আত্মহত্যা একটি দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ সূচক। এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি অন্যতম ঝুঁকি। প্রতিটি আত্মহত্যার সুদূরপ্রসারী সামাজিক, মানসিক এবং অর্থনৈতিক পরিণতি রয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী ব্যক্তি ও সম্প্রদায়কে এই প্রবণতা গভীরভাবে প্রভাবিত করে। প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনা রাষ্ট্র বা সমাজকে এই বার্তা দিয়ে যায় যে, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, অনাচার, দুনীতি- সবকিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার ব্যর্থতা। বন্ধনহীন পারিবারিক সম্পর্ক, শঠতা, সন্তানের প্রতি উদাসীনতা তাদের বিতৃষ্ণা করে তোলে। ফলে তাদের ভিতর দানা বাঁধে ক্ষোভ, বিষণ্নতা এবং একাকিত্বের যন্ত্রণা। যার পরিণতি আত্মহত্যা। নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যার উদ্ভব ঘটে সমাজের আদর্শহীনতা থেকে যেখানে ব্যক্তির ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষা পরিপূরণের উপায়গুলো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
পরিসংখ্যান বলে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর নাকি প্রায় ৭ লাখেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। মানুষ কেন আত্মহত্যা করে এই জটিল প্রশ্নের কোনো যৌক্তিক জবাব হয়তো নেই। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বংশগত ছাড়াও বিভিন্ন কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে। এর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা, অপমান এবং সামাজিক বৈষম্য অন্যতম। মোটাদাগে বলা যায়, মানসিক সমস্যা, উদ্বেগ ও হতাশার মতো সংকটগুলো একজন মানুষকে যখন মনোদৈহিকভাবে বিপর্যস্ত করে দেয়, তখন তার কাছে মনে হয় বেঁচে থাকা অর্থহীন। এই দুরপনেয় মনোবৈকল্য তাকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। অথচ এই সংকটময় পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে তার পরিবার ও আস্থাভাজন কাছের লোকজন।
গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার চাপ এবং ব্যর্থতার কারণে আত্মহত্যা একটি দেশের শিক্ষা কাঠামোকে প্রতিফলিত করে। বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন এ বছর তাদের সর্বশেষ জরিপে বলছে, দেশে গত এক বছরে আত্মহত্যা করেছে ৫১৩ জন শিক্ষার্থী। যাদের মধ্যে ৬০ ভাগেরও বেশি নারী শিক্ষার্থী। আরও উদ্বেগের বিষয়, যারা আত্মহত্যা করেছে তাদের মধ্যে ৪৪ ভাগেরও বেশি স্কুল শিক্ষার্থী। এর মধ্যে প্রায় ১০ ভাগ মানসিক সমস্যার কারণে এই পথ বেছে নিয়েছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ গবেষণা বলছে কিশোর-কিশোরীদের প্রায় ১৩ ভাগ মানসিক রোগে আক্রান্ত। চূড়ান্ত হতাশা থেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তারা। এর পেছনে অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক কারণ আছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের যে অস্থিরতা, যারা এসব নিতে পারে না তারাই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বা পড়া শেষ করেছে তাদের ওপর পরিবারের চাপ আছে চাকরি বা কর্মসংস্থানের। সমাজও তাদের নানা কথা বলে।
বিশ্বখ্যাত ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় এশিয়ার দেশগুলোতে তরুণদের ব্যর্থতার কারণে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি। এর মধ্যে বাংলাদেশে ২৫% শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়ার আগেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। এ নিয়ে ল্যানসেট আরও বলছে, পরীক্ষায় ব্যর্থতা আত্মহত্যার পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া নিম্ন আত্মসম্মান, উচ্চপ্রত্যাশা, আবেগপ্রবণতা, শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের ইতিহাস, শেখার এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা। অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন এবং অতি উচ্চাকাক্সক্ষী পিতামাতা, কর্মহীন পরিবার, সমালোচনা, সমবয়সিদের সঙ্গে তুলনা এবং পরিবারে সমর্থনের অভাব, মদ্যপান, সহিংসতা, পরিবারে মানসিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায়।
প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষ স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করে, যা আত্মহত্যা নামে বিবেচিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা ক্রমে বাড়ছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারার কারণে দুশ্চিন্তা এবং ব্যর্থতা ক্রমে বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয়; যার চূড়ান্ত পরিণতি আত্মহনন। ক্রমবর্ধমান এ প্রবণতা ঠেকাতে সামগ্রিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন। বাংলাদেশে এখন মোট জনগোষ্ঠীর ১৮ ভাগ মানসিক রোগে ভুগছে। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ওই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের ৪৮ দশমিক ৪ ভাগ মানসিক রোগী। বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগ ৩৪৭ জন রোগীর ওপর গবেষণা করে ওই তথ্য প্রকাশ করেছে। ওই রোগীদের মধ্যে ১৬৮ জন কোনো না কোনোভাবে মানসিক রোগে ভুগছিলেন। মানসিক রোগে আক্রান্ত ৯২-৯৪ শতাংশ রোগী চিকিৎসা নেন না, ফলে আত্মহত্যা বাড়ছে। তবে আত্মহত্যার পেছনের কারণগুলো যদি চিহ্নিত করা যায় এবং মনের স্বাস্থ্যের পরিচর্যা করা যায়, তাহলে আত্মহত্যার একটা বড় অংশ প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানসিক চাপই কাউকে কাউকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। আমাদের দেশে আত্মহত্যা ফৌজদারি অপরাধ ও পাপ হিসেবে গণ্য করা হয়। ফলে কারও মধ্যে কোনো কারণে আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগলেও ভয়ে সে তা প্রকাশ করেন না। তাই এখন প্রয়োজন আইন ও মানসিকতার পরিবর্তন।
লেখক : গবেষক