‘সিনেমা হলের ভিতরে প্রবেশ করলে এখন দুই চোখ বেয়ে শুধু অশ্রু ঝরে। এমন দুরবস্থা কখনো দেখিনি। প্রজেক্টরসহ সব মেশিন নষ্ট হয়ে গেছে। সিট ঘুণপোকায় খাচ্ছে। লোহার কাঠামোতে জং ধরেছে। আমার মতো অনেকেরই প্রিয় এই সিনেমা হলের এমন দৈন্যদশায় সিনেমা হল মালিকরা এখন কাঁদছে, হাহাকার করছে। কী করব বুঝতে পারছি না। হয়তো সিনেমা হলের ব্যবসা আর টিকিয়ে রাখা গেল না।’ এই কান্না আর আর্তনাদ যশোরের শার্শায় অবস্থিত ময়ূরী সিনেমা হলের কর্ণধার আশরাফুল বাবুর। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ময়ূরীর ছিল একসময় রমরমা অবস্থা। দর্শকমুখর হয়ে থাকত ৭০০ আসনের এই সিনেমা হলটি। কর্ণধার বাবু আক্ষেপ নিয়ে বলেন, সরকারের কাছে চেয়ে আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। এই শিল্পের আর সবদিকে নজর দিলেও সিনেমা হল রয়ে গেছে সরকারের কাছে চরম অবহেলিত। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবির অভাবে সিনেমা হলের অস্তিত্ব এদেশে থাকবে কিনা তাতে সন্দেহ রয়েছে। তিনি জানান, করোনার কারণে সিনেমা হল বন্ধ থাকলেও প্রতি মাসে স্টাফদের বেতনসহ নানা খরচ বহন করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।
করোনাভাইরাসের কারণে সরকারি নির্দেশে ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে সিনেমা হল। বেশির ভাগ বন্ধ সিনেমা হলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্বাভাবিকভাবেই বেতন বা ভাতা পাচ্ছেন না। বলাকা হলের অন্যতম ব্যবস্থাপক শাহিন জানান, এখন পর্যন্ত তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিয়ে যাচ্ছেন। তার কথায় হলের ব্যবসা হয় মাসে ২-৩ লাখ টাকা, কিন্তু বেতন দিতে হয় ৬ লাখ টাকার বেশি। ঈদ মৌসুম বা খুব হিট ছবি ছাড়া প্রতি মাসে ভর্তুকি দিতে হয়। সেটা মার্কেটের ভাড়া থেকে অ্যাডজাস্ট করা হয়। মধুমিতা সিনেমা হলের অন্যতম কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ জানান প্রতি মাসে স্টাফ বেতনসহ নানা খরচ চালাতে লাখ টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে তাকে। করোনাকাল কাটলেও ছবির অভাবে সিনেমা হল চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। প্রয়োজনে ভারতের ছবি একই সঙ্গে এখানে মুক্তির ব্যবস্থা করলে অথবা যৌথ প্রযোজনা নিয়মিত হলে কিছুটা হলেও আশার আলো দেখা যেতে পারে। প্রদর্শক সমিতি জানায়, দেশে থাকা ষাটটির মতো সিনেমা হল স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বেশির ভাগ হল কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের বেতন নিয়মিত দিতে পারছেন না। রায়েরবাজারের মুক্তি সিনেমা হলে কাজ করেন ২২ জন কর্মচারী। হলটির ব্যবস্থাপক শহিদুল্লাহ বলেন, বেতন কীভাবে চালিয়ে যাবে সেই চিন্তায় অস্থির কর্তৃপক্ষ। মিরপুরের পূরবী হলের ম্যানেজার পরেশ জানান, তাদের হলে মোট ৩২ জন কর্মচারী কাজ করেন। তার কথায় ব্যবসা না থাকলে মালিকের পক্ষে বেতন দেওয়া কীভাবে সম্ভব? রংপুরের শাপলা হলের ম্যানেজার কামাল হোসেন বলেন, ভবিষ্যতে হল খুললেও দর্শক আসবে বলে আমার মনে হয় না। এ হলে ২২ জন কর্মচারী ফুলটাইম চাকরি করেন। যশোরের মণিহার প্রেক্ষাগৃহের হিসাবরক্ষক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘আমরা ৩২ জন কাজ করি। মালিকপক্ষ ভর্তুকি দিয়ে হল চালাত। বেতন দেওয়া হতো আমাদের মার্কেট, আবাসিক হোটেল ও কমিউনিটি সেন্টারের আয় থেকে। এখন তাও প্রায় বন্ধ। চট্টগ্রামের সিনেমা প্যালেসে কাজ করেন ১৫ জন, ঝুমুর হলে ১২ জন। তাদেরও নিয়মিত বেতন দেওয়া যাচ্ছে না বলে জানান প্রেক্ষাগৃহ দুটির ম্যানেজার সাইফ হোসেন।
