বৃহস্পতিবার, ১৪ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

সামাজিক অবক্ষয় : চাই নৈতিক শিক্ষা

ড. দিলীপ কুমার সাহা

সামাজিক অবক্ষয় : চাই নৈতিক শিক্ষা

শিক্ষকদের বলা হয় জাতি গঠনের মূল কারিগর। শিক্ষকই পারেন তাঁর ছাত্রছাত্রীকে জ্ঞান ও ন্যায়ের দীক্ষার মাধ্যমে স্বীয় জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা দ্বারা যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীর মানবতাবোধ জাগিয়ে তুলে পাঠদানকে সার্থক করার পাশাপাশি দেশের টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে। ফলে এসব শিক্ষার্থীই হয়ে ওঠে পরিবার, সমাজ সর্বোপরি দেশের অহংকার ও গর্বের মূর্তপ্রতীক।

আমি আজ প্রায় ১৫ বছর ধরে শিক্ষকতার মহান পেশার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নই। তবে আমার ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে এখনো যে সম্মান পাই তা আমাকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আন্তরিকতার বন্ধনে আপ্লুত ও আবেগতাড়িত করে- শিক্ষকতার সুখের স্মৃতি এখনো মন্থন করে। এই তো কিছুদিন আগে আমি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে যোগদানের জন্য সম্মেলনস্থলে যেতেই মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের আমার এক প্রাক্তন ডাক্তার ছাত্র সেখানে উপস্থিত অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তির সামনে সস্ত্রীক এসে পা ছুঁয়ে সালাম করল এবং মহান শিক্ষকতা পেশার জয়গান করল অহর্নিশ। বিশ্বাস করি, সব শ্রদ্ধেয় শিক্ষকই ছাত্রদের বিনম্র শ্রদ্ধায় এ অকৃত্রিম পরশ হয়তো হামেশাই পান। যা সমাজে শিক্ষকদের প্রতি এখনো শিক্ষার্থীদের বিশুদ্ধ শ্রদ্ধাবোধের পরিচয় দেয়। তবে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু নেতিবাচক উদাহরণ ছাত্রছাত্রী সম্পর্কে সাধারণ ধারণা কিছুটা হলেও হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। শিক্ষকের গায়ে মল ঢালা, দাওয়াত না পাওয়ায় শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে লাথি মারা, হাতে ইট রেখে দাঁড়িয়ে রাখা, অনৈতিক দাবি মেনে না নেওয়ায় শিক্ষকদের আটকে রাখা, প্রভাবশালীদের ইন্ধনে শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের গলায় জুতার মালা দেওয়া, শিক্ষককে কোলে করে পানিতে চোবানো, কলেজ ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে উচ্চৈঃশব্দে বেপরোয়াভাবে হর্ন বাজিয়ে মোটরবাইক চালাতে নিষেধ করায় অধ্যক্ষকে এলোপাতাড়ি আঘাত করা; তদুপরি সামাজিক অবক্ষয়ের চরম সীমানায় পৌঁছে বিবেককে নিথর করে শুধু হিরোইজম দেখানোর জন্যই শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করতেও দ্বিধা করেনি জিতুর মতো সমাজের ছাত্র নামধারী কিছু কুলাঙ্গার। এসব নেতিবাচক উদাহরণ সামাজিক অবক্ষয়ের খন্ডচিত্র। সামাজিক অবক্ষয়ের ঢেউ আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যেও সাইক্লোনের মতো আঘাত করে তাদের বিবেককে তছনছ করে ফেলছে। তবে আমি এখনো বিশ্বাস করি, নেতিবাচক এ উদাহরণগুলো ছাত্র নামধারী মানসিক বিকারগ্রস্ত গুটিকয় শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে যা মোটেও সার্বিক শিক্ষার্থীসমাজের চিত্র নয়। একটা কথা সত্য, কিশোর শিক্ষার্থীর ধর্মই হলো তার বীরত্ব (হিরোইজম) প্রকাশ করা। তাদের মধ্যে বীরত্ব দেখানোর একটি দুর্নিবার প্রবণতা সব সময়ই বিদ্যমান। খেলাধুলার মাঠের সংকোচন, এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাকটিভিটিজ যেমন নাটক, গান, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক চর্চা, নিজেদের বীরত্ব তুলে ধরার অপ্রতুল সুযোগ তদুপরি ভার্চুয়াল জগতে অতিরিক্ত আসক্তি শিক্ষার্থীসহ তরুণ-যুবকদের সামাজিক অবক্ষয়ের প্রধান কারণ। ফলে কিশোররা বীরত্ব প্রকাশের জন্য সংঘবদ্ধ গ্যাং সৃষ্টি করছে, যাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলো কিছুসংখ্যক নীতিবিবর্জিত রাজনীতিক ও সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। ছাত্র নামধারী কিছু শিক্ষার্থী এদের লেজুড়বৃত্তি করছে যারা সংখ্যায় কম হলেও তাৎক্ষণিক বিভিন্ন ধরনের প্রাপ্তির আশায় অনৈতিক সামাজিক অবক্ষয়ের নেতিবাচক দৃঢ় সুতায় একত্রিত। নেতিবাচক উদাহরণের সঙ্গে যুক্ত মুষ্টিমেয় কিছু বিপথগামী শিক্ষার্থী অথচ কালিমা লেপন করছে সব শিক্ষার্থীকে।

