পুলিশ দিয়ে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে কি কারও দাবি ছিল? বা পরামর্শও দিয়েছিল কেউ? এসব প্রশ্ন না থাকলেও গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর নিজ থেকেই জানিয়েছেন, তিনি পুলিশ দিয়ে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করবেন না। তাহলে কীভাবে করবেন? পিঠে হাত বুলিয়ে? চোখের ইশারা দিয়ে? বা ঠোঁটে শিস বাজিয়ে? তা নয়, সিদ্ধান্ত হয়েছে, চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে বাজারে ডলারের দাম ঠিক হবে। ডলার কেনাবেচার দর কী হবে, তা ব্যাংক ও গ্রাহকের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থনীতির ভাষায় এটি ‘বাজারভিত্তিক’ ব্যবস্থা।
এ ব্যবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক কেবল সকাল-বিকাল প্রতিটা ব্যাংক থেকে ডলারের দামের আপডেট নেবে। নেপথ্যের খবর হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের ঋণের শর্তপূরণের অংশ হিসেবে মার্কিন ডলারের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া সংস্কারের বিষয়ে বাংলাদেশের যে সদিচ্ছা আছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সেই বার্তা দিতে ডলারের দাম ‘বাজারভিত্তিক’ করা হয়েছে-এমন যুক্তি দিয়েছেন গভর্নরের ডেপুটি মো. হাবিবুর রহমান। আর গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আরও উচ্চকিত।
মানি চেঞ্জাররা আলামত বুঝে এগোচ্ছেন। তাদের কাজ ক্যাশ ডলারের সঙ্গে। তারা অভিজ্ঞতার আলোকে বুঝে নিয়েছে, দাম একটু বাড়লে অসুবিধা নেই, বেশি বাড়লে তখন হস্তক্ষেপ করবে, পদক্ষেপ নেবে সরকার। এর আগ পর্যন্ত কী করবে? সেই জবাব নেই। জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হালকা কথার জের সইতে হয় গোটা সেক্টরকে। অর্থ সেক্টরে হালকা কথার জের ও তেজ কত ভয়ানক হয়, তা তো সেদিনের ঘটনা। একজন অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ঘুষকে ঘুষ না বলে স্পিড মানি মনে করতে। আরেকজন সরকারি কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, ঘুষ সহনীয় মাত্রায় খেতে। তবে এত কিছু বলা হলেও ঘুষের মাত্রা বা রেট ঠিক করে দেওয়া হয়নি। সরল বিশ্বাসে দুর্নীতি করলে একে দুর্নীতি বলা যাবে না- এমন সবকও শোনানো হয়েছিল গেল আমলে।
এরও আগে, আরেক অর্থমন্ত্রী বলে বসেছিলেন, ‘শেয়ারবাজার বুঝি না, কারণ ওইটা একটা জুয়াবাজি’। গুরুত্বপূর্ণ আসনে বসে এ ধরনের কলপাড় বা পুকুরের ঘাটলার আলাপের কী পরিণতি হয় তা গোটা দেশকে সইতে হয়েছে। জের আজও টানতে হচ্ছে। কেন এই কঠিন সময়েও আবার সেই মানের হালকা কথা চিবানো? ১০টি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার দশায় পড়েছে, মন্তব্য করে কী ক্যাচাল লেগেছিল হাড়ে হাড়ে মালুম করার কথা। এ কিসিমের বক্তব্যে আতঙ্কিত হয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন গ্রাহকরা। এতে সংকট আরও তীব্র হয়। এখনো সেই ক্ষত ও রেশ টানছে দুর্বল ব্যাংকগুলো। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে ঘাড়-মেরুদণ্ড আরও বেঁকে যাচ্ছে ডজনখানেক ব্যাংকের। ডলার নিয়েও এখন হালকা কথার চর্চা। আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ঘটনার পরিক্রমায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। অভিজ্ঞতা ও কমিটমেন্টের আলোকে তিনি কিছু বিষয় আইএমএফের চোখ-চশমা দিয়ে দেখবেন, তা স্বাভাবিক। তাই বলে হালকা বা বেফাঁস মন্তব্যও করতে হবে?
আইএমএফের হুকুম-আহকাম তামিল করার একটি সাধনা এ সরকারের রয়েছে। যদিও অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ গর্বের সঙ্গে দাবি করেছেন, আইএমএফ বাংলাদেশের ওপর জোর করে কোনো শর্ত চাপিয়ে দিতে পারেনি। আইএমএফের সঙ্গে লেনদেন সুখকর নয় মন্তব্য করে বাক্যের দ্বিতীয়াংশে তিনি বলেছেন, তাদের (আইএমএফের) চাপিয়ে দেওয়া কিছু নেওয়া হয়নি। বাস্তবটা ভিন্ন। বিশেষ করে ডলার প্রশ্নে। আইএমএফ পুলিশ বা ফৌজ দিয়ে কিছু করে না। কলার ধরে শর্ত পূরণ করায়। কার্যকর করিয়ে ছাড়ে।
দেশে ডলারের বিনিময় হার নিয়ে একের পর এক ‘এক্সপেরিমেন্ট’ বেশির চেয়েও বেশি হয়ে গেছে। গিনিপিগের অবস্থা। তা মুদ্রাবাজারকে করছে কেবলই অস্থির। কিন্তু সরকারের এ নীতি পদক্ষেপে তুষ্ট আইএমএফ। পিঠ চাপড়িয়ে বলছে, এসব পদক্ষেপের ফলে দেশের অর্থনীতিতে টেকসই প্রবৃদ্ধি হবে। আইএমএফ সরকারকে ব্যয় নিয়ন্ত্রণের শর্তও দিয়েছে। ফলে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে খরচ কমবে। বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় কমানো আইএমএফের আরেক শর্ত। এটি বাস্তবায়ন করতে হলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। তখন সব খাতের পণ্য ও সেবার দামও বাড়বে। আর যথা নিয়মে তা মূল্যস্ফীতিকে তো উসকে দেবেই।
আমদানি নিয়ন্ত্রণের দগদগে ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে বেসরকারি খাত। বিনিয়োগ নেই, নিয়োগ নেই। লাখের মতো নিয়োগ বরবাদ হয়ে গেছে একের পর এক কারখানার চাকা বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। এখন ডলারের বাজার নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার সমান্তরালে রিজার্ভ থেকে ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আইএমএফের ঋণ পেতে সন্তুষ্টির জন্য বাজারভিত্তিক ডলারের দাম আরও কত ভোগাবে, সেই অপেক্ষা যেন নিয়তি। তা পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে এ অবস্থা হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক কি দিব্যি বাজারে ডলারের টান পড়লে রিজার্ভ থেকে বিক্রি করে। ঘাটতি হলে বাজার থেকে ডলার কেনে। আবার বলে পুলিশ দিয়ে ডলারের কলার ধরবে না। অবস্থাটাই এমন করে দেওয়া হয়েছে, কলার ধরতে হয় না, কান ধরে টেনে মাথাই নিয়ে গেছে। ব্যাংকগুলোকে দিয়ে বলানো হচ্ছে, বাজারে পর্যাপ্ত ডলার রয়েছে, বড় কোনো পেমেন্টেও সমস্যা হবে না। শুনতে মধুর। কলার না ধরে পুলিশের মৃদু লাঠিচার্জ যেমন মিষ্টি।
অর্থনীতির টানাপোড়েনে বর্তমানে ডলারের চাহিদা কম, তাই বাজারে চাপ নেই। কিন্তু চাহিদা বাড়লে কী হবে? বিদেশি ঋণ আসার পর হরেদরে ঠিক হয়ে যাবে? সরবরাহ সীমিত হওয়ায় চাহিদাদৃষ্টে ডলারের দাম হাঁকছেন বিক্রেতারা। রিজার্ভ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না বাড়লে, আমদানি চাহিদা আবার বাড়লে কী অবস্থা হবে, তারা ভালো করেই জানেন। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আশা-দুরাশার ক্যামেস্ট্রিতে আছেন। বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে পুরোপুরি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। তবে ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারের কাছে একটি আংশিকভাবে পুনর্গঠিত অর্থনীতি দিয়ে যেতে পারবেন। এর ভরসা হবে প্রবাসী আয়, রপ্তানি ও বৈদেশিক অর্থায়ন। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ২৭ বিলিয়ন ডলার। এটি শিগগিরই ৩০ বিলিয়ন ডলারের দিকে যাবে। তখন ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ নয়, আনসারও মোতায়েন করতে হবে না।
প্রবাসী আয়ের ওপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ৫ শতাংশ ট্যাক্স কার্যকরের ধাক্কা দেশের অর্থনীতিতে পড়বে বলে একটি শঙ্কা ঘুরছে। রেমিট্যান্সে করারোপ হলে বৈধপথে প্রবাসী আয়ে টান পড়া, প্রবাসীদের হুন্ডিতে ভাঁজ খাওয়া স্বাভাবিক। তা ডলারের দামে টোকা দেবে। বিনিয়োগ-রপ্তানি, কর্মসংস্থান নয়; রিজার্ভ বাড়ানোকে বেশি দরকারি বা মুখ্য ভাবছে সরকার। সেখানে বড় ভরসা প্রবাসীরা। সামনে কোরবানি। এ সময়ে প্রচুর রেমিট্যান্স আসবে। তা রিজার্ভের অঙ্ককে আরও মোটাতাজা করবে। কাতারে বড় একটি গ্যাসফিল্ড আবিষ্কার হয়েছে। তারা বাজারে সাপ্লাই বাড়ালে গ্যাসের দাম কমে যাবে। ফলে জ্বালানি আমদানির জন্য ডলারের চাহিদাও কমবে। তার ওপর আইএমএফ, এডিবি, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ফান্ড দিচ্ছে। হিসাবের এমন সরলীকরণ বাস্তবে কতটা ফলবে, সেই অপেক্ষায় থাকাই স্বাভাবিক।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।