বুধবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকার

দেশ স্বাধীন করেছি, এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি

সৈয়দ হাসান ইমাম

দেশ স্বাধীন করেছি, এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি

দেশের স্বনামধন্য অভিনেতা, আবৃত্তিকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং স্বৈরাচার-সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সালেহ আহমেদ নামে সংবাদ পাঠ করতেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনেও তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তাঁর জীবনের বিভিন্ন বাঁক, সফলতা ও অর্জন প্রসঙ্গে কথা বলেছেন- পান্থ আফজাল

 

কেমন আছেন? দেশে আছেন কি?

চিকিৎসা চলছে। এখন কিছুটা ভালো আছি। চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছি দীর্ঘ সময়। বলা যায়, বিদেশে থাকতে বাধ্য হচ্ছি আর কি! আমি পারলে তো এখনই এক দৌড়ে চলে যাই আমার প্রিয় মায়ের কোলে (দেশ)। গত বছর থেকেই আমার শরীর অসম্ভব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ১৬ পাউন্ড ওজন কমে গিয়েছিল। এরপর আবার ছিল ডিহাইড্রেশনসহ নানা সমস্যা। এই চিকিৎসা আমাদের দেশে হয় না। তবে এখন ভালোই আছি।

 

এখনো তো আপনি বয়সে দুরন্ত যুবা...

ভেবেছিলাম রবীন্দ্রনাথকে তো কিছুতেই ছাড়িয়ে যেতে পারব না, তবে বয়সকে অতিক্রম করেছি... হা হা হা। তিনি তো ৮০ বছর বেঁচেছিলেন আর আমার এখন ৮৭!

 

রবীন্দ্রনাথের গান কি আপনার খুবই পছন্দের?

তিনি তো সব সময়ের! আমার প্রিয় একজন। এই তো কবিগুরুর ‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার’ গানটি আমি ৮১ বছর বয়সে নিউইয়র্কে উদীচীর আয়োজনে একটি অনুষ্ঠানে গেয়েছিলাম। তখন ভিডিওটি মোবাইলে রেকর্ড করে ইউটিউবে আপলোড করা হয়।

 

ছাত্রজীবনে আপনি তো ভালো গানও করতেন?

সেটা ছাত্রজীবনের কথা। ১৯৫২ সালে অল ইন্ডিয়া ইয়ুথ ফেস্টিভ্যালে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে প্রথম স্থান অর্জন করি। এরপর ১৯৫৫ সালে কলেজের অনুষ্ঠানে আমার গান শুনে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় আমাকে বিনা পারিশ্রমিকে গান শেখানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। আমি মাত্র এক বছর উচ্চাঙ্গ সংগীতে তালিম নিয়েছিলাম।

 

সহধর্মিণীর সঙ্গে পরিচয় কীভাবে?

আমাদের প্রথম পরিচয় একসঙ্গে ঘটেনি। লায়লা আমাকে আগে দেখেছে। রবীন্দ্রশতবর্ষে দুজনের দেখা হয়েছিল। ও তখন বাচ্চা, এই বাচ্চা মেয়ের কথা আমি তখন ভাবিনি; আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে যেত... হা হা হা। আমি তাকে প্রথমে দেখিনি; অবশ্য পরে দেখেছি। লায়লা আমাকে প্রথম দেখেছে ১৯৬১ সালে। পরে আমরা একসঙ্গে ভয়েজ অব আমেরিকায় নাটক করেছি। আর এই বিষয়টি ভয়েজ অব আমেরিকায় কর্মরত কাছের মানুষেরা ইচ্ছা করেই করেছিলেন। তখন আমার জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছিল। আর লায়লা এমনিতেই আমাকে চিনত। নাটকে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখেছে।

 

আপনি কোনো দিন চিঠি লিখেছিলেন তাকে?

লিখেছিলাম একটা। তবে সেই চিঠির উত্তরটা সে আজও দেয়নি। এরপর তো ১৯৬৫ সালে আমরা বিয়ে করি।

 

চলছে মহান বিজয়ের মাস মাসকে কীভাবে স্মরণ করেন?