লোকসান গুনে বন্ধ করে দেওয়া ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল ‘অভিসার’-এর কর্ণধার সফর আলী ভূঁইয়া উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, প্রতি মাসে ৪-৫ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়। এভাবে আর কতদিন। তাই বাধ্য হয়ে মার্চ মাস থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হাজার আসনের অভিসার। সফর আলী জানান, একসময় এটি ছিল উন্নত জীবন ধারণের ব্যবসা। মাসে কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা নিট মুনাফা হতো। হঠাৎ চলচ্চিত্রের মানে ধস নামলে দর্শকের অভাবে বছরের পর বছর শুধুই লোকসান গুনে যাচ্ছি। পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবির অভাবে করোনা শেষ হলেও সিনেমা হলের ব্যবসা কেউ চালিয়ে যেতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। সরকার চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণা করলেও ‘সিনেমা হল’ শিল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ঢাকার আজাদ সিনেমা হলের কর্ণধার কলিমুল্লাহর উদ্বেগ আরও তীব্র। তার কথায় ২৫ জনের মতো স্টাফ আর বিদ্যুৎ বিলসহ যাবতীয় লাখ লাখ টাকার খরচ আর কতদিন এভাবে বেকার বসে বসে চালাব। ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত স্বনামধন্য এই সিনেমা হলটি গত ৫ মাস বন্ধ থাকায় এর সব যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, আসন সবই নষ্ট হয়ে গেছে। সিনেমা হল কখনো খুললে এসব সংস্কারের টাকা কোথায় পাবেন তিনি জানেন না। সরকারের কাছে সিনেমা হলের জন্য কোনো সহযোগিতা চেয়ে কখনো পাওয়া যায়নি বলেও তার ক্ষোভ। দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়ায় অবস্থিত হাজার আসনের বিখ্যাত সিনেমা হল ‘উর্বশী’র অস্তিত্ব এখন বিলীনের পথে বলে জানান এর কর্ণধার খুরশিদ আলম। তিনি উদ্বেগের সঙ্গে বলেন, সিনেমা হলের মেশিন থেকে শুরু করে সবকিছুই তো দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকতে থাকতে নষ্ট হয়ে গেছে। ১৫ জন স্টাফকে স্বল্প পরিমাণে বেতন দিচ্ছি। প্রতি মাসে প্রায় আড়াই লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে। সিনেমা হল বন্ধ করে এখানে গোডাউন বা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করলে এই দুর্দশা থেকে মুক্তি পেতাম। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দেশে মানসম্মত সিনেমা নির্মাণ হয় না। যদি কলকাতার সঙ্গে নিয়মিত যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ হয় তাহলে সমৃদ্ধ বাজেটের কারণে মানসম্মত সিনেমা নির্মাণ হবে আর এতে দর্শক সিনেমা হলে ফিরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। তিনি সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘আগে সিনেমা হল বাঁচান, সিনেমা হল বাঁচলে সিনেমা শিল্প বাঁচবে। না হলে এই শিল্পের অস্তিত্ব বলে আর কিছুই থাকবে না।’
খুরশিদ আলমের কথায় সিনেমা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শিল্পী-কলাকুশলী, নির্মাতারা বড় পর্দায় কাজ না থাকলেও ছোট পর্দা বা এখনকার নানা ওয়েব প্লাটফরমে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেন কিন্তু সিনেমা হল মালিকদের তো আয়ের আর কোনো পথ নেই। তাই তারা সবচেয়ে বেশি মানবেতর জীবনযাপন করছেন। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির কর্মকর্তা মিয়া আলাউদ্দিন বলেন, সারা দেশেই হল মালিকরা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিল দিতে পারছেন না। এ অবস্থায় তারা সরকারি সহায়তার দিকে তাকিয়ে আছেন। মিয়া আলাউদ্দিন আরও বলেন, মার্চে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বন্ধ হওয়ার আগে যে হলগুলো চালু ছিল তার তালিকা উপজেলার ইউএনও ও জেলা প্রশাসকের কাছে রয়েছে। সেই তালিকা অনুযায়ী যেন কর্মচারীদের বেতন বা সহায়তা প্রদান করা হয়। না হলে বর্তমানে চালু থাকা প্রায় ৬২টি সিনেমা হল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন মালিকরা।