বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

দিন ফুরায়ে যায় রে আমার

মাকিদ হায়দার

দিন ফুরায়ে যায় রে আমার

দিন ফুরায়ে যায় রে আমার, দিন ফুরায়ে যায়। স্বভাবকবি গোবিন্দ চন্দ্র দাশের দিন ফুরায়ে যায়, কবিতাটি আমাদের স্কুলজীবনে পাঠ্য করেছিল পূর্ব পাকিস্তান স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড। দিন ক্রমান্বয়ে ফুরিয়ে আসছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি বিদেশে পড়াশোনা করতে গিয়ে একবারও মনে হয়নি দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে। বিসিকের চাকরির সুবাদে প্রথমবার ১৯৮৯ সালে তৎকালীন চেয়ারম্যান সিএসপি মোহাম্মদ সিরাজুউদ্দিন ফিলিপাইন্সের ম্যানিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেদারল্যান্ডস সরকারের বৃত্তির অধীনে আমাকে দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রশিক্ষণের জন্য পাঠালেও তৎকালীন স্বৈরশাসনের কড়া নিষেধ ছিল, স্কলারশিপে কেউ দেশের বাইরে যেতে পারবে না। বিসিক চেয়ারম্যান বিষয়টি অবগত হওয়ার পর দীর্ঘ একটি চিঠি ইংরেজিতে লিখে পাঠিয়েছিলেন একজন ব্রিগেডিয়ারের কাছে। তিনি সচিবালয়ে বসতেন। মনে আছে, সম্ভবত তার বাড়ি ছিল ময়মনসিংহ অথবা জামালপুরে। যত দূর মনে পড়ে, ব্রিগেডিয়ার সাহেবের নাম ছিল ইউসুফ হায়দার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে শুরু হয়েছিল স্বৈরশাসন। স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের আমলে নিরপরাধ অনেক আর্মি অফিসারসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করলেও, জিয়াউর রহমানের কঠিন হৃদয়ে দয়ামায়া বলতে কিছুই ছিল না। সরকারি হিসাব অনুসারে ১৯৭৬ থেকে ১৯৮১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত হাজার হাজার লোকের প্রাণ সংহার করেছিল জিয়া সরকার। তার ভিতরে মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ ও জাসদের নেতা-কর্মী এবং কর্নেল তাহেরসহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর অন্তত দেড় হাজার সেনা ও অফিসার ছিলেন। ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হয়নি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শাহ আজিজসহ পাকিস্তানপন্থিদের। মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামীর কাউকে। বরং বিদেশ থেকে জামায়াতের আমির গোলাম আযম বাংলাদেশে এসেছিলেন তার অসুস্থ মাকে দেখতে। মনে পড়ে ১৯৭১ সালে পাবনার জেলা প্রশাসক ছিলেন সিএসপি নূরুল কাদের খান। ’৭১-এর এপ্রিলেই তিনি ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার জিপের ড্রাইভার ছিলেন পাবনা শহরের পর্শ্চিম দিকের আরিফপুর গ্রামের ফকির আবুল কাশেম। কাশেম একদা পাকিস্তানের পাঞ্জাবে সৈনিক হিসেবে যুক্ত থাকার পরে ছুটিতে তার গ্রামের বাড়ি এলে তিনি আর ফিরে না গিয়ে জেলা প্রশাসক নূরুল কাদের খানের জিপের ড্রাইভারের চাকরি পেয়েছিলেন। যেহেতু কাশেম বাংলা, উর্দু, পাঞ্জাবি এবং ইংরেজি কিছুটা জানতেন সেই সুবাদে তার চাকরি হয়েছিল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ড্রাইভার পদে।

নূরুল কাদের খান ভারতে যাওয়ার পর পাবনা জেলা প্রশাসক হয়েছিলেন সম্ভবত ইপিসিএস আনসার খান। অন্যদিকে পাবনা শহরের পুব দিকে ৮-১০ মাইল দূরের মাওলানা আবু ইসহাককে গভর্নর মালেক শিক্ষামন্ত্রী বানিয়েছিলেন। যেহেতু তিনি ছিলেন পাবনার আলিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ/প্রিন্সিপাল। পাবনার জামায়াতে ইসলামীর প্রধান ছিলেন মাওলানা আবদুস সুবহান। তিনি কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনের আরবি শিক্ষক হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কুড়ি-একুশ বছর আগে পাবনার জামাই পাঞ্জাবনিবাসী ক্যাপ্টেন জায়েদিকে পাকিস্তান সরকার পাবনার গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দেয় ১৯৫০-৫১ সালে। এ শহরে এসে কেষ্টপুর, আটোয়া, যুগীনগর ও রাঁধানগরের মুসলিম লীগের নেতাদের সঙ্গে সখ্য হয়েছিল। তার সখ্যরা সবাই ছিল মুসলিম লীগার। সখ্যদের সুন্দর একটি সাদা দোতলা বাড়ি দখল করে উঠিয়ে দিয়েছিলেন লীগনেতা কেষ্টপুরের খবির উদ্দিন জায়েদির নির্দেশে। সেই সুন্দর বাড়িটি এখনো আছে তার সৌন্দর্য নিয়ে। রূপকথা সিনেমা হলের দক্ষিণে ইছামতী নদীর পুব দিকে। শহরের জামতলা মহল্লার শেখ হাকিম উদ্দিন উকিল সাহেবের বড় মেয়ে ছিলেন অপরূপা দশম শ্রেণির ছাত্রী সখিনা বেগম। জোর করে বিয়ে করেছিলেন ৫০-এর দশকের শুরুতেই। ক্যাপ্টেন জায়েদি পাঞ্জাবে থাকতে বিয়ে করলেও সে কথা কাউকে কোনো দিন বলেননি। অনেক পরে জেনেছিলেন দ্বিতীয় স্ত্রী সখিনা বেগম। ক্যাপ্টেন জায়েদি দখলকৃত বাড়িটিতে বাদুড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, এমনকি কথাবলা ময়নাও পুষতেন। আমরা স্কুলের ছাত্ররা গিয়ে দেখতাম বাদুড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। জায়েদি পাবনা পৌরসভার চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন ১৯৬৭-৬৮ সালে। তারই সময়ে পাবনায় ভুট্টো এসেছিলেন। এ সময় গোলাগুলির ঘটনায় অনেকে আহত হয়েছিলেন। গিয়েছিলেন অনেকেই পাবনা জেলখানায়। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, তিনি পাবনা জজ কোর্টের নামি উকিল ছিলেন এবং পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রধান ছিলেন। তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নাসিম ১৯৬৭ সালে পাবনা থেকে এসে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে বিএতে ভর্তি হয়েছিলেন আমাদের সঙ্গে। মন্ত্রী হওয়ার পরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। বছর কয়েক আগে করোনায় পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন পরপারে। তাঁর বাবা ক্যাপ্টেন মনসুর আলীসহ চারজন নিহত হলেন ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। বেইমান, নিমকহারাম, বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাকের নির্দেশে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে। এ কথা অনেকে জানেন, অনেকে জানেন না। আরও অনেকে জানেন না, বগুড়ার গাবতলী গ্রামের মোহাম্মদ মুনসুকুর রহমান জিয়াউর রহমানের বাবা। মা বেগম জাহানারা খাতুন রানী। বাবা মুনসুকুর রহমান সপরিবারে থাকতেন করাচিতে। চাকরিতে নিয়োজিত থাকার সুবাদে তার পুত্রসন্তানরা কেউই বাংলা পড়তে, লিখতে ও বলতে পারতেন না। পুত্র জিয়া সুযোগ পেয়েছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। সেনাবাহিনীর চাকরি মেজর পদে পদোন্নতি দিয়ে জিয়াউর রহমানকে পাঠানো হয়েছিল চট্টগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতার অনুরোধক্রমে জিয়া চট্টগ্রাম বেতারে বলেছিলেন, ‘অন বিহাফ অব শেখ মুজিবের নির্দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।’ এবং জিয়ার ২৭ মার্চ অথবা ২৮ মার্চ ১৯৭১ সালে বেতারে ভাষণটি কালুরঘাট থেকে প্রচারিত আমরা অনেকেই শুনছিলাম। সেই জিয়া একসময় খুনি খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জাতির জনককে হত্যা করিয়েছিলেন ফারুক, রশীদ গংকে দিয়ে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর খুনি, বিশ্বাসঘাতক খন্দকারের ভূমিকা অনেকেই জানেন। খুনি মোশতাক রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর জেলে থাকা মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের জেল থেকে ছেড়ে দেন। ১৯৭৫ পেরিয়ে খন্দকার মোশতাককে সরিয়ে দিয়ে কূটকৌশলে সরালেন বিচারপতি সায়েমকে এবং জিয়াউর রহমান দেশের রাষ্ট্রপতি হলেন বন্দুকের জোরে। পরে কাছে টেনে নিলেন জামায়াতের আমির গোলাম আযম, আলবদর-রাজাকার প্রধান পাবনার সাঁথিয়া গ্রামের খুনি বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান মতিউর রহমান নিজামীসহ আরও জনাকয়েক খুনিকে। জামায়াতের উত্থান সেই থেকে। পরে ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি ভোটে জিতলেও বুকে টানেনি। ১৯৯৬-২০০১ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রশ্রয় দেয়নি জামায়াতে ইসলামীকে। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে কাছে টেনে নিয়ে জামায়াত নেতাদের কাউকে কাউকে বানাল মন্ত্রী। ২০০৭-এ এলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ক্ষমতায় ছিল দুই বছরের বেশি। পরে ভোটাভুটিতে আওয়ামী লীগ এলো ২০০৮ সালে। কথাটি সর্বজনবিদিত হলেও ঘাপটি মেরে থাকা জামায়াত নেতারা সরকারের বিরুদ্ধাচরণে অস্থিরতা শুরু করল বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হয়ে। দৈনিক ইত্তেফাক ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করল।

