শিরোনাম
সোমবার, ১৫ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

চালুনি বলে ছুঁচের পেছনে ছ্যাঁদা

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

চালুনি বলে ছুঁচের পেছনে ছ্যাঁদা

২০১৪ সাল থেকে বিএনপি অব্যাহতভাবে সরকার পতনের আন্দোলন করে আসছে। ১০ বছর একটানা আন্দোলন চালিয়েও কেন কোনো সফলতার মুখ দেখতে পারল না, তার বিচার-বিশ্লেষণ বিএনপি করছে কি না জানি না। ২০১৪ আর ২০২৩ এক নয়। ২০১৪-তে তারা পারেনি। কিন্তু এখনো সেই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ১০ বছর ধরে সরকার পতনের হাঁকডাক করছে, কাজ কিছুই হয়নি। বারবার ভুল সিদ্ধান্তের জন্য তারা ক্রমশ পেছনে চলে যাচ্ছে। তারা বুঝতে পারছে না, ১০ বছরে মানুষের মন-মেজাজ, চিন্তা-চেতনা ও আগ্রহ-অনাগ্রহসহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে, তাতে সরকার পতনের বাস্তবতা এখন আর নেই। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের যে রাজনৈতিক কৌশল ছিল সেটাকে ধার করে ২০২৩ সালে এসে আওয়ামী লীগ সরকারেরই পতন ঘটাতে চাইছে বিএনপি, যা আসলে রাজনৈতিক মেধাশূন্যতার পরিচয় বহন করে। বিএনপি বলছে, গণতন্ত্র শেষ এবং বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষের ভাত-কাপড়, কর্মসংস্থান, আয়-রোজগার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, রেল, রাস্তা, সেতু ইত্যাদি যা মানুষের জীবনের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত, সে সম্পর্কে বিএনপি সরকারে থাকতে কী করেছে, আর আওয়ামী লীগ সরকার কী করছে, তার কোনো স্পষ্ট তথ্যভিত্তিক ও তুলনামূলক চিত্র তারা তুলে ধরছে না। গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা, যেটাই বলি না কেন, সবই আপেক্ষিক ব্যাপার। কিছুদিন আগে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের একটি ইংরেজি দৈনিকে একটা কলাম লিখেছেন। তাতে তিনি যথেষ্ট যুক্তিসহকারে বলেছেন, চীনে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা রয়েছে এবং চীনের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতায় সেটাই সর্বোত্তম গণতন্ত্র। আর তার কারণেই প্রায় ১৪০ কোটি মানুষের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা শুধু নিশ্চিত করাই নয়, চীন এখন বিশ্বে পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পেরেছে। কিন্তু আমরা যারা পশ্চিমা গণতন্ত্রের মডেল অনুসরণ করি তাদের কাছে একদলীয় কমিউনিস্ট পার্টির ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক শাসন মানতে নারাজ। ইউরোপে ৩০ বছরের ধর্মযুদ্ধ পরিসমাপ্তির পর ১৯৪৮ সালে ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তির মধ্য দিয়ে যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় তার এক নম্বর ও মৌলিক কথা ছিল রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা রাখতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্র ও রাজনীতির সিদ্ধান্ত, নীতিমালা ও আইনে ধর্মীয় বিবেচনা থাকবে না। ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তির মধ্য দিয়ে আবির্ভূত রাজনীতির সুফল ইউরোপ পেয়েছে। এই সূত্রে অথবা বাস্তবতার নিরিখে ১৯৯২ সালে আমেরিকার একজন বিচারপতি হেনরি এ ব্লাকমান এক ঐতিহাসিক রায়ে উল্লেখ করেন, রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ধর্মের প্রবেশ গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। শুধু তাই নয়, এর মধ্য দিয়ে সাম্য ও স্বাধীনতা শেষ হয়ে যায় (মূল পলিটিক্যাল আইডিয়াস, বেন ডুপ্লে, অক্সফোর্ড ২০১০, পৃ. ৪৮)। রাষ্ট্র ও রাজনীতির অবলম্বন যদি ধর্ম হয়, তাহলে পরিণতি কী হতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ এখন পাকিস্তান। স্বাধীনতার ৭৬ বছরের মাথায় এসেও স্থির হতে পারেনি, এখনো জ্বলেপুড়ে কেবলই ছারখার হচ্ছে। পাকিস্তানি রাষ্ট্রের যাত্রার শুরুতে ১৯৫৩ সালে কে মুসলমান, আর কে তা নয়, তা নিয়ে এক দাঙ্গাতে প্রায় ৫০ হাজার আহমদীয় সম্প্রদায়ের মানুষ নিহত হয়। ঘটনার পর বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন তখন লাহোর হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি মুহম্মদ মুনির। তদন্ত কমিটি তখন পাকিস্তানের সব ধর্মীয় গ্রুপের প্রধান প্রধান পন্ডিতকে ডাকে। পরবর্তীতে মুহম্মদ মুনির বলেছেন, মৌলিক কথা, কে মুসলমান, আর কে তা নয়, এ প্রশ্নের উত্তরে দুজন ইসলামিক পন্ডিত একমত হতে পারেননি। (সূত্র-রিইসাজিনিং পাকিস্তান, হুসেন হাক্কানী, পৃ-৮৩)।

সুতরাং স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মের পবিত্রতা রক্ষা এবং গণতন্ত্রকে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান একাধারে রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, প্রতিরক্ষা প্রধান ও সেনাবাহিনী প্রধান, অর্থাৎ রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে সামরিক আদেশ দ্বারা সংবিধান থেকে অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতাকেও বাতিল করে দিলেন। তার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র কি রক্ষা পেল। নাকি গণতন্ত্রকে হত্যা করা হলো? আজ বিএনপির চলমান রাজনীতির জন্যই এ প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক। তিনি সেনা পোশাক পরে রাজনীতি করেছেন। নির্বাচন করেছেন এবং নিজের রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেছেন। তাতে কি গণতন্ত্র সমৃদ্ধ হয়েছে, নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জিয়াউর রহমান প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। সে সময়ে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ২০টি অভুত্থানের চেষ্টা হয়। তার মধ্যে ১৯৭৭ সালের ১ অক্টোবর সংঘটিত অভ্যুত্থানের চেষ্টাটি শুধু বাংলাদেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বহুল আলোচিত। তার কারণও আছে। তখন সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে তথাকথিত বিচারের মাধমে ৯ অক্টোবর ১৯৭৭ থেকে পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে ১১৪৩ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। [সূত্র-বাংলাদেশ এ লিগেসি অব ব্লাড, অ্যান্থনি মাসকারেনহাস, পৃ-১৪৮]

সে সময়ের বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদ পরবর্তীতে মাসকারেনহাসের কাছে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সবাইকে ও সবকিছুকে জিয়াউর রহমান কলুষিত করেছেন (প্রাগুক্ত-পৃ-১২৯)। পুরনো কথা আবার সামনে আসছে এ কারণে যে, বিএনপি এখনো অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বলে, জিয়াউর রহমানই তাদের রোল মডেল। আদর্শ এবং রাজনীতির মূল অবলম্বন। তাই জিয়াউর রহমানের লিগেসির কারণেই মানুষের মনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, বিএনপি কোন ধরনের গণতন্ত্র উদ্ধার করতে চায়, সেটা কি জিয়াউর রহমানের গণতন্ত্র, নাকি অন্য কিছু? জিয়াউর রহমানের অবর্তমানে বিএনপি সর্বশেষ ক্ষমতায় ছিল ২০০১-২০০৬ মেয়াদে। তখন সংসদে নিজেদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও জামায়াতকে নিয়ে সরকার গঠন করা হয়। জামায়াত নেতা আলী আহসান  মোহাম্মাদ মুজাহিদ সংসদ সদস্য না হয়েও টেকনোক্রেট কোটায় মন্ত্রী হন। বিএনপি সরকারের মন্ত্রী হয়ে মুজাহিদ প্রকাশ্যে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে বলেন, একাত্তরে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। তাতে দেশব্যাপী তীব্র প্রতিবাদ সৃষ্টি হলেও বিএনপি এবং বিএনপির সরকার ছিল সম্পূর্ণ নীরব। এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দেওয়ার পরও মুজাহিদের মন্ত্রিত্বের কোনো ক্ষতি হয়নি। সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশের মানুষ কি সেই গণতন্ত্র চায়, যেখানে সরকারের মন্ত্রীরা বলবেন, একাত্তরে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। মুজাহিদের কথায় আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ, জাতির পিতা, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও মহান গৌরবোজ্জ্বল বিজয়, সবকিছু নাই হয়ে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো অস্তিত্ব থাকে না। জামায়াত এখন বিএনপির সঙ্গে আছে কি না তা পরিষ্কার নয়। এ ব্যাপারে বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়নি। জামায়াত এখন বিএনপির সঙ্গে না থাকলেও কথা থেকে যায়। কারণ, নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ কি না, সে প্রশ্ন চিরন্তন। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে গণতন্ত্রের আরও কিছু স্বরূপ দেখা গেছে। ২০০১ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের প্রধান একটি ইংরেজি দৈনিকের বড় শিরোনাম ছিল, ভোলার চরফ্যাশনে একরাতে ২০০ হিন্দু মহিলা ধর্ষণ। ২০০৪ সালে জামায়াত প্রসূত জঙ্গি নেতা সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলাভাই উত্তরবঙ্গে স্বশাসন ও স্ববিচার ব্যবস্থা চালু করেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রের ভিতরে আরেকটি রাষ্ট্র তৈরি হয়। একজন রিপোর্টার লিখেছেন, ওই সময়ে বগুড়ার নন্দীগ্রামে বাদশা নামের এক যুবকের লাশ গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়ে মানবতার সঙ্গে চরম প্রহসন করে বাংলাভাই বাহিনী। গাছের ডালের সঙ্গে পা বাঁধা, মাথা নিচ দিকে ঝুলছে, পত্রিকার পাতায় ছাপা হওয়া এই ছবি দেখে দেশবাসী আঁতকে উঠলেও তৎকালীন প্রশাসন ছিল নির্বিকার। নির্বিকার বললে কম বলা হবে, বাংলাভাই বাহিনী লাঠি হাতে রাজশাহী শহরে ট্রাক মিছিল করে এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের স্বাগত জানানো হয়। তখন পবিত্র সংসদে দাঁড়িয়ে জামায়াত-বিএনপি নেতারা ঐক্য কণ্ঠে বলেছেন, এসব মিডিয়ার সাজানো কাহিনি, বাংলাভাই নামে কেউ নেই। এবার একটু দেখি বিদেশি মিডিয়া তখন বাংলাদেশকে কী রকম দৃষ্টিতে দেখেছে। ২০০২ সালের ২ এপ্রিল ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের শিরোনাম ‘পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও ভয়ংকর হয়ে উঠছে ইসলামিস্ট জঙ্গি। ২০০২ সালের ৪ এপ্রিল ফারইস্টার্ন ইকোনমিক পত্রিকার শিরোনাম ‘বাংলাদেশ থেকে সাবধান, সেখানে এখন জঙ্গিগোষ্ঠীর আস্তানা’। ২০০৩ সালের ২৩ নভেম্বর ‘দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকার শিরোনাম- ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য দেশত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা বাংলাদেশে নেই।’ পত্রিকায় প্রকাশিত বহু ঘটনা ও রিপোর্টের মধ্য থেকে মাত্র কয়েকটি ওপরে উল্লেখ করেছি, যার মধ্য দিয়ে তখন গণতন্ত্রের কী অবস্থা ছিল তার একটা চিত্র দেখা যায়। অনেকে বলেন শুধু পুরনো কথা বলে কী লাভ। আজকে যদি বিএনপির অবস্থান পরিবর্তন হতো তাহলে পুরনো কথার খুব একটা প্রয়োজন হতো না। কিন্তু তার কোনো লক্ষণ নেই। এবার বর্তমান সরকারের সময়ের চিত্রটি দেখা যাক। দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক এবং অনলাইন পত্রিকা, সঙ্গে এফএম রেডিও ও টেলিভিশনের সংখ্যা ২০০১-২০০৬ মেয়াদে যা ছিল তার থেকে ৪ থেকে ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগে তথ্যপ্রযুক্তির যে বিস্তার ঘটেছে, তাতে বাংলাদেশের জন্য সামাজিক মাধ্যম এখন সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী মিডিয়া।

মিডিয়া হচ্ছে গণতন্ত্রের পরিচায়ক, বাহক ও রক্ষাকবচ। স্মরণযোগ্য, এক সময়ে বিএনপি সরকার নিরাপত্তার অজুহাতে তথ্যপ্রযুক্তি থেকে বাংলাদেশকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বিএনপির অভিযোগ মামলা-হামলা চালিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই অভিযোগের মধ্যে হয়তো সত্য আছে, আবার হয়তো অতিরঞ্জনও আছে। তবে বিএনপির এই যে অভিযোগ, তার সঙ্গে ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি সরকারের সময় আওয়ামী লীগের ওপর দিয়ে কী ঘটে গেছে তা একবার দেখে নিলে বুঝতে পারা যাবে দুয়ের মধ্যে পার্থক্য কোথায়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড আক্রমণ। বাংলাদেশের আদালতের বিচারের রায় এবং দেশি-বিদেশি সব মিডিয়ার তথ্যবহুল অকাট্য সব দলিল-দস্তাবেজের মাধ্যমে এটা এখন একদম স্পষ্ট যে, তৎকালীন জামায়াত-বিএনপি সরকার সুপরিকল্পিতভাবে ওই গ্রেনেড আক্রমণের ঘটনা ঘটিয়েছে এবং তার লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা। সেই গ্রেনেড আক্রমণে ২৪ জন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী নিহত হন। তারপর আওয়ামী লীগ নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টার, বিশ্বখ্যাত মানুষ শামস কিবরিয়া, নাটোরের মমতাজউদ্দিন ও খুলনার মুনজুরুল ইমামকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অভিযোগ আছে তখন তাদের কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়। তাই শুধু তুলনার জন্য বলি, গত ১৪ বছরে উল্লিখিত ঘটনাগুলোর মতো একটি ঘটনাও ঘটেনি। তাই বিএনপির দমন-পীড়নের অভিযোগ বাংলার সেই প্রবাদ বাক্যের মতোই শোনায়, চালুনি বলে ছুঁচ তোমার  পেছনে কেন ছ্যাঁদা। পশ্চিমা মডেলের গণতান্ত্রিক বিশ্বের খ্যাতিমান সব পন্ডিত ব্যক্তি মোটামুটি একমত যে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই কেবল দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধি ঘটাতে পারে। সেই সূত্রে ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি সরকারের উন্নয়ন চিত্রের সঙ্গে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন চিত্রের একটা তুলনামূলক চার্ট নিয়ে বসলে যে কেউ বুঝতে পারবেন কোন সময়ে গণতন্ত্রের কী অবস্থা ছিল এবং আছে। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিশ্বের মিডিয়া ও গবেষকরা বলতে শুরু করেন, বাংলাদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, পরবর্তী আফগানিস্তান হবে বাংলাদেশ। আর এখন সারা বিশ্বের গবেষক, সংস্থা ও রাষ্ট্র নেতারা বলছেন, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের এক বিস্ময়কর রোল মডেল। ১৪ বছর ধরে বিএনপির সরকার পতন আন্দোলনের যে ফল তাতে আরেকবার প্রমাণ হলো, শুধু দলীয় সমর্থকদের আন্দোলনে সরকারের পতন হয় না। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ লাগে। ২০১৪ সাল থেকে ব্যর্থ হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে, বিএনপির সরকার পতন আন্দোলনের সঙ্গে সাধারণ মানুষ নেই।

ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটের মূল্যায়ন অনুসারে গণতন্ত্রের সূচকে পৃথিবীর যত দেশ আছে তার মধ্যে মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। গণতন্ত্রের সূচকে আরও উন্নতি করতে হলে শুধু সরকারি দল নয়, বড় দল হিসেবে বিএনপিকেও ভূমিকা রাখতে হবে। আর তার জন্য এই লেখার শুরুতে জিয়াউর রহমানের গণতন্ত্র এবং লেখার মাঝখানে নব্য বিএনপির গণতন্ত্রের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, সেখান থেকে বিএনপিকে সরে আসতে হবে। প্যারাডাইস শিফট আবশ্যক। তা না হলে বিএনপির গণতন্ত্র ধ্বংসের ফাঁকা অভিযোগ ওই বাংলা প্রবাদের মতো শোনাবে, ‘চালুনি বলে ছুঁচ তোমার পেছনে কেন ছ্যাঁদা’।

 

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

[email protected]

সর্বশেষ খবর