বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা
অস্তিত্ব সংকটে যাত্রাপালা

ভিন্ন পেশায় অধিকাংশ মালিক-শিল্পী

ভিন্ন পেশায় অধিকাংশ মালিক-শিল্পী

১৯৪১-৪২ সালে নবীনগরের বিদ্যাকূট গ্রামে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রাদলের সূচনা হয়। এরপর আরও অনেক দলের সৃষ্টি হয়। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এ দলগুলো সক্রিয় ছিল। ১৯৩৬-৩৭ সালে কলকাতা থেকে যাত্রাদল এসে নিয়াজ মাঠে যাত্রা করত। হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চলে যাত্রা হতো। মূলত দুর্গাপূজার সময়কালটিই হলো যাত্রা মঞ্চায়নের মৌসুম। যাত্রাপালার বর্তমান চালচিত্র নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

শিল্পকলার শৈথিল্য রয়েছে : মিলন কান্তি দে (যাত্রা গবেষক নির্দেশক)

অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যাত্রাপালার বর্তমান পরিস্থিতি শুধু অনুভব করা যায় কিন্তু এর দুর্দশা লাঘব করা যায় না। যাত্রাপালার সঙ্গে যুক্তরা যে কী পরিমাণ মানবেতর জীবনযাপন করছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এ অবস্থার উত্তরণে গত এপ্রিলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির কাছে অনুদানের আবেদন করলে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী ব্যক্তিগতভাবে প্রায় ৬০ জন যাত্রাশিল্পীর প্রত্যেককে ১ হাজার টাকা করে আর্থিক অনুদান দেন। পরবর্তীতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুদানের আবেদন করা হলে গত ১১ এপ্রিল মন্ত্রণালয় প্রায় ২০০ শিল্পীর প্রত্যেককে ৫ হাজার টাকা করে আর্থিক অনুদান দেয়। এর মধ্যে ৯০ জনই ছিল ঢাকার। বাইরের শিল্পীরা যথাযথ প্রক্রিয়ায় আসতে না পারায় তারা অনুদান প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। বর্তমানে যাত্রাপালার মালিক-শিল্পীর সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। এমনিতেই যাত্রাপালার অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে নানা কারণে স্থবির হয়ে আছে। তার ওপর এবার করোনা মহামারীর কারণে যাত্রাদলগুলো সংগঠিত হতে পারেনি। শিল্পকলা একাডেমি এবার অনলাইন যাত্রাপালার উদ্যোগ নিয়েছে। এতে যাত্রাপালার সার্বিক কোনো উন্নয়ন হবে না। শিল্পকলাকে এই শিল্প এবং সংশ্ল্ষ্টিদের রক্ষায় যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। এ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরেই শিল্পকলা একাডেমির পেশাগত শৈথিল্য রয়েছে, যা দুঃখজনক। যাত্রাপালার মৌসুম আগামী অক্টোবরে। সীমিত পরিসরে যাতে নির্ধারিত সময় রাত ১১টা পর্যন্ত যাত্রাপালা মঞ্চায়ন করা যায় সরকারের কাছে সেই অনুমতি চাই। এতে যাত্রাশিল্পে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরবে।

 

যাত্রাশিল্প-সংশ্লিষ্টরা ভিন্ন পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন : এম মজিদ (সাধারণ সম্পাদক, যাত্রা পালাকার পরিষদ)

যাত্রাপালা অনেক আগেই দৈন্যদশার কবলে পড়েছে। ফলে এর সঙ্গে যুক্তরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বাধ্য হয়েই ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছেন অনেকে। এ বছরের যাত্রা মৌসুম নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। করোনা মহামারীর কারণে যাত্রাদলগুলো সংগঠিত হতে সাহস পাচ্ছে না। ৫ সেপ্টেম্বর সারা দেশ থেকে যাত্রাপালার মালিকরা ঢাকা এসেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল চৈতালি, আনন্দ, বিসিজাপ অপেরা। এসবের মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবার কোনো দলই করোনার কারণে সংগঠিত হচ্ছে না। মানে যাত্রাশিল্পটি নতুন করে অস্তিত্ব সংকটে পড়ল।

 

কেউ মুদি দোকানি কেউবা গরুর হাটের হাসিল তুলছেন

এম এ মজিদ উদ্বেগের সঙ্গে জানান, যাত্রাপালার এমন অচলাবস্থার কারণে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই বেঁচে থাকার তাগিদে ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছেন। যেমন প্রাচীন যাত্রাপালা কোহিনূর অপেরা পরে যার নাম হয়েছে আশানূর অপেরা, তার মালিক আয়েশা আক্তার এখন সিদ্ধিরগঞ্জে মুদির দোকান দিয়েছেন।  গীতিযাত্রার জনপ্রিয় নায়ক-নির্দেশক রহিম রাহী বাউল গান করে বেড়াচ্ছেন। যাত্রাপালার নায়িকা লাইলী বেগমও বাউল গান বেছে নিয়েছেন। যশোরের এক যাত্রানায়ক এখন স্থানীয় গরুর হাটে হাসিল তোলার কাজ করছেন। খুলনার যাত্রানায়ক সৌমিন স্টেশনারি দোকান করেন। খুলনার যাত্রাপালার ম্যানেজার অজয় সরকার এখন মুদি দোকানের কর্মচারী। জনপ্রিয় যাত্রা নৃত্যশিল্পী গোপালগঞ্জের মনীষা অধিকারী, যিনি মাঝে যাত্রাপালার মালিকও ছিলেন। তিনি এখন একটি বিউটি পারলার চালান। এভাবে বেশির ভাগ যাত্রা-সংশ্লিষ্ট ভিন্ন পেশায় চলে গেছেন।

 

শিল্পকলা অনলাইন যাত্রার আয়োজন করেছে

এম এ মজিদ জানান, করোনার কারণে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবার অনলাইন যাত্রার আয়োজন করেছে। প্রথমে চারটি দলকে ১০ মিনিট ও পরবর্তী চারটি দলকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক যাত্রাপালার জন্য ১৫ মিনিট করে সময় দেওয়া হচ্ছে। এটিই হচ্ছে যাত্রাপালার বর্তমান সময়ের বেদনাদায়ক চিত্র।

 

দেশে মোট যাত্রাদলের সংখ্যা

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে নিবন্ধন পেয়েছে ১১৭টি যাত্রা সংগঠন। এর মধ্যে কিছু দল নিবন্ধন নবায়ন করেনি। আর চারটি দল অশ্লীল যাত্রা মঞ্চায়নের কারণে তাদের নিবন্ধন বাতিল করেছে শিল্পকলা একাডেমি। এই চারটি দল হলো- ভোলানাথ, চৈতালি, ডায়মন্ড ও স্বদেশ অপেরা।

 

যাত্রা-সংশ্লিষ্টদের আবেদন

এম এ মজিদের কথায় এবার বৈশ্বিক করোনা মহামারীর কারণে জনসমাগম এড়াতে হয়তো যাত্রাপালার আয়োজন করা যাচ্ছে না। কিন্তু করোনাকাল কখনো শেষ হলে যেন যাত্রাপালা আবার আপন গতিতে চলতে পারে সে ব্যাপারে যাত্রা মালিকদের চেষ্টার ত্রুটি থাকবে না। সে ক্ষেত্রে শিল্পকলা একাডেমি ও সরকারের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা দাবি করেন যাত্রা অপেরার মালিক ও শিল্পীরা।

যাত্রাপালার সেই ইতিহাস

শিল্প-সংস্কৃতির ঐতিহ্যে ভাস্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া। পুতুলনাচ, পালাগান, নৌকাবাইচ, লাঠিখেলাসহ গ্রামবাংলার লোকজ উৎসব মাতিয়ে রাখত গোটা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এমনই এক শিল্পের নাম যাত্রাশিল্প। একসময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যাত্রা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল উভয় বাংলায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যাত্রা আজ বিস্মৃতপ্রায়। জয়দুর্গা, ভোলানাথ, বাসন্তী, মহাশক্তি, ভাগ্যলক্ষ্মী, রয়েল ভোলানাথ, বাবুল আইজ্যা এবং পান্না অপেরা দেশের লোকজ ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক কাহিনিভিত্তিক যে যাত্রাপালা উপহার দিয়েছিল আজ তা শুধু ইতিহাস হয়েই রয়েছে। জানা গেছে, ১৯৪১-৪২ সালে নবীনগরের বিদ্যাকূট গ্রামে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রাদলের সূচনা হয়। এরপর আরও অনেক দলের সৃষ্টি হয়। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এ দলগুলো- এম্যাচার যাত্রাদলের মালিক কানু ভট্টাচার্য, কমলা যাত্রাদলের মালিক লাড়ু বর্মণ, নিধু সাহা, আনন্দ পরিশোধ যাত্রাদলের মালিক বিষ্ণুপদ বর্মণ, ফ্রেন্ডস অপেরা পার্টির মালিক মো. নিজাম উদ্দিন, নাদের মিয়া। ১৯৩৬-৩৭ সালে কলকাতা থেকে যাত্রাদল এসে নিয়াজ মাঠে যাত্রা করত।

যতীন ঠাকুর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রথম জয়দুর্গা অপেরা নামে যাত্রাদল প্রতিষ্ঠিত করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এটিই প্রথম ব্যবসায়িক যাত্রা পার্টি। তার যাত্রাদলে জড়ো করলেন নামিদামি শিল্পী, কলাকুশলীদের। একটি পয়সা, বাগদত্তা, চন্দ্রশেখর, সিরাজউদ্দৌলা, রামপ্রসাদ, গরিবের মেয়ে, লোহার জাল, ময়ূর সিংহাসন, কোহিনূর, রাজ সন্ন্যাসী, মায়ের ডাক, সমাজের বলী, বাঁশের বাঁশি, প্রায়শ্চিত্ত, সোহরাব-রোস্তম, লাইলী-মজনু, শিরি- ফরহাদ, সূর্যসাক্ষী, টিপু সুলতান ইত্যাদি পালা করে জয়দুর্গা শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নয়, পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতেও আলোড়ন সৃষ্টি করল। ফলে সারা দেশেই জয়দুর্গা অপেরার নাম ছড়িয়ে পড়ল। পরে তিনি দর্শকদের চাহিদা পূরণের জন্য বিভিন্ন সময় বাবুল অপেরা ও আইজ্যা অপেরা, ভোলানাথ অপেরা, বাসন্তী অপেরা ও মহাশক্তি অপেরা প্রতিষ্ঠা করলেন। তবে তার জয়দুর্গাই মূল অপেরা হিসেবে থাকল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শিল্পীদের নিয়ে ১০টি অপেরা কৃতিত্বের সঙ্গে যাত্রাপালা করতে থাকে। বাংলাদেশের সর্বত্র তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গ ও আগরতলায়ও জনপ্রিয়তা লাভ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যাত্রাপালাগুলো। ‘জয়দুর্গা’, ‘ভোলানাথ’ যাত্রাদল ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সারা দেশে যাত্রাপালা করেছে। এরপর একের পর এক নেমে আসতে থাকে বিভিন্ন সংকট। একে একে সব যাত্রাদলই ভেঙে যায়। হারিয়ে যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী যাত্রা।

বাংলাদেশের যাত্রাজগতে মানিকগঞ্জের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একসময় দেশের অধিকাংশ যাত্রা ও লোকনাট্য দলই ছিল মানিকগঞ্জের। যাত্রাগান মানুষের বিনোদনের প্রধান উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। নারী যাত্রাশিল্পীদের মধ্যে ঘিওর উপজেলার জাবরা গ্রামের জ্যোৎস্না বিশ্বাসের নাম উল্লেখযোগ্য।  তিনি বাংলাদেশের যাত্রাজগতের প্রখ্যাত শিল্পী অমলেন্দ বিশ্বাসের স্ত্রী।

সর্বশেষ খবর