২৬ স্পটে জামায়াতি তাণ্ডব রিপোর্টটি নিম্নরূপ : ‘গত ১০ মাস আগে ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ নেতা মামুনকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা শহর সাতক্ষীরায় রাজনৈতিক হত্যা শুরু হয়। এখন পর্যন্ত এ কারণে হত্যার শিকার হন ২৭ জন। বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে প্রায় ২০০। এ হিসাব গতকাল সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন থেকে নেওয়া। গত ২৫ নভেম্বর থেকে রাস্তা কেটে সারা দেশ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে সাতক্ষীরাকে। কখনো কখনো রাস্তা চালু করা হলেও আবার তা বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। কাটা গাছ ফেলে অন্তত ২৬টি এলাকা এখন সম্পূর্ণ জামায়াতের দখলে। সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর মতে, সেখানে অঘোষিত জামায়াত শাসন চলছে। প্রশাসন নির্বিকার। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা ঘরছাড়া। না হয় ঘরের মধ্যে আটকা পড়ে আছেন। যেসব এলাকা দখলে নিয়ে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব, নাশকতা চলছে সেগুলো হচ্ছে-দেবহাটা উপজেলার গাজীরহাট, সখিপুর, নলতা, শ্যামনগরের কাশেমসারি সদরের আবাদের হাট, মাধবকাটি, কদমতলা, বেনেরপোতা, রামচন্দ্রপুর, ছয়খরিয়া, বাকাল, কচপুকুর, খানপুর। তালা উপজেলার পাটকেলঘাটা, আগরদড়ি, কলারোয়াসহ আরও কয়েকটি এলাকা।’ সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ কলেজের বাংলার অধ্যাপক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক গাজী আজিজুর রহমান। তিনি ছিলেন আমার কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। তিনিই একমাত্র বন্ধু বেঁচে আছেন, আর কেউ নেই। গাজী আজিজ আমার ৫৫-৫৬ বছরের বন্ধু। আজিজ আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা, তিনি জামায়াতিদের হাত থেকে সেদিন পালিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন অল্পের জন্য। ওই জামায়াতিদের ২৬ স্পটে তাণ্ডবের কথা ঢাকায় এসে আমাকে জানিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ যাতে চতুর্থ দফায় ক্ষমতাসীন হতে না পারে সেজন্য তারা মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে। বিএনপি নেতাদের দাবির কথা সবাই জেনেছেন ইতোমধ্যে। আগামী বছর ২০২৪ সালে ভোটাভুটি হবে। কোন দল হারবে আর কোন দল জিতবে তা জনগণের ভোটের ওপর নির্ভর করছে। আশা করি ভোটাভুটি সুষ্ঠু হোক। যেন কোনো ভোটার আহত বা নিহত না হন।

দিন ফুরিয়ে আসছে, তার পরও বলব, ধৈর্য ধারণ করতে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালো বাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা।’ অন্যদিকে স্প্যানিশ দার্শনিক বলেছেন, শ্রদ্ধা পেতে হলে অন্যকে শ্রদ্ধা করতে হবে। দার্শনিক ভলতেয়ার, গেগোরি, ফরাসি লেখক বিশ্বখ্যাত আলবেয়ার কামু জানিয়েছেন, মূর্খকে শ্রদ্ধা করার চেয়ে খারাপ কিছুই নেই। ইংরেজ ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড গিবন জানিয়েছেন, ‘যার মতামতে আমার শ্রদ্ধা নেই, তার সঙ্গে তর্ক করার মতো ভুল আমি কখনো করি না।’

মানুষমাত্রই ভুল করে। যেমন বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমান বলেছিলেন, ১০ ডিসেম্বর থেকে দেশ চলবে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের নেতৃত্বে। তিনি একদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নেতা হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কোথায় কী বলতে হবে তা এখনো শেখেননি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৪ হাজার ৬৮২ দিন জেলে ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। কবির কথায় দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে। অপেক্ষা ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের।

লেখক : কবি

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর