সময়ের প্রতিটি ক্ষণে প্রকৃতি পরিবর্তিত হচ্ছে। জলবায়ুগত পরিবর্তন ঘটেই চলেছে। তার প্রভাব পড়েছে দেশের বিস্তর জলাভূমি এবং জলজ প্রাণীর ওপর। যে কারণে উৎপাদনগত পরিবর্তনের প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। রেহাই পায়নি পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনা নদীর জলজ প্রাণী, বিশেষ করে অহংকারের ইলিশও। জলবায়ুর পরিবর্তনে বেড়েছে উষ্ণায়ন, অসময়ে বন্যা, বৃষ্টিপাতের হার। অন্যদিকে অনাবৃষ্টি এবং খরার প্রভাব তো আছেই। প্লাস্টিক-পলিথিনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। মিষ্টি জল গ্রাস করছে নোনা জল, ঝড় জলোচ্ছ্বাসের প্রকট প্রভাব। শৈত্যপ্রবাহ।
নদীতে মিশছে মনুষ্য ও শিল্প বর্জ্য। যে জলের জন্য নদী পুষ্টিবান, সেই জলে আজ বিষ এবং পলিথিন-প্লাস্টিকের স্তূপ। জলজ প্রাণিকুলের জন্য নিরাপদ নয় নদী। এর সঙ্গে দখল ও বালু উত্তোলনে ক্ষতবিক্ষত নদীর বুক। আরও বিস্ময়কর হলো বিশাল নদীর জলে মশারির মতো বিছিয়ে রাখা অবৈধ ও নিষিদ্ধ জালের বিস্তার। এর কুপ্রভাব পড়েছে মাছের নিরাপদ বাসস্থানের ওপর। জীবনযাপন ও বংশ বিস্তারের ওপর। এসব জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে ইলিশের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। যা এ মাছের জাতের পরিবর্তন আনতে বাধ্য করেছে। যুগের ধারা পাল্টেছে। দাবদাহ, শৈত্যপ্রবাহ ইতোমধ্যে রেকর্ড ভেঙেছে।
বিজ্ঞানীদের ভাষায় এই যুগ হলো ‘অ্যানথ্রোপসিন।’ মানুষের বুদ্ধি এবং শক্তি, জলবায়ু, অনাবৃষ্টি এবং বাস্তুতন্ত্র ক্ষয়ের জন্য ব্যবহার হয়ে আসছে। মানুষের ভোগ এবং লোভের কারণে প্রকৃতির সম্পদ প্রতিনিয়ত নিঃশেষের দিকে এগোচ্ছে।
আমরা পাঁচ প্রজাতির ইলিশের সঙ্গে পরিচিত। সহজ কথায় আমাদের নাগালের মধ্যে ঘোরাফেরা করে সাধারণত পদ্ম ইলিশ, চন্দনা ইলিশ আর গুর্তা ইলিশ। এ ইলিশ মাছ চেনার জন্য নিজের চোখের পরখই যথেষ্ট। যেমন গঙ্গা-পদ্মার ইলিশের পিঠ হালকা সবুজাভ গোলাকৃতির এবং অনেকটা পুতুলের মতো। মাথা খাটো এবং চ্যাপটা হয়। শরীরটা সোনালি আভায় মোড়া। মাছের পেট ও পিঠ সমান বাঁকানো। এখানকার মাছ নাকের কাছে নিলে ইলিশের চেনা ঘ্রাণ পাওয়া যায়। চন্দনা ইলিশের পিঠ কালচে, শারীরিক গঠন ক্ষুদ্রাকৃতি, শরীর উজ্জ্বল। চন্দনা ইলিশের শরীরও গোলাপি আভায় ছড়ানো। রান্নার পর এ মাছ থেকে প্রচুর তেল বের হয়। গুর্তা ইলিশের শরীরে যথেষ্ট কাঁটা থাকে। গঙ্গা-পদ্মার ইলিশ দুই রকমের, ১. বড় ইলিশ এবং ২. খোকা বা জাটকা ইলিশ। ইলিশ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সময়ের মাছ। গঙ্গা এবং পদ্মা অববাহিকার
ইলিশের ঐতিহ্য হলো, বড় আকারের লোভনীয় ইলিশ। এ ইলিশে সাধারণত ভাদ্র মাসে পেটে ডিম আসে। ইলিশ নদীর মিষ্টি জলে ডিম ছেড়ে তা থেকে জাটকা বা খোকা ইলিশের আকার নিয়ে তারা সাগরে এগোতে থাকে। এটাই ওদের শারীরিক ক্রিয়াগত বৈশিষ্ট্য।
নদী অববাহিকার মাছ লোনা জলের ইলিশের চেয়ে স্বাদের। ইলিশের ডিম অন্য এক বিশেষ স্বাদের জন্য বিখ্যাত। পদ্মা অববাহিকার ইলিশে বেশি ডিম পাওয়া যায়। বাজারে পদ্মার ইলিশ, বরিশালের ইলিশ, চট্টগ্রামের ইলিশ, সাগরের ইলিশ, পাথরঘাটার ইলিশ, মহিপুরের ইলিশ, ভেদরগঞ্জের ইলিশ বিক্রি হয়।
নদী মরে যাচ্ছে। দেশের নদীর জলের অনবদ্য অহংকার তার মাছ আর ২১৪ প্রজাতির জলজ প্রাণী। নানা বিবর্তন ও প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে ঐতিহ্যের ইলিশ তার স্বাদ-গন্ধ-বর্ণ, স্বাভাবিক বিকাশ ধরে রাখতে পারছে না। বঞ্চিত হচ্ছে ইলিশপ্রেমী বিশ্ববাঙালি।
খুব বেশি দিন আর দেরি নেই, জলজ প্রাণীগুলোর অস্তিত্ব খুঁজতে হবে ছবিতে কিংবা জাদুঘরে। এ সমস্যা কিন্তু বাংলাদেশের একার নয়। জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের অনেক দেশের জলাধারগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। নদী এবং জলজ প্রাণী রক্ষায় ব্যাপক-বিস্তৃত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : পরিবেশবিজ্ঞানী