বৃহস্পতিবার, ১০ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

সুতোর ওপর হাঁটছি

তসলিমা নাসরিন

সুতোর ওপর হাঁটছি

আমাদের চারদিকে বিপদ। আমাদের পায়ে পায়ে মৃত্যু। রাস্তায় বেরোলে গাড়ি চাপা পড়তে পারি, ঝোপঝাড়ে গেলে সাপের কামড় খেতে পারি, নৌকো চড়লে ডুবে যেতে পারি, বাসে ট্রেনে বা উড়োজাহাজে কোথাও গেলে দুর্ঘটনায় পড়ে জীবন যেতে পারে। তারপরও আমরা জীবনযাপন করছি, রাস্তায় বেরোচ্ছি, যানবাহনে চড়ছি।  তাছাড়া প্রতিদিনই খাবার খাচ্ছি, পানীয় পান করছি, জেনেই করছি যে, আমরা যা খাচ্ছি, যা পান করছি, তার অনেক কিছুর মধ্যেই বিষ। আর্সেনিকযুক্ত পানি কি লোকে পান করছে না? জানার পরও যে পানিতে আর্সেনিক আছে? করছে। পান করার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হচ্ছে না বলে গা করছে না। অনেক বছর পর কুফল ভোগ করতে হবে, সে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার লোক বড় কম।

অনেকেই আমরা অল্প স্বল্প বিষ খেয়েও বেঁচে আছি। সর্ষের তেল খেলে ক্যান্সার হতে পারে, স্যাকারিন খেলে হতে পারে, নোনা মাছ খেলে হতে পারে, এরকম হাজারও খাদ্য, যা খেলে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাই বলে কি ওসব খাবার আমরা একেবারেই মুখে তুলি না? তুলি, কারণ ওই একই। রাস্তায় বেরোলে গাড়ি চাপা পড়ার আশঙ্কা আছে জেনেও আমরা রাস্তায় বেরোই, এবং এও জানি যে, সকলেই গাড়ি চাপা পড়ি না, কিছু লোক পড়ে। ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা আছে এমন খাবার খেলেও সকলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হই না, কিছু লোক হয়। সকলেই ভেবে নিই, আমরা হয়তো ওই কিছু লোকের তালিকায় পড়বো না। সুতোর ওপর হেঁটে যাওয়াই হয়তো জীবন। সুতো ছিঁড়ে গেল, বা হাঁটতে গিয়ে একটু হেলে পড়লাম, তাহলেই পৃথিবীর খেলাধুলো সব শেষ করে যে শূন্য থেকে এসেছিলাম, সেই শূন্যে ফেরত যাবো।

কী করলে, কী খেলে কী ভালো হয়, কী খারাপ হয়, তা নিয়ে বহুকাল গবেষণা চলছে। গবেষণার ফল গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে বলে ধীরে ধীরে আমাদের চক্ষু খুলছে। আমরা সচেতন হচ্ছি। গবেষকরা প্রতিনিয়ত গবেষণা করছেন, গবেষকদের কাজই গবেষণা করা। কেউ মহাকাশ নিয়ে করেন, কেউ ব্যাঙের ছাতা নিয়ে করেন। মহাকাশের গবেষকদের কল্যাণেই আমরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে জেনেছি। ব্যাঙের ছাতার গবেষকদের কাছে জেনেছি কিছু ব্যাঙের ছাতা শরীরের জন্য ভালো, কিছু ব্যাঙের ছাতা আবার খুবই বিষাক্ত। বিষাক্ত ব্যাঙের ছাতা থেকে আমরা দূরে থাকি। সবজি নিয়ে তো হামেশাই গবেষণা চলছে, স্টার্চি সবজির চেয়ে স্টার্চি নয় এমন সবজি ভালো। আলু, মিষ্টি কুমড়ো, ভুট্টা বা মটরশুটির চেয়ে সবুজ শাকপাতা, সালাদ-পাতা ভালো। তাছাড়াও গরু বা খাসির মাংসের চেয়ে মুরগির মাংস ভালো। যে কোনও মাছের চেয়ে ওমেগা থ্রি আছে এমন মাছ ভালো। ডিমের হলুদ অংশের চেয়ে ডিমের সাদা অংশ ভালো। সাদা ভাতের চেয়ে বাদামি ভাত ভালো।

তারপরও কথা আছে। মেপে কার্ব, মেপে প্রোটিন খেয়ে, শাক-সবজি ফলমূল খেয়ে, নিয়মিত ব্যায়াম করে, স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করেও কেউ কেউ হুট করে মরে যায়। কেউ আবার অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করেও দীর্ঘকাল বেঁচে থাকে। ভালো জিনের কারণেই অনেকের ভাগ্য এমন সুপ্রসন্ন। মানুষের বেশির ভাগ অসুখ-বিসুখ জিনেই থাকে, জিনকে অস্বীকার করার স্পর্ধা কারও নেই।

আজকাল ডাক্তাররা রোগীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার পরিবারে কার কী অসুখ ছিল, কে কবে গত হয়েছেন?’ পরিবারে ক্যান্সার রোগ থাকলে রোগীর ক্যান্সার রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি, পরিবারে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার ঘটনা থাকলে রোগীর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। জিনে রোগ থাকলেও আমরা ডাক্তারের পরামর্শে জীবনযাপন করে দুর্ঘটনা এড়াতে চেষ্টা করি। এককালে মানুষের গড়আয়ু কম ছিল, এখন বেশি। এর কারণ আমাদের সচেতনতা। সচেতনতা বাড়ছে গবেষণা বাড়ছে বলে। এককালে সিগারেট খাওয়াটা স্মার্টনেসের অংশ ছিল, এখন দিন দিন মানুষ সিগারেট ছাড়ছে। এর কারণ গবেষণায় পাওয়া গেছে সিগারেট খেলে ফুসফুসে ক্যান্সার হয়। এককালে মানুষ জানতোই না বায়ুদূষণের কারণে কী ক্ষতি হয় মানুষের, এখন জানে দূষিত বায়ুতে দীর্ঘকাল বাস করলে ফুসফুসে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই বায়ুদূষণ দূর করতে সরকারকে তাগাদা দিই, ঘরে এয়ার পিউরিফায়ার রাখি, ঘরের বাইরে মাস্ক ব্যবহার করি।

কী খেলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, তা জেনেও মানুষ তা খায়। সকলে সচেতন হতে চায় না। মদ সিগারেট ক্ষতিকর জানার পরও সেসবের দিকে হাত বাড়ায়। মাদকদ্রব্য সর্বনাশ করবে জেনেও মাদক সেবন করে। সকলেরই দীর্ঘজীবী হওয়ার ইচ্ছে নেই। জীবনকে যেমন ইচ্ছে তেমনভাবে যাপন করে অকালে মরে যাওয়ার ইচ্ছে তো কারো কারো আছেই।

বড় স্বল্প, বড় অল্প, বড় চোখের-পলকে-চলে-যাওয়া জীবন আমাদের। এই জীবনকে দীর্ঘ করতে তারপরও আমরা অনেকেই যে যার মতো করে চেষ্টা করি। সব সময় সফল হই না। সুতো থেকে পা পিছলে পড়ে যাই। কিন্তু পা পিছলে যাবে বলে আমরা হাল ছেড়ে দিই না। বুদ্ধি কিছুটা থাকলেই মানুষ বুঝতে পারে যে জীবন একবারই আসে, যে জীবন যায়, সে জীবন চিরদিনের জন্যই যায়।

সেদিন একাত্তর টিভিতে এক কৃষি-গবেষককে ডেকে এনে যেভাবে যাচ্ছেতাইভাবে অপদস্থ করা হলো, তা দেখে এ কথাগুলো লিখছি। গবেষক তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন কোনো এক অঞ্চলের বেগুনে ক্যান্সার হতে পারে এমন কিছু উপাদান পাওয়া গেছে, এটি শুনে উপস্থাপিকা এবং আলোচকবৃন্দ এমন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন যে, গবেষককে অত্যন্ত অভদ্র, অশোভন, অশ্লীল ভাষায় অপমান করলেন। তারা মনে করেছেন, গবেষক বেগুনের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছেন, এ সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়, মনে করেছেন এই কুৎসা বা ষড়যন্ত্রের ফলে সরকার অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়বেন, তাছাড়া বেগুন-চাষির ক্ষতি হবে, বেগুন যারা কেনাবেচা করে, তাদের ক্ষতি হবে। এই ক্ষতি তারা কিছুতেই হতে দেবেন না, সে কারণে গবেষণার ফল নিয়ে তারা তামাশা করলেন; হাস্যকর, বিরক্তিকর, অশালীন, অশ্লীল, উদ্ভট মন্তব্য করলেন, এবং ভাবলেন জনগণের বিরাট স্বার্থ দেখলেন তারা। আসলে যে এসব গবেষণাই জনগণের স্বার্থে করা, তা বুঝতে চাইলেন না একজনও। নিতান্তই মূর্খতার পরিচয় দিলেন।

বাংলাদেশ বলেই সম্ভব শুধু সরকারের চাটুকারিতায় পারদর্শিতার গুণে নানা প্রতিষ্ঠানের উচ্চস্থানে বসার সুযোগ পাওয়া। বিজ্ঞান সম্পর্কে, বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্পর্কে, গবেষণাপত্র প্রকাশ সম্পর্কে যাদের ন্যূনতম জ্ঞান নেই, তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে গবেষকের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে! একাত্তর টিভির উচিত ছিল গবেষকের নতুন গবেষণা নিয়ে আলোচনা করার জন্য গবেষণা সম্পর্কে সম্যক ধারণা আছে এমন একজন বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞানমনস্ক কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি বা বোধবুদ্ধি আছে এমন কাউকে নির্বাচন করা।

নারীরা যখন নিজেদের বুদ্ধিহীনতা জনসমক্ষে প্রকাশ করেন, আমার কষ্ট হয়। সম্ভবত আমি নারী বলেই নারীদের বুদ্ধিদীপ্ত দেখতে পছন্দ করি। দুর্ভাগ্যক্রমে আলোচনা অনুষ্ঠানের গবেষককে যাঁরা হেয় করেছেন, তারা সকলেই নারী।

আজকাল টেলিভিশনগুলোয় এমন হয়েছে যে, ঘটে দুই ছটাক বুদ্ধি নেই, এমন মেয়েদেরও টিভি-ক্যামেরার সামনে কিছু বুলি শিখিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয় যাঁদের সম্বল বলতে সুন্দর নাক চোখ মুখ, সুন্দর দেহসৌষ্ঠব, সুন্দর পোশাক আশাক। তাঁরাই খবর পড়েন, তাঁরাই রাজনীতিকের সঙ্গে আলোচনায় বসেন, তাঁরাই বিজ্ঞানীকে প্রশ্ন করেন, অর্থনীতি বিষয়ে জ্ঞানদান করেন, শিল্প সাহিত্য এবং বিজ্ঞান নিয়ে বক্তৃতা করেন। জনগণ এঁদের দেখছে প্রতিদিন, এঁরাই হয়ে উঠছেন চেনা মুখ, এঁরাই হয়ে উঠছেন বরেণ্য বুদ্ধিজীবী।

দেশ যখন রসাতলে যায়, এভাবেই যায়।

পুরুষের অজ্ঞতা, মূর্খতা, হিংস্রতা দেখলে যেমন বলি, পুরুষের উদারতা, স্বার্থহীনতা, বুদ্ধিমত্তা দেখলেও বলি। মেয়েদের মধ্যে উদার নিঃস্বার্থ বুদ্ধিমতী যেমন আছে, মূর্খ হিংস্র মেয়েও তেমন আছে। কোদালকে কোদাল বলতেই পছন্দ করি, সে কারণেই গবেষককে হেনস্থা করেছেন যে মহিলারা তাঁদের মূর্খ বলেছি। অবশ্য একজন মানুষ সব ক্ষেত্রে মূর্খ হয় না, কিছু ক্ষেত্রে তারা মূর্খ, কিছু ক্ষেত্রে একেবারেই মূর্খ নয়, বরং অতি বুদ্ধিমান। আমার তো কিছু ক্ষেত্রে মাথা কাজ করে, কিছু ক্ষেত্রে একেবারেই করে না। যে ক্ষেত্রে করে না, সে ক্ষেত্রে আমি নিজেকে বিজ্ঞ হিসেবে জাহির করতে যাই না। কখনো আমি স্পেসশিপ কী করে বানানো হয় তা নিয়ে কোথাও লেকচার দেব না। কেউ অনুরোধ করলে নিজের অপারগতার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেব। ক্ষুদ্র স্বার্থে গবেষকদের যে যত হেনস্থাই করুক, তাঁদের কিন্তু নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে। তাঁদের জন্যই এক ফসলের জায়গায় আমরা তিন ফসলের সুবিধে পাচ্ছি। তাঁদের জন্যই কীটনাশকের অপকারিতার কথা জেনেছি, এবং ক্ষতিকর কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধ করেছি। তাঁদের কল্যাণেই আমরা পুষ্টিকর খাদ্য খেতে পারছি। খাদ্যের স্বল্পতাও আগের চেয়ে অনেক দূর হয়েছে।  সুতোর ওপর হাঁটছি আমরা, পায়ে পায়ে মৃত্যু আমাদের। এই সময় আমাদের সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘায়ুর জন্য বিজ্ঞানীদের অবদান অপরিসীম। তাঁদের যদি আমরা শ্রদ্ধা না করি, আমরা নিজেদেরই শ্রদ্ধা করি না।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর