বুধবার, ২ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

৫৬ বসন্তেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী বলিউড বাদশাহ

শোবিজ ডেস্ক

৫৬ বসন্তেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী বলিউড বাদশাহ

বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খানের ৫৬তম জন্মদিন আজ। ২ নভেম্বর মানেই শাহরুখভক্তদের জন্য আলাদা উন্মাদনা। এবারের উন্মাদনা আরেকটু বেশি। গত তিন বছর করোনাসহ নানা প্রতিকূল কারণে বাসভবন বান্দ্রার মান্নাতের বারান্দায় দাঁড়িয়ে উৎসুক ভক্তদের হাত নেড়ে শুভেচ্ছার জবাব তেমনভাবে দিতে পারেননি তিনি।  তবে এবার নাকি তাঁর জন্মদিনকে ঘিরে মান্নাত সেজেছে অপরূপ সাজে। শাহরুখের জন্মদিনে তাঁর জীবনের নানা মাহেন্দ্রক্ষণের চিত্র তুলে ধরা হলো-

 

অভিনয়ের ৩০ বছরেও অপ্রতিদ্বন্দ্বী-

বলিউড যাত্রার ৩০ বছরেও জনপ্রিয়তায় এতটুকু ভাটা পড়েনি, এখনো তিনি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফিল্ম আইকনদের একজন। ১৯৯২ সাল, বলিউড সাম্রাজ্যে অভিষেক হলো নতুন এক অভিনয়শিল্পীর। তাঁর নাম শাহরুখ খান। অভিনয়ের নেশায়ই দিল্লি থেকে মুম্বাই পাড়ি জমানো ছেলেটি বেশ কটি টিভি সিরিয়ালে কাজ করলেন। চুক্তিবদ্ধ হলেন কয়েকটি চলচ্চিত্রেও। ‘ফৌজি’তে তাঁর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হন বলিউডের কিংবদন্তি অভিনেত্রী হেমা মালিনী। তখন এই অভিনেত্রী ‘দিল আশনা হ্যায়’ শিরোনামের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে যাচ্ছিলেন। ওই ছবিতেই শাহরুখকে কাস্ট করলেন তিনি। শুরু হলো বলিউডের ঝলমলে দুনিয়ায় শাহরুখের অভিষেক। যদিও ১৯৯২ সালেই শাহরুখ অভিনীত ‘দিওয়ানা’ ছবিটি প্রথম মুক্তি পায়। ওই ছবিতে তাঁর প্যারালাল অভিনয়ে তিনি দক্ষতার সঙ্গে রূপায়ণ করে বলিউডের তখতে সহজেই উপবিষ্ট হয়ে যান। ১৯৬৫ সালের ২ নভেম্বর নয়াদিল্লির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া ছেলেটি এখনো বলিউডে কিংখান, বলিউড বাদশাহ, কিং অব বলিউড, কিং অব রোমান্স হয়ে আছেন দর্শকহৃদয়ে।

 

জনপ্রিয় লেখিকা শ্রায়ণা ভট্টাচার্যের চোখে-

শাহরুখ খানের দীর্ঘস্থায়ী জনপ্রিয়তা নিয়ে বই লিখেছেন প্রখ্যাত লেখিকা শ্রায়ণা ভট্টাচার্য। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কেন অগণিত ভক্তের কাছে এত প্রিয় তিনি? কেন বহু মানুষের আরাধ্য তারকা এই শাহরুখ খান? তাঁর কথায় শাহরুখের ছবিগুলোর মতোই তিনি রোমান্টিক ও আবেগপ্রবণ। ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের সবচেয়ে ভালো দিকগুলোই তিনি সর্বদা তুলে ধরেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার যা কিছু মহৎ, চলচ্চিত্রে তিনি তাঁর মূর্ত প্রতীক। তিনি এমন একটা সমৃদ্ধ, বহুত্ববাদী ও মানবিক সমাজের চিত্র আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন, যেখানে ধর্মের ফোঁসফোঁসানি নেই।

 

শাহরুখ খান ভারতীয় অর্থনীতি

লাখ লাখ ভারতীয় মনে করেন অর্থনীতিতে ভারতের অগ্রযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে আছে শাহরুখ খানের নাম। দেশটির অর্থনৈতিক উত্থানের কাহিনির তিনি ‘পোস্টারচাইল্ড’। বিশ্ব অর্থনীতির মানচিত্রে ভারত যখন স্থান করে নিচ্ছে ঠিক সে সময়ই চলচ্চিত্রের রুপালি পর্দায় আবির্ভাব শাহরুখ খানের। যে সময় ভারত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে হাঁটছে, ঠিক সে সময়ই জনপ্রিয়তার শিখরে উঠেছেন শাহরুখ খান। ভারতে বাজার সংস্কারের লক্ষ্যে নেওয়া একের পর এক পদক্ষেপের অংশ হিসেবে টেলিযোগাযোগ খাতকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় বিদেশি বিনিয়োগের জন্য। এর ফলে নতুন নতুন মিডিয়া চ্যানেল ভারতে সম্প্রচারের অনুমতি পায়। ওই চ্যানেলগুলোতে সবসময় দেখানো হতো শাহরুখ খানের ছবি, তাঁর গানের চিত্রায়ণ এবং নানা সময় তাঁর সাক্ষাৎকার। ওই চ্যানেলগুলোর দৌলতেই তিনি পৌঁছে যান মানুষের ঘরে ঘরে। তাঁর আগের যে কোনো চলচ্চিত্র তারকার চেয়ে তিনি অনেক বেশি মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ছায়াছবির জগতে উল্কার গতিতে শাহরুখ খানের উত্থান একটা রূপকথার কাহিনির মতো। ভারতের অর্থনীতি আরও উদার হতে শুরু করলে নতুন নতুন সোডা-জাতীয় পানীয় এবং গাড়ি ভারতের বাজারে ঢুকতে শুরু করে। তাঁরা শাহরুখ খানকে তাঁদের পণ্যের বিজ্ঞাপনে ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর’ করে নেন। কারণ এই তারকার জনপ্রিয়তা তখন আকাশচুম্বী। সেই অর্থে বলা যায়, দিল্লির এক সাধারণ পরিবারের সন্তান থেকে তারকাখ্যাতির শীর্ষে শাহরুখ খানের উল্কার গতিতে উঠে আসার রূপকথা কাহিনির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতের নব্য-উদারপন্থি অর্থনৈতিক সাফল্যের গল্পও। কোনোরকম বংশ পরিচয়ের সুবাদে সিনেমায় ঢোকা বা চেনাজানাদের সঙ্গে খাতির ছাড়াও যে চলচ্চিত্রে বিপুল খ্যাতি অর্জন সম্ভব, শাহরুখ খানের উত্থান তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। তাঁর উত্থান ঘটেছে দেশটির অর্থনীতির উত্থানের হাত ধরে।

 

প্রগতিশীল ধারায় এগিয়ে চলা

অতীতে বহুত্ববাদী ও প্রগতিশীলরা যে পথে ভারত হেঁটেছেন, দেশটিতে হিন্দুত্ব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পরও যারা ওই ধারাকে আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করছেন- সেই ভারতীয়রা শাহরুখ খানকে একটা প্রতীক হিসেবে দেখেছেন। সমালোচকরা বলছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের আমলে অসহিষ্ণুতা বেড়েছে। এর ফলে ভারতের মুসলমানরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন বলে ব্যাপকভাবে অভিযোগ রয়েছে। শাহরুখ খানের ছেলে আরিয়ান খানকে গত বছর মাদক সেবনের মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে প্রমাণের অভাবে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অনেকেই বলেছিলেন ভারতের সবচেয়ে সফল মুসলিম আইকনকে টার্গেট করার জন্যই শাহরুখ খানের ছেলেকে মামলায় ফাঁসানো হয়েছিল। মি. খান সবসময়ই ভারতের বহুত্ববাদ নিয়ে সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন। তাঁর সমসাময়িক অভিনেতাদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি ছবিতে মুসলিম চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তারপরও তাঁর ভক্তদের কাছে কখনই তাঁর ধর্মীয় পরিচয়টা বড় হয়ে ওঠেনি। তাঁরা তাঁকে দেখেছেন জ্ঞানী, রসিক, সফল এবং ব্যাপকভাবে আবেদনময় একজন পুরুষ হিসেবে। শাহরুখ খানের স্ত্রী হিন্দু। শাহরুখ খান এবং তাঁর মিশ্র-ধর্মের পরিবারের বিরুদ্ধে দক্ষিণপন্থিদের ন্যক্কারজনক আক্রমণ নিয়ে তাঁর এক তরুণ ভক্তের কথায় ‘তিনি অসাম্প্রদায়িক আর দারুণ সেক্সি।’

