শিরোনাম
সোমবার, ৬ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

নৈতিক শিক্ষার বিকল্প নেই

প্রিন্সিপাল এম এইচ খান মঞ্জু

নৈতিক শিক্ষার বিকল্প নেই

হতাশা মানুষকে মূল্যহীন করে তোলে। কোনো ইচ্ছা পূরণ না হলে বা কাজের আশানুরূপ ফল না পেলে ভেঙে পড়া হতাশাগ্রস্তদের কাজ। লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব না হলে হাল ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতাই হতাশার লক্ষণ। হতাশা একটি মানবিক অনুভূতি যার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি কখনো মানসিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে। 

হতাশাগ্রস্ত মানুষ আত্মহত্যা মহাপাপ জেনেও এ পথে পা বাড়ায়। জগতের সব ধর্ম এবং নীতিশাস্ত্রে আত্মহত্যার সমর্থনে কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। আত্মহত্যা নিরসনে সরকারি-বেসরকারি নানাবিধ উদ্যোগ এবং প্রয়াস রয়েছে। তথাপি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছেই। আত্মহত্যার পেছনে যৌতুক, বেকারত্ব, পারিবারিক কলহ, প্ররোচনা, চাপ, হতাশা, প্রেমে ব্যর্থতা, চাহিদা এবং আকাক্সক্ষার মধ্যে ফারাক, নেতিবাচক চিন্তা, জীবনের উদ্দেশ্যহীনতায় হীনম্মন্যতা, আস্থাহীনতা কাজ করে।  ২০২২ সালে দেশে মোট ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে স্কুল ও সমমান পর্যায়ের শিক্ষার্থী রয়েছে ৩৪০ জন। কলেজ ও সমমান পর্যায়ে ১০৬ জন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ৩২০ এবং পুরুষ ২১২ জন। আত্মহত্যার শীর্ষে রয়েছে নারী শিক্ষার্থী। প্রতি মাসে ৩৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।

জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে আঁচল ফাউন্ডেশন যে সমীক্ষা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে তাতে এ তথ্য উঠে এসেছে।

মানুষ নানা কারণে আত্মহত্যা করে বা করতে পারে। এর মধ্যে আছে বিষণ্ণতা, ব্যক্তিত্বে সমস্যা এবং গুরুতর মানসিক রোগ। তা ছাড়া মাদকাসক্তি, অপরাধবোধ, আত্মহত্যায় প্ররোচনা, অশিক্ষা, দারিদ্র্য, দাম্পত্য কলহ, প্রেম-কলহ, অভাব-অনটন, দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগা, যৌন নির্যাতন, অভিমান, পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট, প্রেমে ব্যর্থ ও প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকে আত্মহত্যা করে। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা সংঘটিত হয় ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতার জন্য। তুচ্ছ কারণেও অনেকে আত্মহত্যায় ঝুঁকছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার প্রতিরোধ করতে হলে প্রথমে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাজ করতে হবে। অভিভাবক ও পরিবার এখানে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যদের বুঝতে হবে বিষয়টি। তাদের একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে। ভূমিকা রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যায়ক্রমে একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া দরকার। আবার সমাজও এখানে অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা যদি উন্নত থাকে তাহলে আত্মহত্যা প্রতিরোধ সম্ভব। মানসিক রোগ এবং পারিবারিক ও সামাজিক নানা প্রতিক্রিয়া থেকে জন্ম নেওয়া মানসিক চাপের সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। এ জন্য দরকার সচেতনতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। আগে থেকে সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হলে জীবনের এ মর্মান্তিক পরিণতি এড়ানো সম্ভব। শুধু বয়স্ক নারী-পুরুষ নয়, অল্প বয়সী এমনকি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ অতিমাত্রায় হতাশাগ্রস্ত ও সংবেদনশীল হয়ে পড়ায় আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। সব বয়সী মানুষের মধ্যেই বেড়েছে এর প্রবণতা। 

সামাজিক বৈষম্য, পারিবারিক কলহ, মাদক, ইন্টারনেটের অপব্যবহার, সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের উদাসীনতা, পারিবারিক বন্ধন ফিকে হয়ে আসার মতো কারণগুলো প্রকট আকার ধারণ করায় মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার মতো জঘন্য অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে। এ ছাড়া নৈতিক স্খলন, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার, ব্ল্যাকমেলিং অনেককে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

তথ্য অনুযায়ী তরুণদের মধ্যে অধিকাংশই মানসিক বিষণ্ণতায় ভোগেন। যেমন- অধিকাংশ সময় মন খারাপ থাকা, পছন্দের কাজ থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা। অস্বাভাবিক কম বা বেশি ঘুম হওয়া, কাজে মনোযোগ হারিয়ে ফেলা, নিজেকে নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা করা, সবকিছুতে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা। এ সমস্যাগুলো তীব্র আকার ধারণ করলে আত্মহত্যার চেষ্টা করে তরুণরা। আত্মহত্যা সাধারণত কম রিপোর্ট করা হয়, তাই প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। আমাদের কাছে এখনো বিগত বছরের সামগ্রিক জাতীয় আত্মহত্যার তথ্য না থাকলেও এটি অনস্বীকার্য যে মহামারি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের আরও অবনতি ঘটিয়েছে। ২০১৪ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সমীক্ষায় বলা হয়েছে- দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করে। এর বেশির ভাগ ২১ থেকে ৩০ বছরের নারী।  আত্মহত্যা একটি সামাজিক ব্যাধি। ইসলামে আত্মহত্যা হারাম। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের হাতে নিজেদের জীবন ধ্বংসের মুখে ফেলো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৯৫)। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা আরও বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের নিজেদের হত্যা কর না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর করুণাময়।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ২৯)। আত্মহত্যার ব্যাপারে রসুল (সা.) বিশেষভাবে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামেও তার সেই যন্ত্রণাকে অব্যাহত রাখা হবে। আর যে ব্যক্তি ধারালো কোনো কিছু দিয়ে আত্মহত্যা করবে, তার সেই যন্ত্রণাকেও জাহান্নামে অব্যাহত রাখা হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৪৪৬)।

নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ কখনো আত্মহত্যা করতে পারে না। বর্তমানে আমাদের সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে হিংসা, দলাদলি, অন্যায়-অনাচার, খুন, ধর্ষণসহ জঘন্য কার্যকলাপ। এর থেকে উত্তরণে নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন। ব্যক্তিজীবন থেকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়- সর্বত্র নৈতিক শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই সুন্দর, সফল, কল্যাণকর ও সুখী সমাজ গঠন করা সম্ভব।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ

 

সর্বশেষ খবর