তারকাদের আদর্শ
রুচিশীল অভিনয় আর মিষ্টি হাসিতে কয়েক প্রজন্মের ভালোবাসা অর্জন করা অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা। বর্তমান প্রজন্মের অনেক অভিনেত্রীও তাঁকে আদর্শ মানেন। জনপ্রিয় এ তারকার জন্মদিন আজ। ১৯৬০ সালের ২ ডিসেম্বর প্রখ্যাত অভিনেতা গোলাম মুস্তাফার ঘর আলো করে পৃথিবীতে আসেন সুবর্ণা মুস্তাফা। এরপর বাবার দেখানো পথে হেঁটে নিজেও হয়েছেন বরেণ্য। জন্ম যেহেতু সাংস্কৃতিক পরিবারে সুতরাং ছোটবেলা থেকেই এ জগতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে সুবর্ণা মুস্তাফার।
অভিনয়ে যেভাবে
সুবর্ণা মুস্তাফার মা হোসনে আরা মুস্তাফা কলকাতা থেকে কলেজ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। একসময় কলকাতা রেডিওতে কাজ করতেন। পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানের রেডিওতেও কাজ করেছেন প্রযোজক হিসেবে। চমৎকার আবৃত্তি করতেন, মঞ্চেও অভিনয় করতেন। টিভির জন্য নাটক লিখেছেন অসংখ্য। ‘আকাশ কুসুম’ নাটকে সুবর্ণা নিজেও অভিনয় করেছেন। সুবর্ণার মিডিয়াতে কাজ শুরু অনেক ছোট বয়সেই। মায়ের হাত ধরে ৫/৬ বছর বয়সেই বেতারে কাজ করা শুরু করেন। এ ছাড়া ১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত শিশুশিল্পী হিসেবে তিনি টেলিভিশনেও নিয়মিত ছিলেন। তবে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালে ‘বরফ গলা নদী’তে অভিনয় দিয়ে টেলিভিশনে আবার যাত্রা শুরু। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে জাতীয় নাট্যোৎসবে ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’-এ অভিনয় করেন। মঞ্চে অভিনয় দিয়েই শুরু হয়েছিল তাঁর ক্যারিয়ার। এরপর টিভিতে আসেন আশির দশকে। ১৯৯০ সালে নন্দিত লেখক ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে বরকত উল্লাহ পরিচালিত ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটক দিয়ে আলোচনায় আসেন সুবর্ণা। এরপর অভিনয় করেছেন ‘আজ রবিবার’-এর মতো কালজয়ী ধারাবাহিক নাটকে। টেলিভিশনের সঙ্গে সঙ্গে সেই সময়ে মঞ্চেও সমান পারফর্ম করেছিলেন সুবর্ণা। টানা ২৫ বছর ছিলেন ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে। বিজ্ঞাপনেও তাঁর মুখর পদচারণা ছিল। ক্যারিয়ারের সুবর্ণ সময়ে লাক্স সাবানের মডেল হয়েছিলেন সুবর্ণা।
চলচ্চিত্রে
চলচ্চিত্রে সুবর্ণা মুস্তাফার অভিষেক একেবারে যুবতী বয়সে। ১৯৮০ সালে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী পরিচালিত ‘ঘুড্ডি’ সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি। এরপর আরও অনেক ছবিতে অভিনয় করে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হন। অনেক চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন।
কেন চলচ্চিত্রে নিয়মিত হলেন না
বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে অভিনীত ৯৫ ভাগেরও বেশি সিনেমা ব্যবসাসফল হওয়ার পরেও সিনেমায় নিয়মিত না হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সিনেমায় কাজ করা অনেক কঠিন। খুবই কষ্ট করতে হয়। আমি আমার বাবা গোলাম মুস্তাফাকে দেখেছি, পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন হুমায়ুন ফরীদিকে দেখেছি। লম্বা সময় দিতে হয়। কিন্তু আমার নিজের জন্য সময় দরকার। আমি শর্টকাটে কোনো কাজ করতে পারি না। যেটা করব, শতভাগ দিয়ে করব।