 

রোমান্টিক সুপারহিরো

শাহরুখ খান দক্ষিণ এশিয়ার রোমান্টিক সুপারহিরো- তাঁর চলচ্চিত্রগুলোতে যে ‘দেশি’ রোমান্স উঠে এসেছে, তার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার, নিজের জীবনে সেই প্রেমকে অনুভব করার স্বপ্ন দেখেন দক্ষিণ এশিয়ার বহু তরুণ-তরুণী। তথ্য থেকে দেখা গেছে, বলিউডে অন্য পুরুষ স্টারদের অভিনীত চরিত্রগুলোর চেয়ে শাহরুখ খান অভিনীত চরিত্রগুলো বেশি নাড়া দিয়েছে নারীদের। কিন্তু শাহরুখের অভিনীত চরিত্রগুলো শুধু প্রথামাফিক নারী প্রেমিকার ভালোবাসার কাঙাল নয়, তারা বাবার ভালোবাসা, বন্ধুদের ভালোবাসা এবং দেশের মানুষেরও ভালোবাসা চেয়েছে। বলিউডের এই আইকন সবসময় মানব চরিত্রের নানা দুর্বলতার দিকগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন। দুর্বল প্রেমিক, দুর্বল নায়ক, দুর্বল স্বামী, দুর্বল এক মুসলিম- এমনকি দুর্বল এক খলনায়কের চরিত্রে তাঁর অসাধারণ অভিনয় দর্শক দেখেছে। এসব চরিত্রে তিনি তুলে এনেছেন মানুষের দুর্বল দিকগুলো। রুপালি পর্দায় এই চরিত্রগুলোর মধ্যে নিরাপত্তার যে অভাব তিনি দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা তিন দশকে তাঁর অভিজ্ঞতার ফসল। তাঁর রূপায়িত এই চরিত্রগুলো প্রায়শই আবেগে ভরা নিঃসঙ্গ মানুষ- সম্পূর্ণভাবে ভালোবাসা যার ভাগ্যে জোটেনি, কিন্তু ভালোবাসার জন্য হাল ছাড়তে যিনি নারাজ, প্রেমের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘোরা যিনি থামাতে চান না।

 

গভীর অনুভূতি মানুষ

তাঁর চরিত্রগুলোর মধ্যে খুবই গভীর অনুভব রয়েছে। অন্যের ব্যবহারে, অপমানে বা আঘাতে চরিত্রগুলো কান্নায় ভেঙে পড়ে- অনেক অনেক অশ্রু ঝরে তাদের চোখে। চলচ্চিত্রের কাহিনিকাররা প্রায়ই বলে থাকেন, বিশ্বের বেশির ভাগ অভিনেতার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় শাহরুকের মতো কাঁদতে পারে খুব কম অভিনেতাই। মানুষের দুঃখ-দুর্দশার অনুভূতি ফুটিয়ে তোলা তাঁর অশ্রুসিক্ত মুখ তাঁর অগণিত ভক্তের কাছে অনন্য করে তুলেছে।

উপসংহারে বলা যায়, অনিশ্চিত ও রূঢ় বাস্তবতার বিশ্বে শাহরুখ খানের যে অসাধারণ ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে তা তাঁর ভক্তদের জন্য চমৎকৃত হওয়ার এবং একই সঙ্গে বিনোদনের জন্য একটা বিরল জায়গা তৈরি করে দিয়েছে।

সর্বশেষ খবর