সমাজের এ অবক্ষয়ের জন্য আমরা অভিভাবকরাও একেবারে দায়মুক্ত নই; কারণ আমাদের সন্তানদের শুধু ক্লাসে মেধা তালিকায় থাকতে হবে, জিপিএ-৫ পেতে হবে এ প্রতিযোগিতার মধ্যেই নির্দিষ্ট করে রেখেছি বরং পড়াশোনার পাশাপাশি নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়া অভিভাবক হিসেবে আমাদের প্রাথমিক দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনে আমাদের ব্যর্থতার ফসলই শিক্ষার্থীদের এ ধরনের নৈতিকতাবিবর্জিত আচরণ। এ প্রসঙ্গে একটা বাস্তব উদাহরণ মনে পড়ছে। কয়েকদিন আগে কিন্ডারগার্টেনের এক ছাত্রের মা প্রশ্ন হাতে রাস্তায় চলমান রিকশার মধ্যেই বাচ্চাটাকে প্রথমে অঙ্কগুলো কেন ভুল করলে জিজ্ঞাসা করতেই বেদম প্রহার শুরু করলেন সঙ্গে অনেক অপ্রাসঙ্গিক অশ্রাব্য ভাষা। দেখে মনে হলো সব সন্তানকেই মেধাবী হতে হবে ক্লাসে রোল ১, ২ বা ৩ হতে হবে কিংবা জিপিএ-৫ পেতে হবে। মানবীয় গুণসম্পন্ন ও বিশেষ কারিকুলামের অ্যাকটিভিটিজ দ্বারা সামাজিক মূল্যবোধ অর্জনের মাধ্যমেও সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করা সম্ভব, যা বেশির ভাগ অভিভাবকই মনে পোষণ করেন কি না সন্দেহ। সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ সবাইকেই শুধু পুঁথিগত বিদ্যার মাধ্যমে করতে হবে, তা নয়। তবে সমাজকে সার্বিক মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকে রক্ষার জন্য অভিভাবকদের উচিত সন্তানকে শুধু জিপিএ-৫-এর পাগলা ঘোড়ার পেছনে না ছুটে সুস্থ, সবল, নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানবিক মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেওয়া।

সামাজিক মূল্যবোধের নিয়ামক তথা সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, ধৈর্য, উদারতা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃজনশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ ও অন্য নৈতিক গুণাবলি লোপ পাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলে সামাজিক অবক্ষয়। তাই আগ্রাসী সামাজিক অবক্ষয় থেকে বাঁচতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি। সেই সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসনের যথাযথ অনুশীলন, পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করা; তবে শুরুটা হতে হবে পরিবার থেকেই। একটা কথা মনে রাখতে হবে, সামাজিক সমস্যা দূর করতে রাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে ঠিকই কিন্তু মূল দায়িত্ব পরিবারকেই নিতে হবে।

