ছাদকৃষি বা নগরকৃষি যা-ই বলি না কেন এর মাধ্যমে আমাদের ঢাকা শহর কিছুটা সবুজ হচ্ছে। আগে যে দালান-গুলোর ছাদ ছিল খাঁখাঁ। সেসব ছাদের অনেকটি ভরে উঠছে সবুজে। দেখতে ভালো লাগে। শুধু যে শহর সবুজ হচ্ছে তা নয়, নিরাপদ খাদ্যের প্রশ্নে অনেকেই ছাদকৃষিতে ভরসা করছেন। ইতোমধ্যে অনেকে ছাদকৃষির মাধ্যমে সফল হয়েছেন। আমি দেখেছি ছাদে লাউ, ঝিঙা, শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, বিভিন্ন সবজি, আম, পেয়ারা, মাল্টা, আখ, ডালিম, জাম্বুরা, কামরাঙা, জামরুলসহ নানা ফলের চাষ করে পারিবারিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। মনে পড়ে গত শতাব্দীর সেই আশির দশকের মাঝামাঝি ছাদে কাজী পেয়ারা ফলানোর ক্যাম্পেইন হিসেবে ছাদকৃষি অনুশীলন তুলে ধরেছিলাম টেলিভিশনে। সেই শুরু। চ্যানেল আইয়ে আমি ২ শতাধিক ছাদকৃষি পর্ব প্রচার করেছি। দেখেছি অবসরে চলে যাওয়া সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী কিংবা ব্যবসায়ী-শিল্পপতি নিজেদের অবসর সময়টাকে ফলপ্রসূ করে তুলছেন ছাদে এক টুকরো কৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়ে। তাঁরা বলেছেন, ছাদকৃষি দিয়েছে আত্মিক প্রশান্তি। যাদের নিজস্ব ভবন ও ছাদ রয়েছে তারা ছাদে এক বা দুই স্তরবিশিষ্ট ছাদকৃষি গড়ে তুলছেন। আবার যাদের নিজস্ব বাড়ির ছাদ নেই, তারা বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলে ছাদের এক পাশে বা বারান্দায় গড়ে তুলেছেন কৃষি। এ ছাদকৃষি দিয়ে খাদ্যের চাহিদা পূরণ হচ্ছে, মিটছে পারিবারিক পুষ্টি, পাওয়া যাচ্ছে মানসিক প্রশান্তি। এর পাশাপাশি পালন করা যাচ্ছে একটা জাতীয় দায়িত্ব। শহরকে সবুজায়নে, নগরে অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা হচ্ছে। আশার কথা হচ্ছে, ছাদকৃষি নিয়ে আমার উদ্যোগটি ছড়িয়ে পড়েছে অনেকখানি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ছাদকৃষি’ নামে আমার একটা গ্রুপ আছে। সেখানে ৩ লাখের মতো মানুষ যুক্ত আছে। তারা তাদের ছাদে উৎপাদিত ফলফসলের ছবি দেন। পরস্পরের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। বীজ বা চারা আদান-প্রদান করেন। ফলে ফসলে পোকামাকড়ের আক্রমণ হলে কী করতে হবে, রোগব্যাধির প্রতিকার কী- সব তথ্য ও অভিজ্ঞতা তারা একে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করেন। আবার অনেকেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের ছাদকৃষি উদ্যোগের ছবি বা ভিডিও পাঠান। এমন অনেকের একজন মশিউর রহমান। তিনি টঙ্গীর একটি কারখানায় চাকরি করেন। আমাকে তাদের কারখানার ছাদে গড়ে তোলা কৃষির কয়েকটি ছবি পাঠিয়ে লিখলেন, আমি কখনো তাদের ছাদকৃষিটা তুলে ধরলে তারা অনুপ্রাণিত হবেন। ব্যক্তিগতভাবে আমিও কারখানা বা প্রতিষ্ঠানের ছাদে গড়ে ওঠা কৃষি তুলে ধরতে চাই। যাতে অন্য কারখানা বা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিশাল ছাদটিকে ফেলে না রেখে তাতে সবুজের চাষ করে। কেননা বেশির ভাগ কারখানা যে জমিতে গড়ে উঠেছে আগে হয়তো সেখানে কৃষিই ফলত। নয় তো ছিল সবুজ গাছপালা আচ্ছাদিত কোনো জায়গা। তো একদিন সকালে রওনা হলাম টঙ্গীর সেই কারখানার উদ্দেশে। কারখানার নাম এক্সক্লুসিভ ক্যান লিমিটেড।
পরিবেশসচেতন এই সময়ে শিল্পায়নের পূর্বশর্ত হয়ে উঠেছে অনুকূল পরিবেশ। পৃথিবীব্যাপীই শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাস্থ্যকর ও সবুজ পরিবেশে গড়া তোলা হচ্ছে। আমাদের দেশেও যারা শুধু শিল্পোৎপাদনের ভাবনা মাথায় রেখে বড় বড় ভবন গড়ছেন তাদের কেউ কেউ এখন আন্তর্জাতিক মানদন্ড বজায় রাখতে গিয়ে সবুজের অনুশীলন করছেন।
কারখানাটির সীমানায় ঢুকে মন ভরে যায়। এমন সাজানো গোছানো সবুজে ঢাকা কারখানা খুব কম দেখেছি। আমার আগমনের খবর শুনে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসির কারখানার গেটে এসে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। করোনার এই সময়ে স্বভাবতই আমাদের মুখে নিরাপত্তা মাস্ক। হাত মেলানোর পরিবর্তে কনুই স্পর্শ। সৈয়দ নাসির তাঁর কারখানা ঘুরে দেখাচ্ছিলেন। মুখে মাস্ক তাই চেহারার আদল ঠিক বোঝা যায় না। কিন্তু কণ্ঠটা পরিচিত মনে হয়। আমি বলি, আপনার কণ্ঠ শুনে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের কথা মনে পড়ে গেল। কোথায় যেন মিল রয়েছে। আমার কথায় থমকে দাঁড়ালেন সৈয়দ নাসির। মাস্ক খুলে বললেন, আমি তাঁর ছোট ভাই। ব্যাপারটায় বেশ মজা পেলাম সবাই।
যা হোক, শ্রমঘন তাঁর শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি সত্যিই ব্যতিক্রম। কারখানার দৃষ্টিনন্দন ভবনটি গড়ে তোলা হয়েছে সবুজায়নের কথা মাথায় রেখে। বলা যেতে পারে চারদিকে সবুজে বেষ্টিত একটি শিল্পকারখানা। ভবনটির নির্মাণশৈলী অসাধারণ। এর চারদিকে হেঁটে চলাচল করলে মনে হয় কোনো অরণ্যের ভিতর দিয়ে হাঁটছি।
সৈয়দ নাসির। উদ্যমী এক স্বপ্নচারী মানুষ। খাদ্যসহ বিভিন্ন ব্যবহারিক পণ্যের ক্যান তৈরির এই আধুনিক প্রতিষ্ঠানটি গড়েছেন দ্ইু দশক আগে। টানা বাণিজ্যিক সাফল্য ধরে রেখে বছর তিনেক আগে গড়েছেন এই আধুনিক ভবন। শিল্প পরিচালনায় নানামুখী সাফল্য রয়েছে তাঁর। রয়েছে সৃজনশীল স্বপ্ন। তাই এ শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি গড়ার সময়ই ভেবেছেন আন্তর্জাতিক মানদন্ড অর্জনের কথা। বিশেষ করে পরিবেশসম্মত শিল্পের সবচেয়ে বড় সনদ লিড (Leadership on Energy and Environmental Design)-এর স্বর্ণপদকের সব কটি শর্ত পূরণ করে এখন প্লাটিনাম অর্জনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। শক্তি ও পানি সাশ্রয়, টেকসই সবুজ ও ভিতরে বাইরে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে এগিয়ে চলেছে এ প্রতিষ্ঠান। সৈয়দ নাসির বলছিলেন, তাঁর এ সবুজ কারখানা গড়ার পেছনে অনুপ্রেরণায় রয়েছে ছাদকৃষি অনুষ্ঠান। গর্বে বুক ভরে গেল শুনে। এভাবেই একটু একটু করে সবুজ যেন ছড়িয়ে পড়ছে শহরে নগরে কলকারখানার ছাদে।
হাজারখানেক শ্রমিকের রুটিরুজির এ কারখানাটি যেমন যথেষ্ট আলো-বাতাসে পূর্ণ, তেমনি তৃণমূল শ্রমজীবীদের সবাই উপলব্ধি করতে পারছেন তাদের কর্মপরিবেশটি স্বাস্থ্যকর। বেশ কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম। এ পরিবেশে কাজ করে তাঁরা যেমন ভালো বোধ করেন, তেমনি নিজেদের কর্মস্থলটিকেও নিরাপদ ভাবতে পারেন।
কারখানার ভবনের সবচেয়ে উদ্ভাবনী ও উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে ছাদকৃষি। উদ্যোগটি বেশ ব্যতিক্রমধর্মী। একদিকে ভবনটির ছাদের চারপাশে সবজি ও লতানো ফসল রোপণ করা হয়েছে। অন্যদিকে কৃষি আয়োজনটি করা হয়েছে পৃথক একেকটি কক্ষের সমান উঁচু বেড তৈরি করে। দৃশ্যত মনে হতে পারে, ছাদের চারপাশের কক্ষের ছাদগুলোয় কৃষি আয়োজন। আসলে ওই ছাদগুলোয় বেশ পুরু মাটির স্তর সৃষ্টি করে সেখানে বিভিন্ন গাছ রোপণ করো হয়েছে। এমন উদ্যোগ আমি দেখেছি মাস্কো গ্রুপের কারখানাগুলোর বিশাল ছাদগুলোয়। মাস্কো গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুস সবুর সাহেব অত্যন্ত রুচিবান একজন মানুষ। তাঁর কারখানার বিশাল ছাদগুলোয় গড়ে তুলেছেন দৃষ্টিনন্দিত ল্যান্ডস্কেপ। ছাদে দাঁড়ালে মনেই হয় না ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। মনে হয় কোনো উদ্যানে বা পার্কে আছি। এমন সাজানো গোছানো আর পরিকল্পিত।
সৈয়দ নাসির বলছিলেন, ভবন তৈরির সময়ই ছাদকৃষিকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ছাদের মাঝের অংশটি খালি রাখা হয়েছে শ্রমিকদের চিত্তবিনোদন বা মুক্ত আকাশের নিচে দাঁড়ানোর সুবিধা হিসেবে। তার পরও অনেক উদ্যোগ এখনো এই শিল্পোদ্যোক্তার মাথায় রয়েছে যেগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করছেন তিনি।
বিশাল ছাদটিতে মোট আটটি কৃষি প্লট। প্লটে পা রাখলে মনে হয় মাটিতেই আছি। আম, লেবুসহ বিভিন্ন গাছে ফল ধরে আছে। বোঝা যায়, আগামীতে ছাদের চারদিকের কৃষি প্লটগুলো যেমন ফলফসলে পূর্ণ হয়ে উঠবে, তেমনি হয়ে উঠবে অসাধারণ সৌন্দর্যের এক ক্ষেত্র।
যারা ছাদকৃষি অনুষ্ঠানটি নিয়মিত দেখেন, তাদের মনে থাকতে পারে ২০১৮ সালের আগস্টে গাজীপুরের হোতাপাড়ায় এনার্জিপ্যাক লিমিটেডের শিল্পোৎপাদন ইউনিটের ছাদের একটি কৃষি আয়োজন দেখিয়েছিলাম। সে সময় পর্যন্ত একটি তথ্য আমাদের হাতে ছিল। দেশে আনুমানিক ছোট-বড় ১০ হাজার শিল্পকারখানা আছে। এসব শিল্পকারখানার ছাদ ৫ হাজার থেকে শুরু করে লক্ষাধিক বা কয়েক লাখ বর্গফুট পর্যন্ত, যা খালি পড়ে আছে। সব মিলিয়ে যে আয়তন দাঁড়াবে তা বিশাল বিস্তীর্ণ আবাদি এলাকার সমান। এ জায়গাগুলোয় অনায়াসে কৃষি হতে পারে। হতে পারে শান্তস্নিগ্ধ সবুজের আয়োজন। পরিবেশসম্মত শিল্পোৎপাদনের ধারণা থেকেও করা যেতে পারে কৃষিকাজ। শিল্পের সঙ্গে সৃজনশীল কৃষি উদ্যোগের নজির এরই মধ্যে দেশে গড়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে আমি অবশ্যই বলব, টঙ্গীতে মাস্কো পিকাসো লিমিটেডের ছাদের অনিন্দ্যসুন্দর সবুজের আয়োজনের কথা।
সৈয়দ নাসিরও বলছিলেন অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের শিল্পকারখানার খালি ছাদগুলোর ওপর ছাদকৃষি আয়োজন হতে পারে। শিল্পোৎপাদন একটি বাণিজ্যিক কর্মপ্রয়াস। এর সঙ্গে আর্থিক হিসাবটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শিল্পের সঙ্গে মানবিক ও প্রকৃতি প্রেমের নজির যদি না থাকে তাহলে সে শিল্প সার্থক হতে পারে না। ঠিক এ কারণেই পরিবেশসম্মত শিল্পোৎপাদনের সঙ্গে কর্মীদের অনুকূল কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করাটা অপরিহার্য। একই সঙ্গে শিল্পের কারণে কোনোভাবেই যেন পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখাটাও অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে সৈয়দ নাসিরের এক্সক্লুসিভ ক্যান লিমিটেডের সবুজায়ন ও কৃষি উদ্যোগ অনুকরণীয় এক উদ্যোগ। আমাদের দেশের প্রতিটি শিল্পকারখানা হয়ে উঠুক সবুজ ও নিরাপদ।
লেখক : কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।