এই, জুবায়ের ভাই ফোন করেছে। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালাম। কে ফোন করেছে? সে লজ্জা পেল। সরি, দিদার ভাই ফোন করেছে। আমার বুকটা তখন হু হু করছে। চোখ ফেটে যেতে চাইছে গভীর কান্নায়। আমি জানি জুবায়ের আর কখনো ফোন করবে না। মুঠোয় ধরা ফোন ছুড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেছে। এই জীবনে জুবায়েরের সঙ্গে আমার আর কখনো কথা হবে না, দেখা হবে না।
রহমান অনেকদিন ধরে বলছিল, চাঁদের হাটের দিনগুলো, আমাদের বন্ধুত্বের ইতিহাস, সুখ দুঃখ এবং আনন্দ বেদনার দিনগুলো নিয়ে কিছু একটা লিখি। সাগরের ‘আনন্দ আলো’র ঈদসংখ্যা (২০০৮) থেকে ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করলাম। প্রথম পর্বে জুবায়ের প্রসঙ্গ আসতেই লিখলাম, জুবায়ের এখন ডালাসের এক হাসপাতালে জীবন এবং মৃত্যুর মাঝখানে শুয়ে আছে। পরম করুণাময়, তুমি আমার বন্ধুকে দয়া করো। তাকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দাও। সন্ধ্যাবেলা এই কটা লাইন মাত্র লিখেছি, এমন অস্থির লাগল জুবায়েরের জন্য। জুবায়ের এখন কেমন আছে? একটু কি ভালো? জুবায়েরের ছোট ভাই ফিরোজ কাজ করে আফজাল এবং আরেফিনের ‘মাত্রা’য়। ফিরোজকে ফোন করলাম। সে বলল, অবস্থা ওরকমই। কোনো চেঞ্জ নেই। আম্মাকে নিয়ে খুব টেনশনে আছি। তাঁকে তো কিছু জানানো হয়নি। জেনে গেলে তাঁকে ম্যানেজ করা খুব কঠিন হবে। ভাইকে নিয়ে কোথাও কিছু লেখার দরকার নেই। আম্মার চোখে পড়লে... ফিরোজের ফোন রেখে জুবায়েরকে নিয়ে লেখা ওই দুটো লাইন আমি কেটে দিলাম।
দুই দিন পর নিউইয়র্ক থেকে ফোন এলো। জুবায়েরের অবস্থা এখন বেশ ভালো। আইসিইউ থেকে বের করা হয়েছে। মাস্ক খুলে সে কথা বলেছে। আমার বুকে চেপে থাকা একটা পাথর নেমে গেল। মনটা এত ভালো হয়ে গেল! সিরাজকে ফোন করলাম, সারোয়ারকে ফোন করলাম। আরেফিনকে পেলাম না। তার ফোন বিজি। অনেক রাতে আরেফিনের সঙ্গে কথা হলো। বন্ধুদের মধ্যে আশ্চর্য এক স্বস্তি ফিরে এলো। জুবায়েরের অসুস্থতার কথা শোনার পর থেকে এমন অবস্থা হয়েছে আমাদের, বন্ধুরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে রোজ কথা বলছে। জুবায়েরের খোঁজখবর করছে। দেখা হলে প্রথমেই জানতে চাইছে, জুবায়ের এখন কেমন আছে? অবস্থা কি একটু ভালো? আশার কথা শুনতে চাইছে সবাই।
বলছি ২০০৮ সালের কথা। তার চব্বিশ-পঁচিশ বছর আগে জুবায়ের দেশ ছেড়েছে। ডালাসের পাশে ‘এলেন’ নামের এক শহরে থাকে। চৌদ্দ-পনেরো বছর আগে চাকরির কারণে ডালাস থেকে সিঙ্গাপুরে এসে থাকল কিছুদিন। সেই ফাঁকে দু-তিন মাস ঢাকায় এসে কাটিয়ে গেছে। তারপর আর দেশে ফেরেনি। এতদিন ধরে এত দূরে থেকেও বন্ধুদের একেবারে মাঝখানে বসেছিল জুবায়ের। এত এত বছর ধরে তার সঙ্গে দেখা হয় না, অনেকের সঙ্গে ফোনে কথা হয় না অনেক দিন, তবু জুবায়ের দখল করে আছে বন্ধুদের মনের অনেকখানি জায়গা। যেন ডালাসে না, যেন ঢাকায়ই আছে সে। আমাদের হাতের একেবারে কাছে। হাত বাড়ালেই জুবায়েরকে আমরা ছুঁতে পারছি, তার হাতটা ধরতে পারছি।
হাসনাত ভাই এক দিন ফোন করলেন, আমাদের সবার প্রিয় সম্পাদক আবুল হাসনাত। গলায় বেশ অস্থিরতা। মিলন, আপনি শুনেছেন? জুবায়ের তো ভীষণ অসুস্থ। কোমায় আছে। ভাবলাম আপনাকে খবরটা জানাই। হাবিব চলে গেল, জুবায়েরের এই অবস্থা... হাসনাত ভাইয়ের গলা ধরে এলো। আপনার সঙ্গে শেষ কবে কথা হয়েছে? সাত-আট মাস ধরে জুবায়ের আমাকে ফোন করে না। তার আগে সপ্তাহে এক দিন করতই। জুবায়ের ফোন করত সকালের দিকে। টাইমটা এমন, ঠিক ওই সময়টাতেই আমি বাথরুমে। কোনো কোনোদিন আধভেজা শরীর নিয়ে বাথরুম থেকে দৌড়ে এসেছি, কোনো কোনোদিন আধা ঘণ্টা পর সে আবার ফোন করেছে। আমি ফোন ধরতেই ধমক। ওই বেটা, এতক্ষণ বাথরুমে কী করছ? চল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিট, এক ঘণ্টা দেড় ঘণ্টা কথা বলতাম আমরা। একদিন প্রায় দুই ঘণ্টা কথা বললাম। কত কথা যে আমাদের ছিল! খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটি বন্ধুর খবর নিত জুবায়ের। সিরাজের ফোন নম্বর আমার কাছে ছিল না, জুবায়ের দিল। আমি ঢাকায় বসে যেসব বন্ধুর খবর জানি না, জুবায়ের ডালাসে বসে তাদের সব খবর রাখে। কোনো কোনোদিন ব্যস্ততার কারণে ফোন রাখতে চাইলে হা হা করে হাসত। খুব নাম হইছে, না? জুবায়েরের সেই হাসি কে আমাকে ফিরিয়ে দেবে?
জুবায়ের আমেরিকায় চলে যাওয়ার পর আমার সঙ্গে যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার দুই-তিন বছর আগ থেকেই যেন একটা গ্যাপ তৈরি হয়েছিল। আমি জার্মানিতে গেলাম ’৭৯ সালে। ’৮১ সালের অক্টোবরে ফিরে এলাম। ফেরার দিন জুবায়ের আমার জন্য এয়ারপোর্টে গিয়েছিল। সে তখন কলাবাগানে, হাবিবের বাসার কাছাকাছি বিশাল একটা ফ্ল্যাট নিয়েছে। আমি জার্মানিতে থাকা অবস্থায় শাহিনের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে। বিয়ের চিন্তা-ভাবনা চলছে। বাচ্চু ভাইদের সঙ্গে ‘এ্যাডবেস্ট’ নামে একটা এ্যাড এজেন্সি করেছে। ঢাকায় ফেরার পরদিন সিরাজ আমাকে নিয়ে গেছে পুরানা পল্টনে, এ্যাডবেস্টের অফিসে। বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো, পীযূষ, খন্দকার আলমগীর, আরেফিনের কাজিন গেলাম ফারুক, সেও এ্যাডবেস্টের একজন, জুবায়ের তার নাম দিয়েছে ‘গোলমাল ফারুক’। আমাদের খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আফজালও তখন এ্যাডবেস্টের সঙ্গে জড়িত। দুপুরবেলা হাবিব এলো, রফিক আজাদ এলেন। কস্তুরি থেকে ভাত-মাছ আনালো জুবায়ের। খাওয়া-দাওয়া আড্ডা চলল সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যাবেলা রফিক ভাই হাবিব সিরাজ আর আমি চলে গেলাম গ্রীনবারে। রফিক ভাইয়ের পকেটে সেদিন অনেক টাকা। সিরাজ হাবিবও কন্ট্রিবিউট করল। শুধু আমাকে পকেটে হাত দিতে দিল না। কারণ আমি এতদিন পর দেশে ফিরেছি। আদর করে বন্ধুকে ওরা খাওয়াবে।
শুরু হলো খাওয়া-দাওয়া। বন্ধুদের পেয়ে, এতদিন পর দেশে ফিরেছি, আনন্দ উত্তেজনায় আমার কোনো হিসাব নেই। রাত ১২টার দিকে আমি বেসামাল। হাবিব খুবই নিয়ম মেনে চলা মানুষ। ১০টার দিকে চলে গেছে। রফিক ভাই থাকেন রায়ের বাজার, আমি আর সিরাজ পুরান ঢাকায়। সিরাজ নারিন্দার বেগমগঞ্জে, আমি গেন্ডারিয়ায়। রফিক ভাই টলতে টলতে, সিগ্রেট টানতে টানতে রিকশা নিয়ে চলে গেলেন। আমাকে নিয়ে ভালো বিপদে পড়ে গেল সিরাজ। এত রাতে শাহবাগের ওদিক থেকে রিকশায় নারিন্দা কিংবা গেন্ডারিয়া, কোনো রিকশাওয়ালাই রাজি হয় না। শেষ পর্যন্ত আমাকে নিয়ে জুবায়েরের কলাবাগানের ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হলো সিরাজ। রাত তখন প্রায় একটা। সেদিনই জুবায়েরের মা-বাবা এসেছেন বগুড়া থেকে। এত রাত পর্যন্ত জেগে ড্রয়িংরুমে বসে মা-বাবার সঙ্গে গল্প করছে জুবায়ের। জুবায়েরের ছোটবোন ঝর্ণাও বোধহয় সেদিন জুবায়েরের বাসায়। এই অবস্থায় আমরা দুই কীর্তিমান গিয়ে হাজির। একজনের কাঁধে প্রায় ঝুলে আছে আরেকজন। চেহারা দেখেই যা বোঝার বুঝে গেছে জুবায়ের। তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। আমাদের তো ওসব বোঝার মতো অবস্থা না। ড্রয়িংরুমের সোফায় জুবায়েরের মা-বাবার মুখোমুখি বসলাম। কথাবার্তাও বোধহয় টুকটাক দু-একটা হলো। তাঁরা দুজনেই যা বোঝার বুঝে গেলেন। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। সকালবেলা সিরাজ আমাকে ঠেলাধাক্কা দিয়ে তুলল। এই, তাড়াতাড়ি ওঠ। কিছু না বুঝে ধড়ফড় করে উঠেছি। কী রে, কী হইছে? চুপ। কথা বলিস না। আমার হাত ধরে পা টিপে টিপে জুবায়েরের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এলো সিরাজ। বাড়ির কারোরই তখন ঘুম ভাঙেনি। রাস্তায় এসে আমি বললাম, ব্যাপার কী রে? কোথায় ছিলাম আমরা? ঘটনাটা বলল সিরাজ। শুনে মাথায় হাত দিয়ে সত্যি সত্যি রাস্তায় বসে পড়লাম আমি। সর্বনাশ হয়ে গেছে। দিনটার কথা আমার পরিষ্কার মনে আছে। ২২ অক্টোবর ১৯৮১। দুপুরবেলা ফ্রেশট্রেশ হয়ে গেছি জুবায়েরের কাছে। সিরাজও আছে সঙ্গে। জুবায়ের গম্ভীর মুখে বসে আছে এ্যাডবেস্টে। হাতে সিগ্রেট। আমি নানা রকমভাবে সরি বললাম, জুবায়ের আমার দিকে তাকালোই না, কথাই বলল না। সেদিন থেকেই আমাদের সম্পর্ক শীতল হয়ে গেল। জুবায়ের তার বিয়েতে আমাকে দাওয়াতই দিল না। আমার বিয়েতে এলোই না।
সারোয়ার তখন কিছুই করছে না। হাবিব প্ল্যান করল একটা পাবলিকেশন্স করবে। আমরা চারজনেই টাকা-পয়সা দেব। হাবিব সিরাজ সারোয়ার আর আমি। জুবায়েরের কথাটা কেন যে উঠল না, মনে নেই। পাবলিকেশন্সের নামটা আমি দিলাম। ‘চারদিক’। হুমায়ূন আহমেদ, সিরাজ, সারোয়ার, আমি আমাদের একটা করে বই বেরুবে ফেব্রুয়ারি মেলায়। রবিবার পত্রিকায় জুবায়ের একটা উপন্যাস লিখেছিল ‘অসম্পূর্ণ’ নামে। একদিন পাণ্ডুলিপি নিয়ে জুবায়ের হাজির হলো হাবিবের বাসায়। সারোয়ার তখন হাবিবের বাসায়ই ছোট্ট একটা রুম নিয়ে থাকে। জুবায়েরের বইটাও বেরুল। এটা বোধহয় তিরাশি-চুরাশি সালের কথা। বাংলা একাডেমি বইমেলায় স্টল নিল সারোয়ার। আমরা সবাই সেই স্টলে বসে বই বিক্রি করি। জুবায়েরও সঙ্গ দেয় কোনো কোনোদিন। মেলার শেষ দিন, আমাদের চার বন্ধুকে তার বাসায় খেতে ডাকল জুবায়ের। ভিকারুননিসা স্কুলের উল্টোদিককার একটা সরকারি কোয়ার্টার সাবলেট নিয়েছে জুবায়ের। বেশ খাওয়া-দাওয়া আড্ডা চলছে। সেদিনই জুবায়েরের বউ শাহিনকে আমি প্রথম দেখলাম। শাহিন শহীদবাগের মেয়ে। রহমান বাবু ওদের খুবই পরিচিত। ‘চাঁদের হাট’ করত। রহমানদের মুখে শাহিনের কথা অনেক শুনেছি; কিন্তু সেদিনই প্রথম দেখলাম। জুবায়েরের বাসায় সিরাজের সঙ্গে আমার বেশ একটা মনোমালিন্য হয়ে গেল। মন খুব খারাপ হয়েছে দেখে গেন্ডারিয়ার বাসায় আমি আর ফিরলামই না। হাবিব সারোয়ারের সঙ্গে চলে গেলাম ওদের বাসায়। সারোয়ারের ছোট্ট বিছানায় দুজন মানুষের খুবই কষ্ট হয় ঘুমাতে। তবু থাকলাম। রাতে ঘুমই হলো না। সারা রাত সারোয়ার আমাকে সান্ত্বনা দিল। আহা রে, আমাদের সেসব ভালোবাসার, আবেগের দিন! তারপর কোন ফাঁকে জুবায়ের আমেরিকায় চলে গেল আমি টেরই পেলাম না। ওই যে একাশি সালের ঘটনাটি, তারপর জুবায়েরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক একেবারেই আলগা হয়ে গিয়েছিল। মাঝখানে দুই-তিন মাসের জন্য দেশেও ফিরল জুবায়ের। দু-একবার আমার সঙ্গে দেখাও হলো কিন্তু জার্মানিতে যাওয়ার আগের সেই দিনগুলোতে আর ফিরতে পারিনি। হঠাৎ করেই ফেরা হলো বিশ বছর পর। নব্বই সালে একটা ছোটদের কাগজ সম্পাদনা করি আমি। ‘কিশোর তারকালোক’। সেই কাগজে ছবি আঁকার কাজ করে দুর্দান্ত এক যুবক। লম্বা সুন্দর স্মার্ট। প্রিয়দর্শন সেই যুবকের নাম আলী আকবর। আমি আদর করে ডাকতাম ‘বালক’। আমি ‘কিশোর তারকালোক’ ছেড়ে আসার কিছুদিন পর সে স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় চলে যায়। দুই হাজার চার সালে ডালাস থেকে আলী আকবর একদিন ফোন করল। এবারের ফোবানা সম্মেলন হবে ডালাসে। বাংলাদেশ থেকে তিনজন বিশেষ অতিথিকে আমন্ত্রণ জানাতে চাচ্ছে সম্মেলন কমিটি। ‘প্রথম আলো’র সম্পাদক মতিউর রহমান, ‘যায়যায়দিন’ সম্পাদক শফিক রেহমান আর আপনি। সামনের সপ্তাহে আপনার চিঠি নিয়ে দেশে আসছি আমি। জুবায়ের ডালাসে থাকে এ কথা আমি জানি। আলী আকবর ঢাকায় আসার পর কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ডালাসে থাকো, মুহম্মদ জুবায়েরকে চেন? আলী আকবর লাফিয়ে উঠল। জুবায়ের ভাইকে চিনব না? তার সঙ্গে আমার মহা খাতির। শাহিন আপা আমার আপন বোনের মতো। ডোরা আমাকে মামা ডাকে। আপনে আসেন ডালাসে। খুব মজা হবে।
ডালাসে ‘মাইক্রোটেল ইন’ নামের এক হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। এয়ারপোর্ট থেকে ফোবানার সেবারের কনভেনার মবিনের বাড়িতে গেছি। খেয়েদেয়ে যে হলে অনুষ্ঠান হবে সেই হলের কাছাকাছি একটা জায়গায় নিয়ে গেল মবিন। গিয়ে দেখি আল মনসুর, মানে আমাদের বেলাল ভাই বেশকিছু ছেলেমেয়ে নিয়ে রিহার্সেল করছেন। তার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত ৩টা। হোটেলটা লিজ নিয়ে চালায় দুজন বাঙালি যুবক। ফোবানা উপলক্ষে আমেরিকার বিভিন্ন স্টেট থেকে বাঙালিরা এসে এ হোটেলেই উঠেছে। বিদেশের কোনো একটা হোটেলে একসঙ্গে এত বাঙালি আমি কোনোদিন দেখিনি। রাত ৩টায়ও গম গম করছে হোটেল। এত ক্লান্ত লাগছিল! রুমে গিয়ে কোনোরকমে জামাকাপড় খুলে একটা ট্রাউজার পরেছি। তারপরই বিছানায়। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি কে জানে। ঘুমের ভিতর থেকে শুনি ডোরবেল বাজছে। একবার, দুবার। কোনোরকমে ঘুমচোখে দরজা খুলেছি। দেখি হাফপ্যান্টের ভিতর টিশার্ট ইন করা, পায়ে এডিডাসের সাদা কেডস পরা টেনিস প্লেয়ারের মতো দেখতে এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে বলল, চিনতে পারছ? মুহূর্তে ঘুমভাব কেটে গেল আমার। জুবায়ের!
আমরা দুজন দুজনার গলা জড়িয়ে ধরলাম। মুহূর্তে পার হয়ে গেল বিশ বছর সময়কাল। পরদিন থেকে শুরু হবে দুদিনব্যাপী ফোবানা সম্মেলন। একটা দিন হাতে আছে। জুবায়ের বলল, চল, আগে কোথাও নাশতা করি, তারপর তোকে ডালাস দেখাই। এ হোটেলেই তো ব্রেকফাস্ট দেবে। আরে রাখ তোর ব্রেকফাস্ট। এ গয়রাহ ব্রেকফাস্টে পোষাবে না। তাড়াতাড়ি রেডি হ। পার্কিংলটে দাঁড়িয়ে আছে জুবায়েরের কালচে সবুজ বিশাল গাড়ি। পাজেরোর মতো দেখতে। আমাকে নিয়ে সেই গাড়িতে চড়ল জুবায়ের। কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে গেছি। দেখি আমাদের বিখ্যাত গায়ক জেমস তার একদল ভক্ত নিয়ে নাশতা করছে। আমাকে অনেক দিন পর দেখেছে জেমস। বলল, আপনের গোঁফ কই? জেমসের কথায় জুবায়েরও যেন খেয়াল করল, আমার গোঁফ নেই। বলল, কবে ফালাইছস? ফালাইয়া ভালো করছস। এখন একটু মানুষের মতন লাগে। সেদিন সারাটা দিন জুবায়ের আমাকে নিয়ে ঘুরল। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে বলল, ল তোরে জে আরের কবর দেখাইয়া আনি। আমি অবাক হয়ে জুবায়েরের মুখের দিকে তাকালাম। জে আর টা কে?
জুবায়ের হা হা করে হাসল। ‘ডালাস’ নামে বিখ্যাত একটা সিরিয়াল হয়েছিল আমেরিকায়। আমাদের বিটিভি সিরিয়ালটা দেখিয়েছে। ওই সিরিয়ালের একটা চরিত্রের নাম ছিল ‘জে আর’। ‘সাউথফোর্ক রেঞ্চ’ নামে ডালাসের একটা জায়গায় শুটিং হয়েছিল। অথবা জে আর-এর বাড়ি হিসেবে দেখানো হয়েছিল জায়গাটা। আমেরিকানরা ব্যবসা ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। পৃথিবীব্যাপী ‘ডালাস’ তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে দেখে সিরিয়াল শেষ হওয়ার পর বাড়িটাকে মিউজিয়াম বানিয়ে ফেলেছে। চার ডলার টিকিটের দাম। টুরিস্টরা ডালাসে এলে সাউথফোর্ক রেঞ্চটা একবার ঘুরে যায়। টুকটাক স্যুভেনির কিনে নিয়ে যায়। জুবায়ের ওটার নাম দিয়েছে ‘জে আর এর কবর’।
গেলাম ওই জিনিস দেখতে। কিছুক্ষণ ঘুরেটুরে আঠারো ডলার দিয়ে জুবায়ের আমাকে একটা টেবিলঘড়ি কিনে দিল। জে আর-এর বাড়িটার ছবি আঁকা চৌকো, ছোট্ট একটা হার্ডবোর্ডের মাঝখানে ঘড়ির কাঁটা। কোনো নম্বর নেই। অর্থাৎ কাঁটা দেখে অনুমান করতে হবে, কটা বাজে। নিচে লেখা ‘সাউথফোর্ক রেঞ্চ ডালাস টেক্সাস’। [চলবে]
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রধান সম্পাদক, কালের কণ্ঠ