জাতীয় সম্মাননা ও একুশে পদক
‘নতুন বউ’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য পার্শ্ব চরিত্রে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন সুবর্ণা মুস্তাফা। তবে সেই পুরস্কারটি গ্রহণ করেননি তিনি। কারণ ওই চলচ্চিত্রে তিনি ছিলেন নাম ভূমিকায়। ২০১৯ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ‘গহীন বালুচর’ সিনেমায় অসাধারণ অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন। একই বছর বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদকেও ভূষিত করে।
ব্যক্তিজীবন
ব্যক্তিগত জীবনে সুবর্ণা মুস্তাফা প্রথম বিয়ে করেছিলেন বরেণ্য অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদিকে। তবে দীর্ঘ ২২ বছর সংসার করে ২০০৮ সালে এসে আলাদা হয়ে যান তারা। এরপর নির্মাতা বদরুল আনাম সৌদকে বিয়ে করেন সুবর্ণা।
সফল পর্দাজুটি
আফজাল-সুবর্ণা, সত্তরের দশকে এ জুটির কাজ শুরু হলেও জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠে আশির দশকে। সেই জনপ্রিয়তা এখনো মানুষকে নষ্টালজিক করে তোলে। আফজাল-সুবর্ণার অনেক নাটকই জনপ্রিয় হয়েছিল, তবে ‘পারলে না রুমকি’ নাটকটি বাংলাদেশের টিভি নাটকে নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছিল।
সুবর্ণাকে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ
টেলিভিশনের অনেক কালজয়ী নাটকের সঙ্গেই সুবর্ণা জড়িয়ে ছিলেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নাটক ধরা হয় যে ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকটিকে, সেটির রচয়িতা হুমায়ূন আহমেদ সুবর্ণা মুস্তাফাকে বলেছিলেন, যদি মুনা চরিত্রটি সুবর্ণা করতে রাজি থাকেন তাহলেই কেবল তিনি নাটকটি নির্মাণ করবেন। হুমায়ূন আহমেদের ‘অয়োময়’ এবং ‘আজ রবিবার’ নাটকেও অভিনয় করে দর্শক প্রশংসিত হন সুবর্ণা মুস্তাফা।
সফল নির্মাতা
পরিচালক হিসেবেও সুবর্ণা মুস্তাফা কিছু কাজ করেছেন। এটিএন বাংলার জন্য ‘আকাশ কুসুম’ নামের এক পর্বের একটি নাটক পরিচালনা করেন, যা কিনা সেই সময়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তীতে ‘শূন্য’ নামের আরেকটি এক পর্বের নাটক নির্মাণ করেন।
আরও যত প্রতিভা
একজন ক্রিকেট-ফ্যান হিসেবে ২০১৫ সাল থেকে ‘রেডিও ভূমি’তে ধারাভাষ্যকারের কাজটাও করে চলেছেন। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে- তিনি সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্রের নির্বাচক হিসেবেও কাজ করেছেন। শুধু বিনোদন জগতে নয়, একজন সুনাগরিক হিসেবেও নিজের দায়িত্ব সব সময় পালন করেছেন তিনি। ২০১৫-১৬ কর বছরে দেশের হয়ে ‘অভিনেতা/অভিনেত্রী’ শ্রেণিতে সবচেয়ে বেশি কর দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সম্মাননাপত্র এবং ট্যাক্সকার্ডও পেয়েছেন।
এই সময়ে
বর্তমানে সুবর্ণা মুস্তাফা বাংলাদেশ সরকারের একজন সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর মাঝেমধ্যে করছেন অভিনয়। তাঁকে সর্বশেষ ‘গণ্ডি’ সিনেমায় দেখা গেছে।