শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

দর্শক সংকটে মঞ্চনাটক

মোস্তফা মতিহার

দর্শক সংকটে মঞ্চনাটক

চলচ্চিত্রের মতো দুর্দিন এখন মঞ্চ নাটকেও। অভিনয়ের পাঠশালা বলে খ্যাত মঞ্চনাটক বিচ্যুত হয়ে পড়েছে ঐতিহ্য থেকে, ভুগছে দর্শক সংকটে। বিশ্বনাটকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মঞ্চনাটক সর্বশ্রেষ্ঠ হলেও ধীরে ধীরে তা বিলীন হতে চলছে দর্শকশূন্যতায়। মানের দিক থেকে এখনো এ দেশের নাটকের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া হলেও গ্রহণের কাল যেন ছাড়ছেই না মঞ্চনাটককে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে মঞ্চাঙ্গনের নাট্যকর্মীদের অবদান নিঃসন্দেহে ছিল প্রশংসনীয়। কিন্তু সেই ঐতিহ্য আর নেই। বড় দলগুলোর কিছু নাটক ছাড়া দর্শক সমাগম ঘটছে না। বিদেশি নাট্যকার মলিয়েরের হাস্য-রসাÍক নাটক বলে ‘কঞ্জুস’র প্রতি দর্শকদের আগ্রহে ভাটা পড়েনি। আর বিশ্বকবির ‘রক্তকরবী’ নাটকটি দেখতে দর্শকরা আসছেন শুধু তারকাকেন্দ্রিক অভিনয়শিল্পীদের কারণে। মানের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও দর্শকরা কেন আসছেন না এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে নাট্যকর্মীদের মনে। জমকালো ও বর্ণাঢ্য উৎসবের মধ্য দিয়ে নাটকের দলগুলো তাদের প্রযোজনাকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করার পরও দর্শকদের উপস্থিতি আশানুরূপভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে গর্ব করার এই অঙ্গনটি বিলুপ্ত হতে বেশি সময় লাগবে না বলেই ধারণা নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। অনেক নাট্যকর্মী জানিয়েছেন, মঞ্চনাটকের অঙ্গন রাজনৈতিক কলুষতায় কলুষিত হওয়ার পর এই অঙ্গনের প্রতি দর্শকদের আগ্রহ অনেকটা কমে গেছে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে ১৯৭২ সালে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের ‘বাকী ইতিহাস’ নাটকটির মধ্য দিয়ে দর্শনীর বিনিময়ে এ দেশে প্রথম নাটকের মঞ্চায়ন শুরু হয়। বেইলী রোডের মহিলা সমিতি মিলনায়তনে ওই সময় এ নাটকটি মঞ্চায়ন হয়। দর্শক সমাগম ও নাটকের দলের বৃদ্ধির কারণে পরবর্তীতে গাইড হাউস মিলনায়তনেও শুরু হয় নাটকের মঞ্চায়ন। ‘বাকী ইতিহাস’ থেকে শুরু করে অর্থাৎ ৭২ থেকে নব্বই দশকের শেষ দিক পর্যন্ত স্বর্ণালি দিন ছিল মঞ্চাঙ্গনে। ২০১১ সালে নাটকের ইতিহাস সমৃদ্ধ বেইলী রোডের মহিলা সমিতি মিলনায়তনটি বন্ধ হওয়ার পর নাট্যাঙ্গনে দেখা দেয় অশনি সংকেত। মহিলা সমিতির মঞ্চটি ভাঙার পর নাট্যাঙ্গনের মানুষের মাঝে নেমে আসে রাজ্যের হতাশা। নতুন মঞ্চ শিল্পকলা একাডেমিতে দর্শকরা নাটক দেখতে আসবে কিনা, এলেও বেইলী রোডের মহিলা সমিতি কিংবা গাইড হাউসের মতো দর্শক সমাগম এতটা ঘটবে কিনা এমন দ্বিধা-দ্ব›দ্ব কাজ করছিল নাট্যাঙ্গনের মানুষের মাঝে। নাট্যকর্মীদের দ্বিধা-দ্ব›দ্ব শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়েছে। কারণ মহিলা সমিতি আর গাইড হাউসের মতো দর্শকরা আসছেন না শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তনগুলোয়। স্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মান কমেনি, শুধু কমেছে দর্শক। এ নিয়ে নাট্যকর্মীদের মাঝে রয়েছে নানা ধরনের জিজ্ঞাসা ও হতাশা।

নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, যানজটের কারণেই নাটকের দর্শক কমে গেছে। এ ছাড়া নাটকের মান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। তার মতে, নাটকের দল ও সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও নাটকের মান এখন আর আগের জায়গায় নেই। যার কারণে দর্শকরা এখন আর মঞ্চনাটকের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

গ্র“প থিয়েটার ফেডারেশনের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল ঝুনা চৌধুরী বলেন, ট্রাফিক জ্যামের কারণে কর্মদিবসগুলোতে দর্শক কম থাকে, তবে শুক্রবার, শনিবার ও বিভিন্ন ছুটির দিনগুলোতে দর্শকদের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। তবে তিনি এটাও স্বীকার করেন, নানা ব্যস্ততায় দর্শকরা আগের মতো পরিবার-পরিজন নিয়ে নাটক দেখতে আসছেন না। আর মানসম্মত না হওয়ার কারণে অনেক নাটকে দর্শক সংকট থাকে বলেও তিনি মনে করেন।

ঢাকা ড্রামার অধিকর্তা ম. আবু হারুন টিটো বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজধানী ঢাকার যানজটের কারণে দর্শকরা এখন আর মঞ্চনাটক দেখতে আসছেন না। এ ছাড়া ঘুরে ফিরে একজাতীয় দলগুলো হল বরাদ্দ পাচ্ছে আর একই নাটক মঞ্চায়ন হচ্ছে বলে ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও অনেক দর্শক ফেরত যাচ্ছেন। কারণ একটি নাটক একবার দেখার পর একজন দর্শক সেই নাটকটি দ্বিতীয়বার দেখতে চাইবেন না। নাটকে নতুনত্ব নেই বলে এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ থিয়েটারের অধিকর্তা খন্দকার শাহ আলম বলেন, দীর্ঘদিন যাবৎ ঘুরে ফিরে পুরনো দলগুলোই শুধু নাটক মঞ্চায়ন করছে। যার মধ্যে বেশির ভাগ নাটকই দর্শকরা মহিলা সমিতি ও গাইড হাউস থেকে শুরু করে শিল্পকলা একাডেমির হলগুলোতে দেখছে। বৈচিত্র্য নেই বলে অর্থাৎ নতুন প্রযোজনার সংখ্যা কম বলে দর্শক উপস্থিতি কমে যাচ্ছে। টিভি চ্যানেলগুলোয় মঞ্চনাটকের প্রচার খুব কম বলে নাটকের ওপর সেই প্রভাবটা পড়ছে।

বহুবচন থিয়েটারের তৌফিকুল হাসান বলেন, যানজটের কারণে দর্শকরা এখন আর নাটক দেখতে আসছেন না। কারণ শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক দেখতে আসতে হলে দর্শকদের এক দিন সময় বের করতে হয়। বর্তমান ব্যস্ততার যুগে এক দিন সময় বের করা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। রাজধানীর উত্তরা, গুলশান, বনানী ও মিরপুরে বিশাল জনগোষ্ঠী বাস করে কিন্তু সেখানকার মানুষ এত যানজটের মধ্য দিয়ে শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক দেখতে আসবেন না এটাই স্বাভাবিক। দর্শকদের ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও শুধু যানজটের কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। রাজধানীর উত্তরা, গুলশান, বনানীর মতো জনবহুল এলাকাগুলোতে মঞ্চ তৈরি করা হলে দর্শকরা আগের মতো নাটক দেখা শুরু করবেন। এ ছাড়া বর্তমানে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোর আধিক্যও মঞ্চনাটকের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। একুশটা চ্যানেলে নিয়মিত নাটক ও চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে বলে দর্শকরা মঞ্চের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। আগে চ্যানেল কম ছিল বলে মঞ্চে দর্শক বেশি হতো, এখন চ্যানেল বৃদ্ধির কারণেও দর্শক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর