রক্ত অমূল্য সম্পদ, রক্তের দাম হয় না, রক্তের দাম শুধুই ভালোবাসা। এক ফোঁটা রক্ত অন্যের জীবনের নতুন ভোর, নতুন আশা ও একটি পরিবারের হাসি। রক্তের প্রয়োজন হলেই বোঝা যায়। হাসপাতালের বেডে রোগীর এখন রক্তের প্রয়োজন। হাসপাতালে ছোটাছুটি, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, পরিচিতদের এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রক্ত পাওয়ার জন্য আবেদন। নির্দিষ্ট রক্ত হলে রোগী কিছুটা সুস্থা হয়ে উঠবে, ইনশাল্লাহ। কঠিন এই মুহূর্তটা একটু স্মরণ করে দেখুন। অন্যের রক্তের প্রয়োজনে রক্ত দিয়ে সাহায্য করা মুমিন হিসেবে দায়িত্ব। যে কোনো সময়েই অন্যের রক্ত নিজের প্রয়োজন হতে পারে। তাই সুস্থা থাকাবস্থাায় অন্যকে রক্ত দিয়ে সহায়তা করা বুদ্ধিমানের কাজ। তিরমিজি শরীফে উল্লখ রয়েছে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা পৃথিবীর মানুষের প্রতি সদয় ও অনুগ্রহ হও, তাহলে আসমানের মালিক আল্লাহতায়ালা তোমাদের প্রতি সদয় হবেন।’
রক্তদান মহান কাজ। সবাই রক্তদান করতে পারে না। এজন্য বড় মনমানসিকতার প্রয়োজন। একমাত্র পরোপকারীরাই সময়, কাজ নষ্ট করে নিজে গাড়িভাড়া দিয়ে রক্তদান করেন। তাঁদের কোনো চাহিদা ও আশা থাকে না। যা মাইলস্টোনের বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের রক্তদানে বিশাল সিরিয়ালেই প্রমাণ করেছে। তাঁরা রক্তদান করে একজন রোগীর কষ্ট দূরীকরণে সুস্থা হতে সাহায্য করেছেন। একটি পরিবারের প্রয়োজন পূরণ করেছেন। যাঁরা অন্যের উপকার করে সাহায্য করে মুখে হাসি ফোটান তাঁরা খুবই ভাগ্যবান। তাঁদের এই উপকার সম্পর্কে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘এক মুসলিম অন্য মুসলিমের ভাই, সে তার ওপর জুলুম করবে না এবং তাকে অসহায় অবস্থাায় ছেড়ে যাবে না।’
যে ব্যক্তি তার কোনো মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের কষ্ট দূর করবে, আল্লাহতায়ালা কিয়ামতের দিনে তার কষ্টগুলো থেকে একটি কষ্ট দূর করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ ঢেকে রাখবে, আল্লাহতায়ালা কিয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন (বুখারি)।
রক্ত দিয়েও রক্তদাতাদের মুখে ফুটে ওঠে হাসি। রোগী ও পরিবারের হাসিতে হৃদয়ে আনন্দের ঢেউ তোলে। তবে কিছু ব্যক্তিকে রক্তদাতাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করতেও দেখা যায়। রক্তদাতাকে রক্ত দেওয়ার আগে যেভাবে গুরুত্ব ও যোগাযোগ করে রক্ত দেওয়া শেষ হলেই তার গুরুত্ব যেন শেষ হয়ে যায়। তাকে নাশতা কিংবা গাড়িভাড়া দেওয়া দূরে থাক একটু ধন্যবাদ পর্যন্তও দেওয়া হয় না। রক্তদাতারা আপনার থেকে কিছু পাওয়া কিংবা ধন্যবাদ পাওয়ার জন্য কিন্তু রক্ত দিতে আসেনি। মানুষের প্রতি ভালোবাসা রয়েছে বিধায় আপনার বিপদে সে দৌড়ে এসে রক্ত দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করেছে। রক্তদাতাদের এই ঋণ কখনো পরিশোধযোগ্য নয়। রসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞ নয়, সে আল্লাহর প্রতিও অকৃতজ্ঞ’ (আবু দাউদ)। রক্তদানে উভয়ের মুখেই হাসি ফোটে। অথচ এই রক্ত নিয়েও চলে অবৈধ রমরমা অবৈধ ব্যবসা। রক্ত নিজেদের মধ্যে থেকে ব্যবস্থাা করতে না পারলেই বিভিন্ন ঝামেলায় পড়তে হয় রোগীর পরিবারকে। তাদের অসহায়ত্বকে জিম্মি করে অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে ভেজাল ও বহুদিনের পুরোনো রক্ত নতুন বলে বিক্রি করা হয়। আবারও দেখা যায়, বিভিন্ন ভুয়া সংগঠনের নামে জরুরি ভিত্তিতে মুমূর্ষু রোগীর জন্য রক্তের প্রয়োজন বলে আবেদন করে যাচাইবাছাই ছাড়া রক্ত সংগ্রহ করে সাধারণ ফ্রিজে সংরক্ষণ করে অতিরিক্ত টাকায় বিক্রি করা হয়। যা রোগীর শরীরে প্রবেশমাত্রই ঘটে জটিলতা। জীবনমরণের এই রক্ত নিয়ে ব্যবসা করা একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে মোটেই উচিত নয়। মনে রাখা উচিত, রক্ত নিয়ে আমি ব্যবসা করছি এই রক্তের মালিক আমি নই। রক্ত আমার শরীরেও রয়েছে, আমারও পরিবার রয়েছে, আমারও রক্তের প্রয়োজন হতে পারে, আমি যদি এই রক্ত নিয়ে অসাধু উপায়ে ব্যবসা করি, আমার সঙ্গেও এমনটি হতে পারে। কেননা এই রক্ত তৈরি আমার পক্ষে সম্ভব নয়, রক্ত আল্লাহপ্রদত্ত। আল্লাহ ভালোমন্দ সবকিছুই করতে পারেন। অনেকেরই রক্ত পরিবর্তন করতে হয়। সেখানে মহান আল্লাহ আমাকে বড় নিয়ামত দান করেছেন। তাই রক্ত নিয়ে কোনো ধরনের দুর্নীতি করা থেকে সর্বদাই দূরে থাকতে হবে। উপমহাদেশের প্রখ্যাত ফকিহ আল্লামা মুফতি শফি (রহ.) ‘জাওয়াহিরুল ফিকহ’ গ্রš’ লেখা অনুযায়ী,’ বিনামূল্যে পাওয়া না গেলে রোগীর অবস্থাা অনুযায়ী মূল্য দিয়ে রক্ত ক্রয় করতে পারবে। তবে যে রক্ত দেবে তার জন্য রক্তের বিনিময় নেওয়া ঠিক নয়।’ রক্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য বিশেষ দান। এজন্য প্রয়োজন অনুযায়ী রক্তদানে উৎসাহ প্রদান করতে হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর যে মানুষের প্রাণ বাঁচাল, সে যেন তামাম মানুষকে বাঁচাল’ (সুরা মায়েদা-৩২)।
লেখক : ইসলামিক গবেষক