সন্তানকে সময় দিতে হবে, সঙ্গ নির্বাচনে ভুল করার ফলে আমাদের উঠতি বয়সী শিক্ষার্থীরা বিপথে যাচ্ছে। পরিবার তার দায়িত্ব পালনে হচ্ছে ব্যর্থ। এজন্য মা-বাবার উচিত সন্তান বড় হলে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আচরণ করা, বন্ধুর মতো তার মনের খোঁজখবর নেওয়া। এতে সন্তানের একাকিত্ব বা অসৎ সঙ্গ তাকে খারাপ পথে নিতে বাধাগ্রস্ত করবে। বন্ধুদের সম্পর্কে জানতে হবে। তাকে নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে। জিতুর বাসা কলেজ থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ, সেখানে তাকে ছাত্রজীবনেই নেতিবাচক হিরোইজম দেখানোর জন্য কিনে দেওয়া হয়েছে মোটরসাইকেল। জিতুর এ ধরনের সামাজিক অবক্ষয়কে প্রশ্রয় দিয়ে শিক্ষক উৎপল কুমার হত্যায় তার পরিবারের গাফিলতি স্পষ্ট হয়েছে; এর ওপর সন্তানের ওপর নীরব অমনোযোগিতাও স্পষ্ট হয়েছে। শিক্ষার্থীর এ নেতিবাচক হিরোইজমকে অভিভাবক যখন নিজেদের গর্ব হিসেবে মনে করেন তখন মনে করতে হবে এটা সামাজিক অবক্ষয়ের করুণ চিত্র। জিতুর ঘটনা তারই সাক্ষ্য দেয়। জিতু যেটা করেছে সেটা ছাত্রের হাতে শিক্ষক হত্যা নয়; বরং সমগ্র জাতিকে গলা টিপে হত্যা করার শামিল।

তবে এ কথা ঠিক, দেশে ভয়াবহ ব্যাধির মতো দানা বাঁধছে সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়। আর এজন্য দায়ী অল্প বয়সী শিক্ষার্থীসহ তরুণ-যুবকদের অর্থের প্রতি অতি লালসা, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সব মানুষের অসম প্রতিযোগিতা, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অপসংস্কৃতি, যথাযথ শিক্ষার অভাব, অপরাধের প্রশ্রয়, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্বল নৈতিক অবস্থান, ধর্মীয় জ্ঞানের অভাব, দাম্পত্য কলহ, বিষণœতা ও মাদকাসক্তি।

ভয়ংকর এ সামাজিক ব্যাধির প্রতিরোধে দরকার জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা ও তা নিরাময়ে কার্যকর ব্যবস্থা। এ বিষয়ে সমাজ সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। সেই সঙ্গে পরিবারকে তথাকথিত আধুনিকতার নামে সন্তানদের সুস্থ মানসিক বিকাশসম্পন্ন মানবীয় মানুষ হওয়ার দিকে নজর দিতে হবে। যা পরিপূর্ণভাবে পালন হচ্ছে না বলেই সমাজের এ অধঃপতন, এ অবক্ষয়। তবে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ আসনে বসা মানুষেরা যেন যুবসমাজে অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারেন, আদর্শ হতে পারেন এসব খেয়াল রেখে সব জায়গায় পরিকল্পিত কাক্সিক্ষত মানুষকে বাছাই করতে হবে।  ইতিবাচক দিক হলো, শুদ্ধাচার চর্চার মাধ্যমে সরকার ইতোমধ্যে শুরু করেছে; ফল পেতে হয়তো কিছু সময় লাগবে।  কর্মজীবন থেকে ব্যক্তিজীবনে সততা, নৈতিকতা, মানবিকতা, পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা করতে হবে।

                লেখক : প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক, বাংলাদেশ পুলিশ।

সর্বশেষ খবর