক্ষে পালন করা হয়। যদিও আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানসহ অনেকেই এ দিনটিকে অস্ট্রেলিয়া দিবসের পরিবর্তে ‘ইনভেশন ডে’ বা দখলদারির দিন হিসেবে মনে করে। আপাতত এ বিতর্কে না গিয়েও প্রশান্তপাড়ের দেশ অস্ট্রেলিয়া থেকে সবাইকে এ বিশেষ দিনে আন্তরিক শুভেচ্ছা। বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কের পাঁচ দশক পূর্তিতে আমরা আশা করব আগামীতে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ ও কূটনৈতিক সম্পর্কের আরও উন্নতি হবে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়ার সক্রিয় অংশীদার হিসেবেও বাংলাদেশের সম্মান উজ্জ্বলতর হবে। চিয়ার্স মেটস।

লেখক :  অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কবি ও চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর