সোমবার, ৫ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

‘আলাদিনের জাদুর চেরাগ ছাড়া চলচ্চিত্রের উন্নয়ন অসম্ভব’

আলাউদ্দীন মাজিদ

‘আলাদিনের জাদুর চেরাগ ছাড়া চলচ্চিত্রের উন্নয়ন অসম্ভব’

অনন্ত জলিল

‘আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পে যদি কখনো আলাদিনের জাদুর চেরাগ পাওয়া যায় তাহলে হয়তো এই শিল্পটি ঘুরে দাঁড়াতে পারে, চেরাগের দৈত্যই পারবে সুদিন ফেরাতে, নয়তো আর কোনো আশার আলো দেখছি না। কারণ প্রযুক্তি আর মেধা শূন্যতায় ভুগছে ঢাকার চলচ্চিত্র’। এই ক্ষোভ দেশি চলচ্চিত্রের অসম্ভবকে সম্ভব করার নায়ক অনন্ত জলিলের। ২৫ জুন রোদেলা সকালে ঢাকা থেকে গাড়ি ছুটে চলছে সাভারের সিংগাইরের দিকে। আগের দিনও আকাশ কালো করা আষাঢ়ের ঝুম বৃষ্টি ছিল। আজ চারদিকে সোনালি রোদের ছড়াছড়ি। যানজটের এই শহরে শুক্রবার সকাল বলে হয়তো রাস্তা প্রায় ফাঁকা। গাড়িতে আমার পাশে বসা ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক সোনিয়া রহমান। সামনের সিটে ফটোজার্নালিস্ট রাহুল। সোনিয়া আর আমি ব্যতিক্রমী চিন্তাচেতনার নায়ক অনন্তকে নিয়ে আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সাতসতেরোর হিসাব চোখের সামনে খুলে ধরলাম। সোনিয়া ঠিক করে নিচ্ছিল কীভাবে চলচ্চিত্র নিয়ে এই মহানায়ককে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা যায়। অনন্তই ২০১০ সালে এদেশে প্রথম ডিজিটাল চলচ্চিত্র নির্মাণের সূচনা করেছিলেন তাঁর ‘খোঁজ দ্য সার্চ’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। একসময় সিংগাইরে জনপ্রিয় নায়ক অনন্তর বিশাল সাম্রাজ্যে গিয়ে পৌঁছলাম। প্রায় ২৬ বিঘা জমির ওপর ১৪টি হাইরাইজ বিল্ডিংয়ে তাঁর বায়িং হাউসের চরম ব্যস্ততায় অন্তহীন কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছেন ১১ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। এই ব্যবসার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গতি আনায় সরকার অনন্তকে একাধিকবার সিআইপি মর্যাদায় ভূষিত করেছে। তাঁর অফিস আর কারখানার সামনে গাড়ি থামতেই জনপ্রিয় নায়ক অনন্তর নিরাপত্তারক্ষী সাজ্জাদ এগিয়ে এলেন। চোখ ধাঁধানো অফিসে সবাই কর্মব্যস্ত। কনফারেন্স রুমে মিটিং করছেন জনপ্রিয় এই নায়ক ও প্রথিতযশা ব্যবসায়ী। আমাদের দেখে শুভেচ্ছা জানালেন। একসময় আমাদের সঙ্গে শুরু হলো আলোচনা। যেহেতু আমরা চলচ্চিত্র সাংবাদিক, তাই আলোচনার সারবস্তুও চলচ্চিত্রকে ঘিরেই চলছে। শুরুতেই দেশি চলচ্চিত্র নিয়ে অনন্তর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটল এভাবে-‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ এতে শিল্পের কোনো সুবিধা এখনো নেই।  প্রযুক্তির দিক দিয়ে বিশ্বে যখন প্রতিযোগিতার জোয়ার চলছে তখন চলচ্চিত্রের পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ করতেও অতিরিক্ত অর্থ গুনে বিদেশের দ্বারস্থ হতে হয় আমাদের। অভিনয়, নির্মাণসহ কোনো কিছুর জন্যই নেই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। এই শূন্যতা তৈরি হয়েছে সরকারি নীতিমালার অভাবে। প্রতিটি কাজের জন্যই সুনির্দিষ্ট একটি নীতিমালা থাকে। অথচ চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে তা নেই। ফলে নির্মাণ, প্রদর্শন, রপ্তানি- মানে সব ক্ষেত্রেই আমরা প্রচন্ড খরায় আছি। দীর্ঘদিন ধরে শুনছি দেশের প্রতি জেলায় সরকারি উদ্যোগে সিনেপ্লেক্স নির্মাণ হবে। এরপর শুনলাম সিনেমা হল সংস্কার ও নির্মাণের জন্য ১ হাজার কোটি টাকার সরকারি ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব কথা শুধুই শুনে আসছি। তার বাস্তবায়ন দৃশ্যমান নয়। আমি বলব সিনেমা হল নয়, এখন সিনেপ্লেক্সের যুগ। যেখানে একজন মানুষ শপিং, বাচ্চাদের খেলাধুলা, খাওয়া-দাওয়াসহ সবকিছুর পাশে সিনেমা দেখে বিনোদিত হতে পারে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে না পারলে স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে থাকতে হবে। চলচ্চিত্রের উন্নয়নের জন্য নতুন প্রজন্মকেই কাজে লাগাতে হবে। নতুনরা প্রযুক্তিসহ সব বিষয় স্বাভাবিকভাবেই সহজে নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে সক্ষম। কলকাতার চলচ্চিত্রের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাই সেখানে নতুনত্ব আনতে স্থানীয়র পাশাপাশি সাউথ ইন্ডিয়ান চলচ্চিত্রের টেকনিশিয়ানদের বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। কারণ তারা উন্নত প্রযুক্তি ও মেধায় সমৃদ্ধ। তাই কলকাতার চলচ্চিত্রের মানও প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারছে। আমাদের দেশে এখনো চলচ্চিত্রের গল্প ভাবনায় সংকট রয়েছে। গল্পের লাইনআপেও নতুনত্ব নেই। অথচ এখনকার সব চেয়ে বেশি দর্শকপ্রিয় সাউথ ইন্ডিয়ান ছবিতে আমরা দেখতে পাই একটি গল্পে ড্রামা থাকছে ২০ ভাগ আর গান অ্যাকশন মিলিয়ে বাকি ৮০ ভাগ। এতে সহজেই দর্শক মনে দাগ কাটছে ছবিটি।’ কথার ফাঁকে অনন্ত তাঁর মোবাইল স্ক্রিনে বিশ্বের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কিছু ছবির উদাহরণ তুলে ধরলেন। তিনি আবারও আক্ষেপ করে বললেন, কথা আর বাস্তবতার মধ্যে সমন্বয় না থাকলে কোনো সেক্টরেরই উন্নয়ন সম্ভব নয়। অনন্ত  ফের ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এখানকার অনেক নির্মাতারই মানসিকতা এমন যে, ছবিতে যৌনতা আর নারীর শরীর প্রদর্শন করলেই সেই ছবি হিট হয়ে যাবে। এমন অবক্ষয়যুক্ত ধারণা যে ভ্রান্ত তা বার বার প্রমাণ করেছে ‘মনপুরা’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’, ‘আয়নাবাজি’, ‘দেবী’র মতো পরিচ্ছন্ন জীবনঘনিষ্ঠ ছবিগুলো। আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের ছবিতে যদি দেশি সংস্কৃতির চর্চা করা হয় তাহলে সেই ছবিই দর্শক পরিবার নিয়ে সিনেমা হলে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে আসছে এবং যাবে।’ অনন্ত দুঃখ করে বলেন, ‘আমরা আমাদের চলচ্চিত্রকে এখনো মেধা আর মনন দিয়ে অনন্য উচ্চতায় নিতে পারিনি বলেই আজ বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক নির্মাণে বিদেশের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে।’ অনন্ত বলেন, দেশি চলচ্চিত্রের উন্নয়নে একাধারে প্রযুক্তির উন্নয়ন ও রুচির অবক্ষয় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজন যথাযথ নীতিমালা প্রণয়ন। এবার আমাদের আলোচনায় উঠে এলো জনপ্রিয় নায়ক অনন্তর সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র নিয়ে। ইরানের সঙ্গে যৌথ আয়োজনে অনন্ত নির্মিত ‘দিন দ্য ডে’ ছবিটি অনেক আগেই বিশ্বব্যাপী মুক্তির জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। করোনার কারণে মুক্তি বিলম্বিত হচ্ছে, জানালেন দর্শক ক্রেজ অনন্ত। তাঁর আরেকটি যৌথ আয়োজনের ছবি ‘নেত্রী’র কাজ প্রায় ২৫ ভাগ শেষ। এটির কাজও করোনা বিঘিœত হয়ে আছে। ছবিটির কিছু অংশ অনন্তর এডিটিং প্যানেলে দেখে আমরা অভিভূত। নির্মাণ, অভিনয়, লোকেশন, সব কিছুই এক কথায় অসাধারণ। এই ছবিতে দর্শক অনন্ত-বর্ষাকে একেবারেই নতুন লুকে দেখতে পাবেন।  প্রথমবারের মতো অনন্ত কোনো বিদেশি ছবিতে নায়ক হিসেবে কাজ করতে যাচ্ছেন। ছবিটি হলো নরওয়ের যৌথ আয়োজনের ‘দ্য লাস্ট হোপ’। শিগগিরই এর নির্মাণকাজ শুরু হবে।

একসময় গল্প আর দুপুরের খাবার গ্রহণের মধ্য দিয়ে শেষ হলো আমাদের আনন্দ আড্ডার পর্ব। ‘ঢাকার পোলা ভেরি ভেরি স্মার্ট’রূপী অনন্তর কাছ থেকে শুভেচ্ছাসিক্ত বিদায়ের পর সোনিয়া, আমি আর রাহুলকে নিয়ে গাড়ি ছুটে চলল ধুলা উড়িয়ে দুর্বারগতিতে ব্যস্ততম ঢাকা নগরীর দিকে।

সর্বশেষ খবর