ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ রোগের ভয়াবহতা বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়েই দিন দিন বাড়ছে। ৬০ বছরের বেশি বয়সের মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। আবার কিছু ক্ষেত্রে ৪০-৫০ বছরে বয়সের মধ্যেও অনেককে আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে। বয়স একটি উল্লেখযোগ্য ঝুঁকির কারণ হলেও নির্দিষ্ট জেনেটিক বা বংশগত কারণে অল্প বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যেও ডিমেনশিয়া হতে পারে। এটি এক ধরনের স্নায়ুজনিত রোগ যা মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলে। এই রোগে আক্রান্ত রোগী কিছু মনে রাখতে পারেন না। এমনকি এ রোগটির কারণে একটু আগেই করা কাজ ভুলে যায় অনেকে। মানুষের স্মৃতিশক্তি, চিন্তাভাবনা, আচরণ এবং প্রতিদিনের স্বাভাবিক কার্যক্রম সম্পাদনের ক্ষমতা কমে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, পৃথিবীতে ৫ কোটির বেশি মানুষের ডিমেনশিয়া রয়েছে। এ জনগোষ্ঠীর ৬৭ শতাংশই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় বাস করে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে ২০২০ সালে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১১ লাখ, ২০২৫ সালে তা বেড়ে ১৪ লাখ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দিন দিন এর প্রকোপ বাড়লেও প্রতিকারের ব্যবস্থা খুব কম। দেশে রোগটি সম্পর্কে কিছুটা সচেতনতা তৈরি হলেও সরকারি বা বেসরকারি কোনো দিক থেকেই যথাযথ গুরুত্ব এখনো পায়নি। বাংলাদেশে গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার কারণে ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা বাড়ছে আর একই সঙ্গে ডিমেনশিয়া আক্রান্তর সংখ্যাও বাড়ছে। এদের মধ্যে বিশাল একটি সংখ্যা প্যালিয়েটিভ রোগী হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিমেনশিয়া বা অ্যালঝেইমার রোগ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। অনেকের ধারণা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস অথবা বোধশক্তির অন্যান্য ক্ষেত্রের অবক্ষয় বয়সের কারণে হয়ে থাকে। তাই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। মহিলাদের মধ্যেও আক্রান্তের সংখ্যাও অনেক, যারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত।
ডিমেনশিয়া বিষয়ে বিশ্বখ্যাত ল্যানসেট কমিশনের সর্বশেষ গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৪টি বিষয়ে যদি ঝুঁকি হ্রাস করা যায় তাহলে ৪০ শতাংশ আক্রান্ত প্রতিরোধ করা বা বিলম্বিত করা সম্ভব হবে। এ বিষয়গুলো হলো : নিম্ন শিক্ষা, উচ্চ রক্তচাপ, শ্রবণ সমস্যা, ধূমপান, মধ্য বয়সে স্থূলতা, হতাশা, দৈহিক সক্রিয়হীনতা, ডায়াবেটিস, সামাজিক নিঃসঙ্গতা, অতিরিক্ত মদ্যপান, মাথায় আঘাত, বায়ুদূষণ, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস এবং রক্তে উচ্চ এলডিএল কোলেস্টেরল। ২০১৯ সালে আইসিডিডিআর,বি এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সের যৌথ গবেষণায় বাংলাদেশে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অজানা তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এ গবেষণাপত্রটি বিশ্ববিখ্যাত মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানসেটে ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে। দেশে ৭টি বিভাগের ষাটোর্ধ্ব প্রায় ৩ হাজার মানুষের ওপর পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা যায় - প্রতি ১২ জনের মধ্যে একজন ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। ওই ব্যক্তিদের মধ্যে ডিমেনশিয়ার প্রাদুর্ভাব বা ব্যাপকতা ৮ দশমিক ১ শতাংশ। ভয়াবহ তথ্য হচ্ছে, পুরুষের তুলনায় নারীদের মধ্যে ডিমেনশিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি। এক্ষেত্রে নারীদের আক্রান্তের হার ১১ দশমিক ৬ শতাংশ আর পুরুষদের আক্রান্তের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় উত্তরের জেলাগুলোতে ডিমেনশিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। রাজশাহী অঞ্চলে ডিমেনশিয়ার প্রাদুর্ভাব ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ আর রংপুর অঞ্চলে এ হার ১৩ দশমিক ১ শতাংশ। তবে গ্রাম ও শহর এলাকায় ডিমেনশিয়ার কোনো তারতম্য নেই বলে গবেষণায় জানানো হয়েছে। বিবাহিতদের তুলনায় যারা একাকী জীবনযাপন করেন বা যাদের জীবনসঙ্গী নেই, তাদের মধ্যে রোগটির প্রাদুর্ভাব বেশি। এ ছাড়া যারা প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন তাদের তুলনায় নিরক্ষর বা যারা কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাননি তাদের মধ্যেও এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। গবেষণায় বলা হয়, ডিমেনশিয়া রোগীদের মধ্যে শতকরা ৯ ভাগ রোগীর জীবনসঙ্গী নেই বা ছিল না। ১৭ ভাগ রোগী ছিল নিরক্ষর। ৪০ ভাগ রোগী প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে পেরেছেন। পরিসংখ্যান বলছে, ২০৩৫ সাল থেকে বাংলাদেশে জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) সংকুচিত হতে শুরু করবে এবং বাংলাদেশ ২০৪৭ সালে একটি ‘বয়স্ক জনগোষ্ঠীর’ দেশে পরিণত হতে শুরু করবে। আর এই বিপুলসংখ্যক বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডিমেনশিয়াসহ মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগ যে বৃদ্ধি পাবে, তা বলাই বাহুল্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিমেনশিয়া নিয়ে সরকারিভাবে এখনো তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। এ রোগ পুরোপুরি ভালো করার কোনো কার্যকর ওষুধ নেই। যেটুকু চিকিৎসা করা যায় তাও অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এর ফলে প্রান্তিক পর্যায়ে আক্রান্তদের যথাযথ চিকিৎসা বা যত্ন নেওয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই ডিমেনশিয়া আক্রান্ত রোগীকে ভুল বোঝা এবং নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। এই ভুল ধারণার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিরা বৈষম্য ও সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্নতার সম্মুখীন হয়। সুতরাং চিকিৎসা ছাড়াও রোগটি নিয়ে সচেতনতা তৈরি হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরিচর্যা করার জন্য দক্ষ ও প্রশিক্ষিত পরিচর্যাকারী না থাকার কারণে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরিবারগুলো প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ডিমেনশিয়া মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগ চোখে না পড়লেও বেসরকারি উদ্যোগে কিছু সংস্থা কাজ করছে। এদের মধ্যে আলঝেইমার সোসাইটি অব বাংলাদেশ অন্যতম।
লেখক : গবেষক