বিজয় তো আমাদের বাঙালির কাছে আনন্দের, গর্বের ও সম্মানের। চাই সবাই যেন মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শহীদ, মুক্তিযুদ্ধের কথা স্মরণ করে।

 

যে উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে তা কি সফল হয়েছে বলে মনে করেন?

অনেক কিছুই হয়েছে আবার অনেক কিছুই হয়নি। তবে সাম্প্রদায়িক উত্থান, মৌলবাদীর উত্থান বর্তমানে কমেছে। আমি মনে করি, সব মানুষ সমান। সব ধর্মের, সব সম্প্রদায়ের মানুষের সমান অধিকার দরকার। বিশেষ করে রাজনৈতিক অধিকার থেকে সামাজিক অধিকার বেশি দরকারি।

 

স্বাধীনতা আন্দোলনেস্টপ জেনোসাইড রূপান্তরের গান-এর ভূমিকা কেমন ছিল?

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র দলিল ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ এবং ‘স্টপ জেনোসাইড’ নির্মিত হয়। আমাদের ‘স্টপ জেনোসাইড’ দেখে অনেক বিপক্ষ দেশের জনগণ উদ্বুদ্ধ হয়েছে। তখন মুক্তিকামী শিল্পী সংস্থায় আমি, ওয়াহিদুল হক, সনজীদা খাতুন, মুস্তাফা মনোয়ার ছিলাম। আমরা যুবকদের নিয়ে স্কোয়ার্ড গঠন করেছিলাম। আর ৪৭-৭১ এর পটভূমিতে করা ‘রূপান্তরের গান’-এর ধারা বর্ণনা তখন আমি করতাম। রচনায় ছিলেন শাহরিয়ার কবির। রূপান্তরের গান নিয়ে তখন আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলাম।

 

আরবিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ-এর ভূমিকা?

১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমাকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় শিল্পীদের প্রতিবাদী সংগঠন ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’। সবাই তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বর্জন করি। গণআন্দোলনের চাপে পাকিস্তান সরকার ৮ মার্চ থেকে বেতার-টেলিভিশনের দায়িত্ব বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ২৫ মার্চের পর আমি মুজিবনগরে চলে যাই এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নাটক বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে নিযুক্ত হই।

 

তখন সালেহ আহমেদ নামে সংবাদ পাঠ করতেন..

তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সালেহ আহমেদ নামে বাংলা সংবাদ পাঠ করতাম। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংবাদ পাঠের দায়িত্ব পালন করি। দুটি কমিটি করে বেতার-টেলিভিশনের প্রচার চালাই। আর পাকিস্তানের প্রচার মাধ্যম আমাদের কাজে ব্যবহার করি। প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বে স্বাধীন সরকার গঠিত হলে যারা বেতার-টেলিভিশন থেকে ভারতে চলে গিয়েছিল তাদের ফিরিয়ে এনে প্রচার শুরু করি।

 

ওই সময় আমাদের সমর্থন কারা দিয়েছিল?

পৃথিবী তখন ২ ভাগে বিভক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্য সরকারগুলো তখন আমাদের বিপক্ষে ছিল আর সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত এবং পূর্ব ইউরোপ আমাদের পক্ষে ছিল। মজার ব্যাপার হলো কোনো কোনো রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান আমাদের বিপক্ষে থাকলেও জনগণ কিন্তু আমাদের সমর্থন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শিল্পী, বিশেষ করে বিটলসের শিল্পীরা আমাদের সমর্থন করেছে, পাশে থেকেছে। চাঁদা তুলে মুক্তিযুদ্ধের কাজে সহায়তা করেছে।

 

জীবনের এই পর্যায়ে এসে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব করেছেন কখনো?

না, করতে চাই না। দেশ স্বাধীন করেছি, এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। ব্যক্তি হিসেবে কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই, আকাক্সক্ষা বা কোনো হতাশাও নেই।

সর্বশেষ খবর