রবিবার, ২৫ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

গণসংগীতের এক অধ্যায়ের সমাপ্তি

আলী আফতাব

গণসংগীতের এক অধ্যায়ের সমাপ্তি

ফকির আলমগীর

ভাঙা ভাঙা গলায় গান আর ঝাঁকড়া চুলের সৌন্দর্য দিয়ে প্রায় অর্ধ শতকের বেশি সময় ধরে যে লোকটি লাখো মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি হলেন গণমানুষের শিল্পী ফকির আলমগীর। ‘ও সখিনা’ কিংবা ‘মায়ের একধার দুধের নাম’ গানগুলো এ দেশের মানুষকে দরাজ গলার এই শিল্পীর কথা মনে করিয়ে দেবে অনন্তকাল।

করোনায় আক্রান্ত হয়ে শুক্রবার রাতে মারা যান একাত্তরের কণ্ঠযোদ্ধা, গণসংগীত  শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা ফকির আলমগীর (৭১)। ফকির আলমগীরের জন্ম ১৯৫০ সালের ২১  ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার কালামৃধা গ্রামে। কালামৃধা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করেন।

ষাটের দশকের মাঝামাঝি জড়িয়ে যান বাম ধারার ছাত্র রাজনীতিতে। সেই সূত্রে ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী ও গণশিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে তাঁর গান আর সংগ্রামের জগতে প্রবেশ।

তারপর এলো ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল সময়। শিল্পী ফকির আলমগীর তাতেও কণ্ঠ মেলালেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যোগ দিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে।

ফকির আলমগীরের বয়স তখন ২১ বছর। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে কলকাতার নারিকেল ডাঙায় শরণার্থী শিল্পী গোষ্ঠীতে যোগ দেন তিনি। সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত এম এ মান্নান ছিলেন সেই সংগঠনের দলনেতা। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে পাশ্চাত্য সংগীতের সঙ্গে দেশজ সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়ে বাংলা পপগানের বিকাশে মাতে তরুণ শিল্পীদের একটি দল। আজম খান, ফিরোজ সাঁই আর ফেরদৌস ওয়াহিদের সঙ্গে ফকির আলমগীরও তখন পপগানে উন্মাদনা ছড়িয়েছিলেন শ্রোতাদের মাঝে। ফকির আলমগীরের গণমানুষের শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল যে গানের চরিত্রের, তার নাম সখিনা। ১৯৮২ সালে বিটিভিতে ঈদের আনন্দমেলায় ‘ও সখিনা গেছস কিনা ভুইলা আমারে’ গানটি প্রচারের পর দর্শকদের মাঝে সাড়া পড়ে যায়। নব্বইয়ের দশকে সামরিক শাসনবিরোধী গণআন্দোলনে প্রতিবাদী গানে ফকির আলমগীরের সরব উপস্থিতি তাঁকে তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়তার নতুন মাত্রায় নিয়ে যায়। তবে তার আগেই মাকে নিয়ে লেখা তাঁর আরেকটি গান মানুষের মুখে মুখে ফিরত। ‘মায়ের একধার দুধের দাম’ গানটি সিনেমাতেও ব্যবহৃত হয়েছিল।

‘মন আমার দেহ ঘড়ি’, ‘আহারে কাল্লু মাতব্বর’, ‘ও জুলেখা’, ‘ঘর করলাম না রে আমি’, ‘সান্তাহার জংশনে দেখা’, ‘বনমালী তুমি’সহ তাঁর গাওয়া বহু গান আশি ও নব্বইয়ের দশকে দারুণ জনপ্রিয় ছিল। গানে গানে গণমানুষের কথা বলার প্রতিজ্ঞা থেকেই ফকির আলমগীর গেয়েছেন ‘ধোঁয়ায় ছেয়েছে গাজার আকাশ; আবার সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিও তাঁর গানে এসেছে।

নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিন উপলক্ষে গাওয়া একটি গান ছিল ফকির আলমগীরের নিজের কাছেই প্রিয়। ১৯৯৭ সালের মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নেলসন ম্যান্ডেলা যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন, সে সময় তাঁকে নিয়ে লেখা সেই ‘কালো কালো মানুষের দেশে’ গানটি শুনিয়েছিলেন ফকির আলমগীর।

ফকির আলমগীর সাংস্কৃতিক সংগঠন ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা। গণসংগীত চর্চার আরেক সংগঠন গণসংগীত শিল্পী পরিষদের সভাপতি এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহসভাপতির দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন।

গানের পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন এই শিল্পী। ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও বিজয়ের গান’, ‘গণসংগীতের অতীত ও বর্তমান’, ‘আমার কথা’, ‘যারা আছেন হৃদয় পটে’সহ বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ হয়েছে তাঁর। বাংলাদেশের গণসংগীতে অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে ফকির আলমগীরকে একুশে পদক দেয় সরকার। এ ছাড়া শেরেবাংলা পদক, ভাসানী পদক, জসীমউদ্দীন স্বর্ণপদক, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সম্মাননা ‘সিকোয়েন্স অ্যাওয়ার্ড অব অনার’, ‘তর্কবাগীশ স্বর্ণপদক’, ‘কান্তকবি পদক’, ‘গণনাট্য পুরস্কার’, ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক মহাসম্মাননা’, ‘ত্রিপুরা সংস্কৃতি সমন্বয় পুরস্কার’, ‘ঢালিউড অ্যাওয়ার্ড যুক্তরাষ্ট্র’, ‘জনসংযোগ সমিতি বিশেষ সম্মাননা’, ‘চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড বিশেষ সম্মাননা’ ও ‘বাংলা একাডেমি  সম্মানসূচক ফেলোশিপ’ পান তিনি।

 

শোকাচ্ছন্ন সতীর্থরা

সৈয়দ আবদুল হাদী

প্রাণ খোলা মানুষ ছিল ফকির আলমগীর। যাকে সে চিনত অনেক বছর ধরে, তার সঙ্গেও যেমন, যাকে সে প্রথম দেখল তার সঙ্গে একইভাবে আপন হয়ে কথা বলত। এ রকম আপন করে নেওয়া মানুষ কম দেখেছি। করোনায় আমার এই প্রিয় মানুষটিও চলে গেল।

তাঁর আত্মার  মাগফিরাত কামনা করি।

 

 

তপন চৌধুরী

মাস দুয়েক আগে কথা হয়। দেখা হলেই জড়িয়ে ধরা। মজা করে বললেন, আরে করোনার ডর নাই। বুকে জড়ায়ে ভালোবাসা দিলে করোনা ধরে না। একসঙ্গে কত প্রোগ্রাম করেছি।

মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তাঁর ওই কথাগুলোই বারবার মনে পড়ছে। যেখানে থাকুন ফকির ভাই ভালো থাকবেন জানি।  ঈশ্বরের কাছে আমার ভাইটার জন্য এই প্রার্থনা।

 

সামিনা চৌধুরী

কিছু বলার নেই। যেদিন ফকির ভাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে, সেদিন থেকেই প্রতি ওয়াক্তে প্রার্থনা করেছি তাঁর সুস্থতার জন্য। ওপরওয়ালা তাঁকে নিয়েই গেলেন।

এত পরিশ্রম করতে পারতেন তিনি। সত্যিই মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে। একে একে যেন নিভছে সব। কতজনকে হারালাম। এই শোক আর নিতে  পারছি না।

 

কুমার বিশ্বজিৎ

ফকির আলমগীর ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এ কথা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়। তাঁর মতো শিল্পী পাওয়া দুষ্কর। তাঁকে দেখলেই মনে হতো এই মানুষটি আমার ভীষণ কাছের।

তিনি নিজের ব্যবহারে সেটি অর্জন করেছিলেন। এমন সংস্কৃতি ও দেশ পাগল মানুষ কমই জন্মে।  তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

সর্বশেষ খবর