বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক

প্রফেসর মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান

শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক

ইতিহাসের চিরন্তন সত্য এই যে, আন্ধকারে আচ্ছন্ন জাতিকে আলোর পথ দেখাতে, পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করতে যুগে যুগে আবির্ভাব হয় মহামানবের। এই মহামানব নিজ জাতিকে অন্ধকার, অনাচার আর নিপীড়ন থেকে মুক্ত করেন। আবার তিনি সমাজ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনেন, ইতিহাসের গতিপথে নতুন ধারার সৃষ্টি করেন। ইতিহাসের এ শাশ্বত ধারার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যায় ইংরেজ শাসিত ভারতে বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলার মেহনতি মানুষ ও কৃষক সমাজ যখন অশিক্ষা, দারিদ্র্য, কুসংস্কারে নিমজ্জিত, মহাজনের অব্যাহত শোষণ আর নিপীড়নে জর্জরিত হয়ে দিশাহারা ঠিক সেই ঘোর অন্ধকারের যুগে আবুল কাশেম ফজলুল হকের আবির্ভাব হয়। তিনি বাংলার কৃষক সমাজ ও মেহনতি মানুষের জন্য শিক্ষা, সামাজিক, অর্থনৈতিক বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন এবং সাধারণ মানুষের ভাত-কাপড়ের জন্য লড়াই করেছেন। তিনি যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, ভাগ্যাহত কৃষকদের জমিদার ও মহাজনদের শোষণ থেকে মুক্ত করেছেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশে ভীত রচনা করেছেন।

কৃষক শ্রমিকের মুক্তিদাতা, গরিবের বন্ধু, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনীতির অগ্রদূত, জাতীয়তাবাদী চিন্তার ধারক, এ উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর বরিশালের রাজাপুর থানার সাতুরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বিত্তশালী পিতা মুহাম্মদ ওয়াজিদের একমাত্র পুত্র ফজলুল হক সোনার চামুচ মুখে দিয়ে জন্মগ্রহণ করে প্রাচুর্যের মধ্যে লালিত হলেও এদেশের দরিদ্র কৃষক ও মেহনতি সাধারণ মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করে কাজ করে গেছেন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি যেমন ছিলেন মেধাবী ছাত্র তেমনিই ছিলেন শরীরচর্চা, খেলাধুলা ও সমাজসেবামূলক কর্মকান্ডে উৎসাহী ও সাহসী। তিনি ১৮৯০ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে পাস করে বিভাগীয় বৃত্তি ও স্বর্ণপদক লাভ করেন। এরপর ১৮৯২ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে কৃতিত্বের সঙ্গে এফএ পাস করেন। ১৮৯৪ সালে গণিত, রসায়ন ও পদার্থ এই তিনটি বিষয়ে অনার্স নিয়ে প্রথম বিভাগে ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি প্রথম মুসলমান ছাত্র হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮৯৬ সালে গণিতে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৮৯৭ সালে বিএল পাস করেন। তিনি কিছুকাল বরিশালে রাজচন্দ্র কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯১২ সালে কলকাতা হাই কোর্টে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন। তিনি পেশা হিসেবে আইন ব্যবসা শুরু করলেও প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন এবং এদেশের মানুষের মুক্তির প্রতিটি আন্দোলনে আপসহীন ভূমিকা রেখে জনপ্রিয় ও সফল জননেতা হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষ করে বাংলার রাজনীতির অঙ্গনে তিনি ছিলেন যেমন সক্রিয় তেমনি তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল অত্যন্ত বলিষ্ঠ। রাজনীতির এই প্রবাদপুরুষ ফজলুল হককে তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, পান্ডিত্য, বিচক্ষণতা আর সাহসী ভূমিকার জন্যই শেরেবাংলা উপাধি দেওয়া হয়। তিনি একাধারে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল দুটি রাজনৈতিক দলের অন্যতম কর্ণধার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেছেন। তিনি ১৯১৬ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। আবার ১৯১৭ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং ১৯১৮-১৯১৯ সালে এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে ১৯১৬ সালে লক্ষেèৗ চুক্তির অন্যতম প্রণেতা ছিলেন শেরেবাংলা ফজলুল হক। তিনি ১৯১৯ সালে পাঞ্জাবে জালিয়ানওয়ালাবাগ নির্মম হত্যাকান্ডের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে কাজ করেছিলেন। 

মহান নেতা শেরেবাংলা দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে যে সব সরকারি পদে কাজ করে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১৯২৪ সালে অবিভক্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রী, ১৯৩৫ সালে কলকাতা করপোরেশন মেয়র, ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী, ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলার তৃতীয় মুখ্যমন্ত্রী, ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ১৯৫৬-১৯৫৮ সালে পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর।

দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়ক, স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা, মুসলিম জাগরণের নেতা, ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের উত্থাপক, অসাধারণ বাগ্মী, শোষিত-লাঞ্ছিত-নিপীড়িত কৃষক-প্রজার মুক্তিদাতা শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক ভারত-পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তিনি তাঁর অপূর্ব ব্যক্তিত্ব ও মহৎ চরিত্রের আকর্ষণের দ্বারা লক্ষ কোটি মানুষের হৃদয় জয় করে জননায়ক হয়েছিলেন এবং ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। মানব সেবায় ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মূল দর্শন। তাঁর হৃদয় যেমন ছিল সাধারণ মানুষের চিরন্তন আবাসস্থল আবার তেমনই তিনি ছিলেন গণমানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়। তাই তো খুব সঠিকভাবেই তাঁর সম্পর্কে লেখা হয়েছে, যদি বাংলাদেশের সমস্ত প্রকৃতি অর্থাৎ মাটি, জলবায়ু, আকাশ সবকিছুকে একসঙ্গে গবেষণাগারে নিয়ে রসায়নিক গবেষণা চালিয়ে একটি ফলাফল পাওয়া যেত তবে তা হতো শেরেবাংলা ফজলুল হকের প্রতিচ্ছবি। ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল এই ক্ষণজন্মা কৃতী পুরুষ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর জীবনাদর্শ ও কর্ম প্রচেষ্টাই হোক আমাদের সামনে পথ চলার নির্দেশনা ও প্রেরণা।

লেখক : প্রাক্তন ট্রেজারার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর